আমাদের বাংলাদেশ নিউজ 24 ডেস্কঃ ১৯৮৬সাল। আমি তখন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র। কী একটা কাজে আমার জরুরি ভিত্তিতে নাগরিকত্ব সনদ প্রয়োজন পড়েছিল। বদরখালী ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ছিলেন এম হোছাইন আহমদ। গ্রামে এসে পরদিন সকালে তাঁর সাথে দেখা করতে গেলাম। বলাবাহুল্য, তখনকার সময়ে এক দিনে বদরখালী-চট্টগ্রাম আসা-যাওয়া করা যেত না। বদরখালী থেকে জীপে/চাঁদের গাড়িতে বাটাখালীর পশ্চিম পাড়। নৌকায় নদী পার হয়ে পূর্ব পাড়। সেখান থেকে রিক্সায় চিরিংগা সোসাইটি। দীর্ঘক্ষণ অপেক্ষার পর কাঠবডির বাসে চড়ে চট্টগ্রাম। চিরিংগা থেকে চট্টগ্রাম পৌঁছতে সময় লাগত প্রায় পাঁচ ঘণ্টা। বদরখালী থেকে বাটাখালী জীপ মালিক সমিতির নির্ধারিত সময় ছিল দেড় ঘণ্টা। জীপগুলি আবার মাঝেমধ্যে পথে বিকল হয়ে যেত।
বদরখালী বাজারের উত্তর-পশ্চিম কর্নারে চেয়ারম্যান সাহেবের সাথে দেখা হয়ে গেল। সালাম করে চট্টগ্রাম থেকে আমার আসার কারণ জানালাম। তিনি বললেন- চল অফিসে যাই।
ওয়াপদা রোডে একটি সেলুন ছিল। একটু এগিয়ে তিনি সেভ করার জন্য সেলুনে ঢুকলেন আর আমি বাইরে দাঁড়িয়ে রইলাম। চেয়ারম্যান সাহেবের কাজ নিখুঁতভাবে সম্পন্ন করতে নরসুন্দরের দীর্ঘ সময় লাগল। অতঃপর অফিসের দিকে যাত্রা শুরু। তখন ইউনিয়ন পরিষদের অফিস ছিল বাজারের দক্ষিণে বিআইডব্লিউটিএ ভবনের দ্বিতীয় তলায়। অফিসে প্রবেশ করে চেয়ারম্যান সাহেব আমাকে বললেন- একটা দরখাস্ত লিখে দাও।
আমি বিনয়ের সাথে জানতে চাইলাম- চেয়ারম্যান সার্টিফিকেটের জন্য কি দরখাস্ত দিতে হবে?
এবার তিনি মুখে কিছু না বলে হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়লেন।
হঠাৎ আমার ভেতরের এক অদৃশ্য শক্তি জেগে উঠল। বললাম- দরখাস্ত লিখে আমি পরে আসব। তারপর সালাম করে অফিস থেকে বের হয়ে গেলাম। আমি তখন অনার্স ফাইন্যাল ইয়ারের ছাত্র। অনার্স শব্দের অর্থ সম্মান। দরখাস্ত করে নাগরিকত্ব সনদ নেয়াটা আইন হোক কিংবা চেয়ারম্যানের তৈরি করা নিয়ম, আমি এটাকে নিজের জন্য সম্মানজনক মনে করিনি। পরে চট্টগ্রাম মহানগরীর একজন ওয়ার্ড কমিশনারের (বর্তমান পদবি কাউন্সিলর) কাছ থেকে দরখাস্ত ছাড়াই নাগরিকত্ব সনদ নিয়ে কাজ সেরেছিলাম।
১৯৯০সাল। নুরুল ইসলাম সিকদার তখন বদরখালী ইউনিয়নের চেয়ারম্যান। বদরখালী বাজারের পূর্ব পাশে দুলাল নামক কুতুবদিয়ার এক হিন্দু ভদ্রলোকের একটি লন্ড্রি ছিল। এক দিন বিকেলে লন্ড্রিতে সিকদার সাহেবকে বসা দেখে কাছে গিয়ে সালাম করলাম। তিনি জানতে চাইলেন কেমন আছি, দেশের কী অবস্থা ইত্যাদি। উল্লেখ্য, তখন এরশাদ বিরোধী তীব্র গণ আন্দোলন চলছে। কথা বলেত বলেত হঠাৎ প্রাক্তন চেয়ারম্যান এম হোছাইন আহমদের কথা মনে পড়ে গেল। সিকদার সাহেবকে বললাম- চাচা, আমার একটি নাগরিকত্ব সনদ দরকার।
তিনি আমাকে বসতে বলে একজন লোক ডেকে অফিসে পাঠালেন অফিস খোলা কি না এবং সচিব সাহেব অফিসে আছে কি না দেখতে। লোকটি এসে বলল- অফিস বন্ধ। ইউইনিয়ন পরিষদের সচিব ছিলেন আহমদ নামক বদরখালীর এক যুবক। আহমদ বাজারের কোথাও আছে কি না দেখার জন্য তাকে পুনরায় পাঠালেন। সে সময় বদরখালী বাজারের আয়তন ছিল বর্তমান আয়তনের বড়জোর দশ ভাগের এক ভাগ। লোকটি ফিরে এসে জানাল বাজারের কোথাও আহমদ নেই। তখন নুরুল ইসলাম সিকদার আমাকে বললেন- তুমি চলে যাও, দেখি কি করা যায়।
তখন মোবাইল ফোন নামক কোন যন্ত্রের অস্তিত্ব ছিল না। না হয় তাৎক্ষিণক একটা ব্যবস্থা তিনি করতেন। আমারও সার্টিফিকেটের ব্যাপারে কোন তাড়া নেই। তাই আর কিছু না বলে সালাম করে চলে আসি।
রাত প্রায় ১০টা। তখনকার সময়ে গ্রামে ১০টা মানে গভীর রাত। ঘরে আমরা সবাই ঘুম। সিকদার সাহেবের ডাকে ঘুম ভেঙ্গে গেল। এত রাতে রাস্তা থেকে তিনি আমাকে ডাকছেন। তাড়াতাড়ি বের হলাম।
তিনি বললেন- আহমদকে না পেয়ে তার ঘরে লোক পাঠালাম সে যেন এখুনি এসে আমার সাথে দেখা করে। সে ঘরে ছিল না। দরবেশকাটা না ইলিশিয়া কোথায় যেন গেছে। রাতে ঘরে এসে খবর পেয়ে সে বাজারে এসে আমার সাথে দেখা করল। তারপর অফিস খুলে সার্টিফিকেট লিখে আমি ঘরে যাওয়ার পথে তোমাকে দিতে এলাম।
আমি অবাক বিষ্ময়ে শুনে গেলাম। প্রথমে আমার মুখ দিয়ে কোন কথাই বের হল না। তারপর বললাম- চাচা কেন আপনি এত কষ্ট করতে গেলেন?
তিনি বললেন- তোমরা উচ্চশিক্ষিত ছেলে, দেশের ভবিষ্যৎ। তোমাদের নিয়ে আমরা গৌরব বোধ করি। আগামী দিনে তোমরাইতো দেশ পরিচালনা করবে। তুমি একটি সার্টিফিকেটর কথা বলেছ, নিশ্চয় এটা তোমার খুব দরকার। ভাবলাম যেভাবে হোক আমাকে ব্যবস্থা করতে হবে.........।
তখন বদরখালীতে কোন রিক্সা-গাড়ি ছিল না। আমার হাতে সার্টিফিকেটটি দিয়ে তিনি বাড়ির দিকে হাঁটা শুরু করলেন। যতক্ষণ তাঁকে দেখা যায়, আমি দাঁড়িয়েছিলাম।
দু জন চেয়ারম্যান। একজন বলেছিলেন দরখাস্ত লিখতে, অন্যজন গভীর রাতে আমার ঘরে এসে সার্টিফিকেট দিয়ে গেলেন।
আমাকে যদি কেউ প্রশ্ন করে, আমার কাছে মূল্যবান কি সম্পদ আছে? উত্তরে বলব- বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ ডিগ্রিসহ ডজনখানেক একাডেমিক ও পেশাগত সার্টিফিকেটের একটি ফাইল আছে আমার। ওই ফাইলটাই এখনো পর্যন্ত আমার কাছে সবচেয়ে দামি। নুরুল ইসলাম সিকদারের দেয়া সেই চেয়ারম্যান সার্টিফিকেটটি আমি এই দামি ফাইলেই সংরক্ষণ করে রেখেছি। আমার কাছে ওটা নিছক একটি সার্টিফিকেট নয়, বরং এর সাথে জড়িয়ে আছে আমার মর্যাদা, আমার সম্মান এবং আমার প্রতি একজন মানুষের অকৃত্রিম স্নেহ।
এখনো তাঁর কথাগুলো কানে বাজে- ‘তোমরা উচ্চশিক্ষিত ছেলে, দেশের ভবিষ্যৎ। আগামী দিনে তোমরাইতো দেশ পরিচালনা করবে।’ সেদিন তিনি আমাকে অনেক বড় করে দেখেছিলেন। নেতা বনার কোন আকাঙ্খা কখনো আমার মনে জাগে নি। দেশ পরিচালনা দূরের কথা, ঠিকমত নিজেকে পরিচালনা করার যোগ্যতাও তো আমার নেই।
বদরখালী ইউনিয়নের প্রাক্তন চেয়ারম্যান নুরুল ইসলাম সিকদার আজ আমাদের মাঝে বেঁচে নেই। যখনি একাডেমিক সার্টিফিকেটের ফাইলিট খুলি, চোখের সামনে ভেসে উঠে বিশাল দেহের, ততোধিক বিশাল মনের অধিকারী একজন মানুষের চেহারা।
মহান রবের দরবারে তাঁর মাগফেরাত কামনা করছি। দোয়া করি আল্লাহ রাব্বুল আলামিন যেন তাঁকে জান্নাতুল ফেরদৌসে জায়গা দেন।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন