বিজ্ঞাপন দিন

আচ্ছালামু আলাইকুম ওয়ারাহমাতুল্লাহ। ইসলামী ব্যাংক এজেন্ট ব্যাংকিং আউটলেট দক্ষিণগাও, শাহীবাগ বাজার এর পক্ষ থেকে সকল গ্রাহক, শুভাকাংখীসহ সবাইকে জানাই ঈদ উত্তর সালাম ও আন্তরিক শুভেচ্ছা। ব্যাংক খোলা এবং যথারীতি ব্যাংকিং কার্যক্রম চলছে। এই গ্রুপে যারা আছেন তাদের মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট এলাকার এলাকারসকলকে ইসলামী ব্যাংকের মাধ্যমে বিদেশ থেকে রেমিটপন্স পাঠানোর আহবান জানাচ্ছি। ঢাকার সবুজবাগ থানার রাজারবাগ, কুসুমবাগ, দক্ষিনগাও, শাহীবাগ, মানিকদিয়া, বাইকদিয়া, নন্দিপাড়াসহ সকল এলাকার গ্রাহক, শুভাকাংখী, শুভানুধ্যায়ীদের প্রদত্ত মোবাইল নাম্বারে যোগাযোগ করার অনুরোধ করা হলোঃ ০১৭১১-৪৫৮১৫১, ০১৭০০৯২৫২৪১:b>ইসলামী ব্যাংক এজেন্ট ব্যাংকিং আউটলেট দক্ষিণগাও, শাহীবাগ বাজার
প্রচ্ছদ লেবেলটি সহ পোস্টগুলি দেখানো হচ্ছে৷ সকল পোস্ট দেখান
প্রচ্ছদ লেবেলটি সহ পোস্টগুলি দেখানো হচ্ছে৷ সকল পোস্ট দেখান

রবিবার, ১১ জুলাই, ২০২১

চট্টগ্রামে মেয়ের পিতার বাড়ি থেকে জামাই এর বাড়িতে কুরবানির পশু সহ এটা-ওটা হাদিয়া হিসেবে পাঠানোর বদ-রসমের বিলুপ্তি সাধন প্রসংগ ;

 

আমাদের বাংলাদেশ নিউজ24: চট্টগ্রামে মেয়ের পিতার বাড়ি থেকে  জামাই এর বাড়িতে কুরবানির পশু সহ এটা-ওটা  হাদিয়া হিসেবে পাঠানোর বদ-রসমের বিলুপ্তি সাধন প্রসংগ ; বাংলাদেশ নিউজ 24
আমাদের বাংলাদেশ নিউজ24 ডেস্কঃ আমাদের দেশে অধিকাংশ ক্ষেত্রে মেয়ের বাবা-মা হওয়া যেন একটা মহা অপরাধ। ছেলের (মেয়ের জামাই) বাড়িতে একতরফাভাবে এটা পাঠাতে হবে, ওটা পাঠাতে হবে, আরো কত বদ রুসুম! ফলে জীবন যেমন জটিল হয়ে যায়, তেমনি জিল্লতির শেষ থাকেনা মেয়ের বাবা-মায়ের। চট্টগ্রামে এর প্রচলন খুব বেশি। এখানকার সবাই জমিদার (শহরে যারা বাড়ি ভাড়া দেয়) কি না তাই!

কুরবানির সময় ঘনিয়ে এলে চট্টগ্রামের কিছু মানুষের কুরবানি পশু হাদিয়া দেয়ার প্রবনতা পরিলক্ষিত হয়। বিশেষ করে কোন কোন মেয়ের বাবা ছেলের বাবার নিকট কুরবানির পশু গরু/ ছাগল/খাসি পাঠিয়ে থাকে। ছেলের বাবা কিন্তু মেয়ের বাবার জন্য কখনো কোথাও কুরবানির পশু প্রেরণ করেছে এমন কোন তথ্য অন্তত আমার জানা নেই। এ যেন জাতে মাতাল তালে ঠিক। এ প্রেরন যদি প্রেসার ক্রিয়েট করে হয়ে থাকে, কিংবা বিভিন্ন কলাকৌশলের মাধ্যমে হয়, তাহলে ইহা জায়েজ নেই। ইহাও এক ধরনের যৌতুক ।যৌতুকের মধ্যে শামিল। বেয়াইদের মধ্যে এতো ভালবাসা থেকে থাকলে,( সচ্ছল) ছেলের পিতা কি কখনো দায়গ্রস্ত মেয়ের পিতার জন্য কুরবানি পশু পাঠিয়েছে ? ।
হাঁ! কোন সচ্ছল মেয়ের বাবা কোন ধরনের প্রেসার ব্যাতিরেকে নিরেট ভালবাসার নিদর্শন হিসেবে ছেলের বাবা বেয়াইর নিকট হাদিয়া হিসেবে কুরবানি পশু প্রেরণ করে থাকে, তাহলে মেয়ের পিতার কুরবানির নিয়তে পশু প্রেরণ করা ও এ পশুর কারণে ছেলের পিতা (বেয়াইর) উপর ওই প্রেরিত পশু দিয়ে কুরবানি করার হুকুম কি ? তা নিম্নে দেয়া গেল।
মেয়ের বাবার নিয়তের কারণে ছেলের বাবার উপর কুরবানি ওয়াজিব হবে না। ছেলের বাবা সচ্ছল হয়ে থাকলে সচ্ছলতার কারণে তার উপর কুরবানি ওয়াজিব হবে।ছেলের বাবা গ্রহণের মধ্য দিয়ে উহার মালিক হয়ে যাবে।মালিক হিসেবে পশুর উপর ছেলের বাবার পূর্ণ ইখতিয়ার প্রতিষ্ঠিত হবে। ইচ্ছে করলে প্রেরিত পশুটি লালন জন্য রেখে দিতে পারে, বিক্রি কিংবা কাউকে হাদিয়াও দিতে পারে, অথবা উহা দিয়ে নিজে কুরবানিও করতে পারে। হাঁ তবে বেয়াইর পাঠানো পশু দ্বারা কুরবানি করা উত্তম। এতে প্রেরক বেয়াইর সন্তুষ্টিও অর্জিত হলো এবং প্রেরক বেয়াইর খোঁচা থেকেও বাঁচা গেল ।
মানুষ একটু সচেতন হলে মেয়ের পিতার উপর চাপিয়ে দেয়া এ বদ্ রসম ও কুপ্রথার বিলুপ্ত সাধন করা যায়। বিলুপ্ত সাধন করা উচিত। এ প্রতারণার মূলোৎপাটন করা অতীব জরুরী হয়ে পড়েছে।

লেককঃ মাহবুবুল আলম ছিদ্দিকী, উপাধ্যক্ষ,
দারুল উলুম কামিল মাদরাসা, চট্টগ্রাম।

বুধবার, ১৬ জানুয়ারী, ২০১৯

বর্তমান প্রেক্ষাপটে দাওয়াতের হৃদয়গ্রাহী পদ্ধতি - ড. মোবারক হোসাইন


“তার কথার চাইতে আর কার কথা উত্তম হতে পারে যে মানুষকে আল্লাহর পথে ডাকে ও সৎকর্ম করে এবং বলে আমি মুসলমান ”( আল কুরআন, সুরা- হামীম আস সাজদা, আয়াত -৩৩)
প্রকৃত দাওয়াত দানকারী তিনিই-যিনি মানুষকে দাওয়াত দেওয়ার আগে নিজেকে আল্লাহর কাছে বিক্রি করে দেন, অর্থাৎ “First you sell yourself”. বাইবেল গ্রন্থে বলা হয়েছে “to do good and communicate, forget not”. আধুনিক যুগে দাওয়াতী কাজে সফলতা লাভ করতে হলে দাওয়াতের পদ্ধতি পরিবর্তন করতে হবে।
সাধারণত প্রযুক্তির উন্নয়নের সাথে সাথে মানুষের চিন্তা ও চেতনা দিন দিন পরিবর্তন হচ্ছে। আজকের যুগে দাওয়াতী কাজ করা মানে হাতের তালুতে আগুনের স্ফুলিঙ্গ রাখা যেমন কঠিন তার চেয়েও বেশি কঠিন বর্তমান মানুষের কাছে, কারণ যুগের পরিবর্তনে মানুষের অনেক পরিবর্তন হয়েছে, মানুষ তার বয়সের তুলনায় অনেক বেশি অগ্রসর হচ্ছে।

দাওয়াতের অর্থ কি ?
দাওয়াত শব্দটি আরবি ‘দাওয়াতুন’ থেকে। অর্থ – আহবান, ডাকা, নিমন্ত্রণ ইত্যাদি। The Hanswehr Dictionary of Modern Written Arabic- এ দাওয়াহ শব্দটির অর্থে বলা হয়েছে : Missionary activity, Missionary work, Propaganda. অর্থাৎ কোন নির্দিষ্ট উদ্দেশ্যের দিকে আহবান করা, অনুপ্রাণিত করা বা ডাকাকে বলা হয় দাওয়াত।
দাওয়াত দুই ধরণের হতে পারেঃ
১. নেতিবাচকঃ হাদিসঃ রাসূল (সা:) বলেন, যে ব্যক্তি জাহেলিয়াতের দিকে মানুষদেরকে ডাকে তার জন্য রয়েছে জাহান্নামের একটি অংশ। প্রশ্ন করা হলো সে যদি নামাজ পড়ে এবং রোজা রাখে। জবাবে রাসূল বলেন যদি সে নামাজ পড়ে রোজা রাখে এবং বলে আমি একজন মুসলমান তবুও তার জন্য জাহান্নামের অংশ রয়েছে। – মুসলিম
২. ইতিবাচকঃ
দাওয়াতের দুটি দিক রয়েছে।
প্রকাশ্য দাওয়াত বা মৌখিক দাওয়াত
অপ্রকাশ্য দাওয়াত বা চারিত্রিক দাওয়াত
-মানব সৃষ্টির পর তার সামনের দুটো দিক খুলে দেয়া হয়েছে- ইন্না হাদাইনাহুস সাবিলা ইম্মা শাকিরাও ওয়া ইম্মা কাফুরা। অর্থ- আমরা পথ দেখিয়ে দিলাম মানুষকে এজন্য যে তাদের কারা কৃতজ্ঞ ও কারা অস্বীকারকারী ।
আমি মানুষকে দেখিয়েছি- ১)কৃতজ্ঞতা বা আনুগত্যের পথ ২) কুফরীর পথ
আমরা আশরাফুল মাখলুকাত। অর্থাৎ সব সৃষ্টির সেরা জীব। আবার মুসলমান হচ্ছে শ্রেষ্ঠ উম্মত বা শ্রেষ্ঠ জাতি। কুরআনে সুরা আলে ইমরানের ১১০ নং আয়াতে আল্লাহ্‌ বলেন-
كنتم خير أمة أخرجت للناس
অর্থাৎ ‘তোমরাই হলে সর্বোত্তম জাতি, মানব জাতির কল্যাণের জন্য তোমাদের সৃষ্টি করা হয়েছে। আর মুসলমান অর্থ আত্মসমর্পণকারী ।

দাওয়াত দানের গুরুত্বঃ
সাহাবীদের সংখ্যা ছিল সোয়া লক্ষের মত। কিন্তু মক্কা ও মদীনায় সাহাবীদের কবরের সংখ্যা প্রায় বিশ হাজার। বাকী লক্ষাধিক সাহাবী কোথায়? তারা মসজিদুল হারাম কিংবা মসজিদে নববীতে কেবল নামায আদায় করে নেকি বা সোয়াব হাসিলের পরিবর্তে পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়েছেন মানুষকে আল্লাহর দিকে ডাকার জন্য। ঘর-বাড়ী, ধন-সম্পদ ও আত্মীয়-স্বজনের মমতার বন্ধন ছেড়ে দিয়ে বেরিয়ে পড়েছেন কুফুরী থেকে আনুগত্যের দিকে এবং অন্ধকার থেকে আলোর দিকে দাওয়াত দেয়ার উদ্দেশ্যে। তারা মক্কা-মদীনায় পড়ে থাকা অপেক্ষা মানুষকে আল্লাহর দিকে দাওয়াত দেয়াকে শ্রেষ্ঠ মনে করেছেন- যে কাজের দায়িত্ব ছিল আল্লাহর প্রেরিত সব নবী রাসূলদের।
ইউনুস (আঃ) সারাদিন অপেক্ষা করে দাওয়াতী কাজ করে কোনো ফলাফল না পেয়ে চলে যাচ্ছিলেন। নদীতে মাঝামাঝি পর্যায়ে নৌকা আটকে গেল। স্থায়ী লটারি করা হল, লটারিতে ইউনুস (আঃ) এর নাম উঠল, আবারও লটারি করা হল আবারও নাম উঠল, তারপর আবারও লটারি করা হল, আবারও ইউনুস (আঃ) এর নাম উঠল। তিনি বললেন আমাকেই ফেলে দাও। তাকে নদীতে ফেলে দেয়া হলো। তিমি ইউনুস (আঃ) কে খেয়ে ফেলল-তিমির পেটে ইউনুস (আঃ) দোয়া করলেন :-(লা ইলাহা ইল্লা আনতা———-)
-দ্বীন অর্থ জীবন ব্যবস্থা, আনুগত্য, কর্তৃত্ব, প্রতিদান।
দাওয়াতী দ্বীনের কাজ আল্লাহর নির্দেশ তথা ফরজ। যেমন- আল্লাহর বাণী:
১. হামীম আস-সাজদা-৩৩-দাওয়াতের কাজ হচ্ছে সর্বোত্তম কাজ।
২. জিহাদের ১ম কাজ দাওয়াত
৩. নাহল-১২৫, ৩৬, সরাসরি দাওয়াতের নির্দেশ দেয়া হয়েছে।
আলে-ইমরান-১১০, ১০৪
আহযাব-৪৫-৪৬, শুরা-১৫
আরাফ-৫৯, ৭৩, ৮৫, ৬৫
ফাতির-২৪
ইউসুফ-১৫৮, ইব্রাহীম-৫
মুদ্দাচ্ছির-১-৩, বনি-ইসরাঈল-৫৩

-রাসুলের (স.) মিশন ছিল দাওয়াত:
-রাসুলের দায়িত্বের ধারাবাহিকতা অব্যাহত রাখা:
-নিজেকে পবিত্র ও পরিশুদ্ধ রাখা যায়:
-সত্যের সাক্ষ্য হিসেবে দাওয়াত দিতে হবে:
-আল্লাহ দ্বীন প্রতিষ্ঠার জন্য:
-আখেরাতের নাজাতের জন্য:
-আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের নির্দেশ
-আল্লাহ রসুল (সঃ) এর সর্বশেষ নির্দেশ ছিল দাওয়াত দান।
-দাওয়াত দান করা ফরজে আইন।
-সাহাবায়ে আজমাঈন আনুগত্য করে দিখিয়ে গেছেন

আমরা দাওয়াত কেন দেব?
১.দাওয়াত দেয়া মৌলিক দায়িত্ব:
يَاأَيُّهَاالرَّسُولُبَلِّغْمَاأُنْزِلَإِلَيْكَمِنْرَبِّكَوَإِنْلَمْتَفْعَلْفَمَابَلَّغْتَرِسَالَتَهُوَاللَّهُيَعْصِمُكَمِنَالنَّاسِإِنَّاللَّهَلَايَهْدِيالْقَوْمَالْكَافِرِينَ
হে রাসূল (স.)! আপনার উপর আপনার প্রতিপালক যা অবর্তীণ করেছেন তা পৌঁছে দিন । যদি এ কাজ না করেন তবে রিসালতের দায়িত্বই পালন করা হয়নি। সুরা মায়েদা :৬৭
يَاأَيُّهَاالْمُدَّثِّرُ (১) قُمْفَأَنْذِرْ (২) وَرَبَّكَفَكَبِّرْ (৩)
হে চাদর আবৃত ব্যাক্তি! উঠুন ও ভয় প্রদর্শন করুন এবং আপনার রবের শ্রেষ্ঠত্ব ঘোষণা করুন। আল-মুদ্দাসসির:১-৩

هُوَالَّذِيأَرْسَلَرَسُولَهُبِالْهُدَىوَدِينِالْحَقِّلِيُظْهِرَهُعَلَىالدِّينِكُلِّهِوَلَوْكَرِهَالْمُشْرِكُونَ
নিশ্চয়ই আমি হেদায়াত ও সত্য দ্বীন সহকারে রাসূলকে (সা:) পাঠিয়েছি অন্য সকল দ্বীনের উপর ইসলামকে বিজয়ী করার জন্য। সফ:৯
২.প্রকাশ্য ও গোপনে দাওয়াত:
ثُمَّإِنِّيدَعَوْتُهُمْجِهَارًا (৮) ثُمَّإِنِّيأَعْلَنْتُلَهُمْوَأَسْرَرْتُلَهُمْإِسْرَارًا
অর্থাৎ আমি তাদেরকে প্রকাশ্যে দাওয়াত দিয়েছি। অতঃপর আমি ঘোষণা সহকারে প্রচার করেছি এবং তাদেরকে গোপনে চুপিসারে ও দাওয়াত দিয়েছি। সুরা নুহ :৮-৯

৩.দাওয়াত হবে সর্বাবস্থায় :
قَالَرَبِّإِنِّيدَعَوْتُقَوْمِيلَيْلًاوَنَهَارًا
অর্থাৎ “তিনি বলেন, হে প্রভু আমি আমার জাতিকে রাতে দিনে সর্বাবস্থায় দ্বীনের দিকে আহবান করছি। সুরা নুহ -৫
দাওয়াতের কেন্দ্রবিন্দু হবে- (ক) তাওহীদ (খ) রিসালাত (গ) আখেরাত

দাওয়াতে দ্বীনের গুরুত্ব ও রাসূল (সা:) এর ভূমিকাঃ
আম্বিয়া আলাইহিস সালামদের দাওয়াতি কর্মকান্ডের বর্ণনা করেই শেষ করা হয়নি বরং রাসূল (সা) এর প্রতি দাওয়াতি কাজের গুরুত্ব এভাবে নাযিল করা হয়েছে যে, অর্থ: হে রাসূল আপনার প্রতি যা কিছু অবর্তীণ করা হয়েছে তা যথাযথভাবে পৌছে দিন। (অর্থাৎ পরিপূর্ণ দাওয়াত পৌঁছে দিন) যদি আপনি না করতে পারেন তা হলে আপনি রেসালাতের সঠিক দায়িত্ব পালন করলেন না। সূরা মায়েদা, আয়াত ৬৭।
হাদীস :অর্থ: হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা:) বর্ণিত, তিনি বলেন আমি রাসূল (সা:) কে বলতে শুনেছি তিনি বলেছেন আল্লাহ তায়ালা সেই ব্যক্তির মুখ উজ্জ্বল করুন যে আমার একটি হাদিস শুনেছে এবং যে ভাবে শুনেছে ঠিক সে ভাবেই তা অপরের নিকট পৌঁছিয়েছেন। কেননা অনেক সময় যাকে পৌঁছানো হয়েছে সে ব্যক্তি শ্রোতা অপেক্ষা অধিক রক্ষণাবেক্ষণ হয়ে থাকে। তিরমিযি ও ইবনে মাজাহ।

নবী ও রাসুলগণের দাওয়াতঃ
১. হযরত নূহ (আঃ) এর দাওয়াতঃ
لَقَدْ اَرْسَلْنَا نُوْحًا اِلَى قَوْمِهِ فَقَالَ يَقَوِْم اعْبُدُوا اللَّهَ ماَ لَكُمْ مِنْ اِلَهٍ غَيْرُهُ- اِنِّى اَخَافُ عَلَيْكُمْ عَذَابَ يَوْمٍ عَظِيْمٍ০
“আমরা নূহ্কে তার জাতির লোকদের প্রতি প্রেরণ করেছি; তিনি বলেন, হে জাতির লোকেরা তোমরা আল্লাহর দাসত্ব কবুল কর। কেননা তিনি ছাড়া তোমাদের কোন ইলাহ নাই। আমি তোমাদের জন্য একটি বড় আজাবের ভয় পোষণ করি।” (সুরা আ’রাফ- ৫৯)
২. হযরত হুদ (আঃ) এর দাওয়াতঃ
وَ اِلَى عَادٍ اَخَاهُمْ هُوْدًا- قَالَ يَاقَوْمِ اعْبَدُوا اللَّهَ مَالَكُمْ مِنْ اِلَه ٍ غَيْرُهُ- اَفَلَا تَتَّقُوْنَ০
এবং ‘আদ’ জাতির প্রতি আমরা তাদের ভাই ‘হুদ’ কে পাঠিয়েছি। তিনি বললেন, হে জাতির লোকেরা, তোমরা আল্লাহর দাসত্ব কর। তিনি ছাড়া তোমাদের কোন ইলাহ নাই। এর পরেও কি তোমরা ভয় করে চলবে না।” (সুরা আ’রাফ- ৬৫)
৩. হযরত সালেহ (আঃ) এর দাওয়াতঃ
وَ اِلَى عَادٍ اَخَاهُمْ صَالِحًا- قَالَ يَاقَوْمِ اعْبَدُوا اللَّهَ مَالَكُمْ مِنْ اِلَهٍ غَيْرُهُ
এবং ‘সামুদ’ জাতির প্রতি আমরা তাদের ভাই ‘সালেহ’ কে পাঠিয়েছি। তিনি বললেন, হে জাতির লোকেরা, তোমরা আল্লাহর দাসত্ব কবুল কর, তিনি ছাড়া তোমাদের কোন ইলাহ নাই। (সুরা আ’রাফ- ৭৩)
৪. হযরত লুত (আঃ) এর দাওয়াতঃ
وَلُوطًا إِذْ قَالَ لِقَوْمِهِ أَتَأْتُونَ الْفَاحِشَةَ مَا سَبَقَكُم بِهَا مِنْ أَحَدٍ مِّنَ الْعَالَمِينَ ০ إِنَّكُمْ لَتَأْتُونَ الرِّجَالَ شَهْوَةً مِّن دُونِ النِّسَاءِ ۚ بَلْ أَنتُمْ قَوْمٌ مُّسْرِفُون َ০
“এবং লুত যখন নিজ জাতির লোকদের বললেন, তোমরা এমন সব নির্লজ্জ কাজ করছো যে, তোমাদের পূর্বে দুনিয়ায় কেউ এ কাজ করেনি। তোমরা নারীদেরকে বাদ দিয়ে পুরুষদের সাথে কাম বাসনা চরিতার্থ করছো; বরং তোমরা সীমালংঘনকারী একটি জাতি।” (সূরা আ’রাফ- ৮০)
৫. হযরত শোয়াইব (আঃ) এর দাওয়াতঃ
وَإِلَىٰ مَدْيَنَ أَخَاهُمْ شُعَيْبًا ۗ قَالَ يَا قَوْمِ اعْبُدُوا اللَّهَ مَا لَكُم مِّنْ إِلَٰهٍ غَيْرُهُۖ قَدْ جَاءَتْكُم بَيِّنَةٌ مِّن رَّبِّكُمْ ۖ فَأَوْفُوا الْكَيْلَ وَالْمِيزَانَ وَلَا تَبْخَسُوا النَّاسَ أَشْيَاءَ هُمْ وَلَا تُفْسِدُوا فِي الْأَرْضِ بَعْدَ إِصْلَاحِهَا ۚ ذَٰلِكُمْ خَيْرٌ لَّكُمْ إِن كُنتُم مُّؤْمِنِينَ ০
“আর মাদিয়ানবাসিদের প্রতি আমরা তাদের ভাই শোয়াইবকে পাঠিয়েছি। তিনি বল্লেন; হে জাতির লোকেরা, আল্লাহর দাসত্ব কর, তিনি ছাড়া তোমাদের কোন ইলাহ নেই। তোমাদের নিকট তোমাদের রবের পক্ষ থেকে সুস্পষ্ট দলিল এসে গেছে। অতএব ওজন ও পরিমাপ পূর্ণমাত্রায় কর, লোকদের তাদের দ্রব্যে ক্ষতিগ্রস্থ করে দিওনা এবং পৃথিবীতে ফাসাদ সৃষ্টি করো না, যখন তা সংশোধন ও সংস্কার হয়েছে। এর মধ্যে তোমাদের কল্যাণ নিহিত, যদি তোমরা মু’মিন হয়ে থাক।” (সুরা আ’রাফ- ৮৫)
৬. হযরত ইউসুফ (আঃ) এর দাওয়াতঃ
يَا صَاحِبَيِ السِّجْنِ أَأَرْبَابٌ مُّتَفَرِّقُونَ خَيْرٌ أَمِ اللَّهُ الْوَاحِدُ الْقَهَّار- ُمَا تَعْبُدُونَ مِن دُونِهِ إِلَّا أَسْمَاءً سَمَّيْتُمُوهَا أَنتُمْ وَآبَاؤُكُم مَّا أَنزَلَ اللَّهُ بِهَا مِن سُلْطَانٍ ۚ إِنِ الْحُكْمُ إِلَّا لِلَّهِ ۚ أَمَرَ أَلَّا تَعْبُدُوا إِلَّا إِيَّاهُ ۚ ذَٰلِكَ الدِّينُ الْقَيِّمُ وَلَٰكِنَّ أَكْثَرَ النَّاسِ لَا يَعْلَمُونَ ০
“হে কারা বন্ধুগণ! বিভিন্ন বর কি উত্তম না মহাপ্রাক্রমশালী এক আল্লাহ? তোমরা তো আল্লাহকে ছেড়ে অবাস্তব নামের পুজা করছো- যাদেরকে তোমরা ও তোমাদের পিতৃপুরুষেরা সাব্যস্ত করে নিয়েছে, আল্লাহ তো সেগুলি সমন্ধে কোন প্রমাণ পাঠান নাই। নিশ্চয়ই হুকুম দেয়ার অধিকার একমাত্র আল্লাহর, তোমাদেরকে এই মর্মে নির্দেশ দেয়া হচ্ছে যে, একনিষ্টভাবে কেবলমাত্র তারই ইবাদত করবে। এটিই হচ্ছে তোমাদের জন্য স্থায়ী বিধান। (সুরা ইউসুফ- ৩৯,৪০)
৭. হযরত ইব্রাহিম (আঃ) এর দাওয়াতঃ وَإِذْ قَالَ إِبْرَاهِيمُ لِأَبِيهِ آزَرَ أَتَتَّخِذُ أَصْنَامًا آلِهَةً ۖ إِنِّي أَرَاكَ وَقَوْمَكَ فِي ضَلَالٍ مُّبِينٍ ০
“স্মরণ কর ইব্রাহিমের ঘটনা, যখন তিনি তার পিতা আজরকে বলেছিলেন, তুমিতো মূর্তি গুলোকেই ইলাহ হিসেবে গ্রহণ করেছ। আমিতো তোমাকে এবং তোমার জাতিকে সুস্পষ্ট গোমরাহীতে লিপ্ত দেখতে পাচ্ছি। (সুরা আন‘আম- ৭৪)
৮. হযরত মুসা (আঃ) এর দাওয়াতঃ
وَإِذْ أَخَذْنَا مِيثَاقَ بَنِي إِسْرَائِيلَ لَا تَعْبُدُونَ إِلَّا اللَّهَ وَبِالْوَالِدَيْنِ إِحْسَانًا وَذِي الْقُرْبَىٰ وَالْيَتَامَىٰ وَالْمَسَاكِينِ وَقُولُوا لِلنَّاسِ حُسْنًا وَأَقِيمُوا الصَّلَاةَ وَآتُوا الزَّكَاةَ ثُمَّ تَوَلَّيْتُمْ إِلَّا قَلِيلًا مِّنكُمْ وَأَنتُم مُّعْرِضُونَ ০
“স্মরণ কর যখন আমরা বনি ইসরাইলদের নিকট থেকে এই প্রতিশ্রুতি নিয়েছিলাম যে, আল্লাহ ছাড়া আর কারো ইবাদাত করবে না। মাতা-পিতা, আত্মীয়-স্বজন, এতিম ও মিসকীনের সাথে ভালো ব্যবহার করবে। মানুষের সাথে সুন্দর সুন্দর কথাবার্তা বলবে, নামাজ কায়েম করবে এবং যাকাত দেবে। মুষ্টিমেয় লোক ছাড়া তোমরা সকলেই এই প্রতিশ্রুতি ভংগ করেছ এবং শেষ পর্যন্ত ঐ অবস্থায় রয়ে গেছ।” (সুরা বাকারাহ- ৮৩)
৯. হযরত ঈসা (আঃ) এর দাওয়াতঃ
وَقَالَ الْمَسِيحُ يَا بَنِي إِسْرَائِيلَ اعْبُدُوا اللَّهَ رَبِّي وَرَبَّكُمْ ۖ إِنَّهُ مَن يُشْرِكْ بِاللَّه ِ فَقَدْ حَرَّمَ اللَّهُ عَلَيْهِ الْجَنَّةَ وَمَأْوَاهُ النَّارُ ۖ وَمَا لِلظَّالِمِينَ مِنْ أَنصَار ০ٍ
“এবং মসীহ তো বলেছিল; হে বনী ইসরাইলের লোকেরা, আল্লাহর দাসত্ব কর, যিনি আমারও রব তোমাদেরও রব। বস্তুতঃ আল্লাহর সাথে অন্য কাউকে যে শরীক করেছে আল্লাহ তার জন্য জান্নাত হারাম করে দিয়েছেন। আর তাদের পরিণতি হবে জাহান্নাম। এই যালেমদের কোন সাহায্যকারী নাই।” (সুরা মায়েদা- ৭২)

আমাদের দাওয়াতের ক্ষেত্রঃ
১)সকল ছাত্র, ২)প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক ও কর্মচারী, ৩) আত্মীয় স্বজন, ৪) নিজ পরিবার, ৫) প্রতিবেশীর মাঝে, ৬) সাধারণ জনগণের মাঝে, ৭) কর্মক্ষেত্রে, ৮) পেশাজীবিদের মাঝে, ৯) সমাজের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিদের মাঝে

দাওয়াত দানের উপকারিতাঃ
১)নিজের পরিশুদ্ধি ঘটে, ২) জ্ঞান বৃদ্ধি পায়, ৩) দুনিয়া ও আখেরাতে মর্যাদাবান হবেন, ৪) সদকায়ে জারিয়া

রাসূল (সঃ)-এর ৬টি বৈশিষ্ট্য ইমাম মুসলিমঃ
১)বাগ্মীতা (কথার যাদু), ২) Personality (ব্যক্তিত্ব), ৩) গণীমাত হারাম, ৪) সকল স্থানকে মসজিদ বানানো হয়েছে, ৫) সমগ্র সৃষ্টির জন্য নবী, ৬) খাতামুন নাবিয়্যিন।

দাওয়াত দানকারীর বৈশিষ্ট্য:
১. দায়ীকে হেকমাত অবলম্বন করা
– স্বাভাবিক সময়ে
– অস্বাভাবিক সময়ে
২. উত্তম উপদেশ বর্ণনার অধিকারী হওয়া
৩. দায়ীকে যুক্তি তর্কের মাধ্যমে দাওয়াত উপস্থাপনের যোগ্য হওয়া। (এ ক্ষেত্রে কোরআন ও হাদিসের বক্তব্য গুলি উপস্থাপন করতে পারলে ফলাফল বেশী হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।)
৪. দায়ীকে চরম ধৈর্যশীল হওয়া। অর্থ: “আর ধৈর্য ধারণ দায়ীকে বিরাগ ও ক্ষমার মানসিকতার অধিকারী হওয়া। (অর্থ: আর তারা রাগকে সংবরণকারি এবং মানুষদের প্রতি ক্ষমাশীল। আল কোরআন)
৫. দায়ীকে কথা ও কাজের মিল রাখা (অর্থ: হে ঈমানদার লোকেরা তোমরা এমন কথা কেন বল যে কাজ তোমরা কর না। সূরা সফ, আয়াত ২)
৬. দায়ীকে জ্ঞানগত দিকে শ্রেষ্ঠ হওয়া।
৭. দায়ীকে টার্গেটকৃত ব্যক্তির মন মানসিকতা ও অবস্থার প্রতি নজর রাখা।
৮. দাওয়াতকে সহজ রূপে দাওয়াত পেশকারী হওয়া।
৯. আদর্শের পুর্নাঙ্গ জ্ঞান এবং সে অনুযায়ী চরিত্র ও কর্ম থাকা ।
১০. দাওয়াতী কাজের টার্গেট থাকবে একটাই-‘আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন’।
১১. কঠোর পরিশ্রমী ও ধৈর্যশীল হবেন।
১২. উদার মনের তথা বিশাল হৃদয়ের অধিকারী হবেন।
১৩. সর্বাবস্থায় আল্লাহর উপর ভরসা করা।
১৪. চিন্তা-ভাবনা করে কথা বলা, কম কথা বলা ও কৃত্রিমতা পরিহার করা।
১৫. ভাষা সহজ সরল, যুক্তি ভিত্তিক ও সুন্দর হওয়া। যেমন- মূসা (আঃ) এর দোয়া।
১৬. দায়ীর কথা ইতিবাচক হবে; নেতিবাচক নয়।
১৭. কারো বিরুদ্ধে কথা না বলা।
১৮. মন-মানসিকতা ও পরিবেশ-পরিস্থিতি বুঝে কথা বলা।
১৯. তাড়া-হুড়ো পরিহার করা।

দাওয়াত উপস্থাপনের ও সম্প্রসারণের ক্ষেত্রে আমাদের করণীয়ঃ
* চ্যালেঞ্জ তিন ধরনেরঃ
1. Fighting challenge
2. Technical challenge
3. Intellectual challenge

* নিজেদের প্রচার করার ক্ষেত্রে “প্রান্তিক ” শব্দ পরিহার করা।
* দাওয়াতী কাজের ক্ষেত্রে Extreme word ব্যবহার না করা।
* কোন মানুষকেই স্থায়ী শত্রু মনে না করা।
* কোন মানুষকে হেয় প্রতিপন্ন না করা।
* দাওয়াতী কাজে কৃত্রিমতা পরিহার করা।
* মানুষের ইতিবাচক দিকের প্রসংশা করা।
* কাজের এখনই সময়, এইতো করছি/করবো এধরনের মানসিকতা পরিহার করা।
লক্ষ্য ঠিক করার জন্য SMART টেকনিক ব্যবহার করা যেতে পারে। এখানে তার ব্যাখ্যা দেয়া হল:
S = Specific বা সুনির্দিষ্ট
M = Measurable বা পরিমাপযোগ্য
A = Achievable বা অর্জনযোগ্য
R = Realistic বা বাস্তবধর্মী
T = Timeframe বা সময়কাঠামো
সাফল্যের জন্য আরো যা জানতে হবে:
SEE Factors
S = Smile বা হাস্যময়
E = Eye Contact বা মনযোগ
E = Enthusiasm বা উদ্যোগ
আরও ৮টি নির্দেশনা হল :
১)ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি ২) ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি বজায় রাখা ৩)সময়ানুবর্তী হওয়া ৪) প্রস্তুত থাকা ৪) নিজের লক্ষ্য সম্পর্কে সচেতন থাকা ৫) নিয়ন্ত্রণে রাখা ৬) সঠিকভাবে কাজ করা ৭) পরিপূর্ণভাবে কাজ সম্পন্ন করা

আমরা দাওয়াত কিভাবে দিব/ দাওয়াত দানের কৌশল
১.বিনয়ের মাধ্যমে দাওয়াত
اذْهَبَاإِلَىفِرْعَوْنَإِنَّهُطَغَى (৪৩) فَقُولَالَهُقَوْلًالَيِّنًالَعَلَّهُيَتَذَكَّرُأَوْيَخْشَى (৪৪)
অর্থাৎ : আপনারা দুইজন ফিরআউনের কাছে যান। নিশ্চয় সে বিদ্রোহী হয়ে গিয়েছে। তার সাথে নম্রভাবে কথা বলবেন। হয়তো সে উপদেশ কবুল করবে অথবা ভয় পাবে। সূরা ত্বাহা: আয়াত-৪৩-৪৪
২.বুদ্ধিমত্তার মাধ্যমে দাওয়াত
ادْعُ إِلِى سَبِيلِ رَبِّكَ بِالْحِكْمَةِ وَالْمَوْعِظَةِ الْحَسَنَةِ وَجَادِلْهُم بِالَّتِي هِيَ أَحْسَنُ إِنَّ رَبَّكَ هُوَ أَعْلَمُ بِمَن ضَلَّ عَن سَبِيلِهِ وَهُوَ أَعْلَمُ بِالْمُهْتَدِينَ
অর্থাৎ : আপনি পালনকর্তার পথের দিকে আহবান করুন জ্ঞানের কথা বুঝিয়ে ও শুনিয়ে উত্তম রুপে এবং তাদের সাথে বিতর্ক করুন পছন্দ যুক্ত পন্থায়। নিশ্চয় আপনার পালন কর্তাই ঐ ব্যক্তি সম্পর্কে বিশেষ ভাবে জ্ঞাত রয়েছেন, যে তার পথ থেকে বিচ্যুতি হয়ে পড়েছে এবং তিনিই ভাল জানেন তাদেরকে যারা সঠিক পথে আছে। সূরা নাহল আয়াত ১২৫
৩.মন্দের মোকাবেলায় ভাল দিয়ে দাওয়াত
وَلَا تَسْتَوِي الْحَسَنَةُ وَلَا السَّيِّئَةُ ادْفَعْ بِالَّتِي هِيَ أَحْسَنُ فَإِذَا الَّذِي بَيْنَكَ وَبَيْنَهُ عَدَاوَةٌ كَأَنَّهُ وَلِيٌّ حَمِيمٌ
অর্থাৎ ভাল ও মন্দ সমান নয়। জওয়াবে তাই বলুন যা উৎকৃষ্ট। তখন দেখবেন আপনার সাথে যে ব্যক্তির শত্রুতা রয়েছে, সে যেন অন্তরঙ্গ বন্ধু। সূরা হামিম সিজদাহ আয়াত- ৩৪

দাওয়াত দানকারীর যা লক্ষণীয়ঃ
১. মর্যাদাবান ব্যক্তির মর্যাদার দিকে লক্ষ্য রেখে দাওয়াত দান
اذْهَبَا إِلَىٰ فِرْعَوْنَ إِنَّهُ طَغَىٰ ০ فَقُولَا لَهُ قَوْلًا لَّيِّنًا لَّعَلَّهُ يَتَذَكَّرُ أَوْ يَخْشَىٰ০ “ তোমরা ফেরাউনের কাছে যাও, কেননা সে সীমা লংঘন কারী হয়ে গেছে। তার সাথে নম্রভাবে কথা বলবে; সম্ভবতঃ সে উপদেশ গ্রহণ করবে কিংবা ভয় পেয়ে যাবে।” (ত্বাহা- ৪৩,৪৪)
২. মন-মেজাজ লক্ষ্য করে পর্যায়ক্রমে পদক্ষেপ গ্রহণ
৩. প্রতিবাদী পরিবেশে নয়, অনুকুল পরিবেশে দাওয়াত দান
وَإِذَا رَأَيْتَ الَّذِينَ يَخُوضُونَ فِي آيَاتِنَا فَأَعْرِضْ عَنْهُمْ حَتَّىٰ يَخُوضُوا فِي حَدِيثٍ غَيْرِهِ ۚ َ
“তুমি যখন দেখবে যে, লোকেরা আমার আয়াত সমুহের দোষ সন্ধান করতেছে তখন তাদের নিকট হতে সরে যাও যতক্ষণ না তারা এ প্রসংগের কথা-বার্তা বন্ধ করে অপর কোন কাজে মগ্ন হয়।” (সুরা আন‘আম- ৬৮)
৪. অন্যমনস্ক ব্যক্তির কাছে দাওয়াত না দেয়া
৫. যুক্তি প্রমাণ পেশ করার সময় ব্যক্তির যোগ্যতার দিকে খেয়াল রাখা

দাওয়াতে দ্বীনের পদ্ধতিঃ
১. জ্ঞান-বিজ্ঞানের উন্নতির সাথে দাওয়াতের পদ্ধতির উন্নতি করা ঃ
اقْرَأْ و َرَبُّكَ الْأَكْرَمُ ০ الَّذِي عَلَّمَ بِالْقَلَمِ০ عَلَّمَ الْإِنسَانَ مَا لَمْ يَعْلَمْ ০
“পড়, তোমার রব বড়ই অনুগ্রহশীল। যিনি কলমের সাহায্যে জ্ঞান শিক্ষা দিয়েছেন। মানুষকে এমন জ্ঞান শিক্ষা দিয়েছেন যা সে জানতো না।” (সুরা আলাক- ৩,৪,৫)
২. নিম্নলিখিত পন্থাগুলি অবলম্বন করার মাধ্যমে দাওয়াতঃ
১. সাধারণ দাওয়াত ২. চিঠি-পত্রের মাধ্যমে দাওয়াত ৩. বই পড়ানোর মাধ্যমে দাওয়াত ৪. সমস্যার সমাধান দেখিয়ে দাওয়াত ৫. মিডিয়ার মাধ্যমে দাওয়াত (প্রিন্টিং ও ইলেক্ট্রনিক্স) ৬. ‘ইন্টারনেট’, ‘ফেসবুক’ ইত্যাদির মাধ্যমে দাওয়াত ৭. আল্লাহর ক্ষমতা মাহাত্ম্য প্রমাণের মাধ্যমে দাওয়াত
৩. সামাজিক কাজে অংশ গ্রহণের মাধ্যমে দাওয়াতঃ
৪. মর্যাদার পরিপন্থি পদ্ধতি পরিত্যাগের মাধ্যমে দাওয়াতঃ
১. আত্ম-মর্যাদা রক্ষা করা ২. ইসলামকে হেয় না করা ৩. শরিয়তের পরিপন্থি কাজ না করা ৪. ব্যক্তির ইচ্ছার বিরুদ্ধে কাজ না করা ৫. পরিবেশ পরিস্থিতি বোঝা
৫. জনগণের ভাষায় দাওয়াত দান করাঃ
وَمَا أَرْسَلْنَا مِن رَّسُولٍ إِلَّا بِلِسَانِ قَوْمِهِ لِيُبَيِّنَ لَهُمْ ۖ فَيُضِلُّ اللَّهُ مَن يَشَاءُ وَيَهْدِي مَن يَشَاءُ ۚ وَهُوَ الْعَزِيزُ الْحَكِيمُ ০
“এবং আমরা যখন যেখানেই কোন রাসুল প্রেরণ করেছি, তিনি তার জাতির জনগণের ভাষায়ই সে পয়গাম পৌঁছিয়েছেন, যেন তিনি তাদেরকে খুব ভালো ভাবেই কথা প্রকাশ করে বলতে পারেন, অতঃপর আল্লাহ যাকে চান গোমরাহ করেন আর যাকে চান হেদায়াত দান করেন, তিনি মহা পরাক্রমশালী ও কৌশলী।” (সুরা ইবরাহীম- ৪)
৬. সহজভাবে দাওয়াত প্রদানঃ
عَنْ اَنَسٍ (رض) قَالَ قَالَ رَسُوْلُ اللَّه ِ (ص) يَسِّرُوْا وَ لَا تُعَسِّرُوْا وَ بَشِّرُوْا وَ لَا تُنَفَّرُوْا
“হযরত আনাস (রাঃ) থেকে বর্নিত। তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ (সঃ) বলেছেন, তোমরা (দ্বীনের দাওয়াত) সহজ করো, কঠিন করো না। সুসংবাদ দাও, বীতশ্রদ্ধ করো না।” (বুখারী ও মুসলিম)
৭. উদ্দেশ্যের পরিপন্থি পদ্ধতি পরিত্যাগ করাঃ
১. বাড়াবাড়ি ২. অহেতুক তর্ক -বিতর্ক ৩. ফতোয়াবাজী

ইতিহাসের পাতায় দাওয়াত গ্রহণের ভিন্ন ভিন্ন উপায়/কৌশলের দৃষ্টান্ত:
১. খাদিজাতুল কুবরার (রা.) প্রথম দাওয়াত গ্রহণকারীনী : তাকে তো আনুষ্ঠানিক দাওয়াত দিতে হয়ই নাই, বরং তিনি ভীত সন্ত্রস্ত নবীকে সান্তনা প্রদান করেন এবং ওয়ারাকা বিন নওফেলের কাছে নিয়ে যান।
২. হযরত আবু বকর (রা:) এর ইসলাম গ্রহণ: নবীর চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য
৩. হযরত উমর ফারুক (রা:) এর ইসলাম গ্রহণ : যখন তিনি ছিলেন বোন ও ভগ্নিপতিকে আঘাতকারী।
৪. হযরত আমীর হামযা (রা:) এর ইসলাম গ্রহণ: যখন তিনি বংশীয় অহমিকায় খোঁচা খান।
৫. হযরত আলী (রা:) বনাম ইয়াহুদী: যখন ইয়াহুদীটি ছিল যুদ্ধে পরাভূত হয়ে মৃত্যুর মুখোমুখী ।
৬. বাদশাহ নাজ্জাশী : একজন আশ্রয় প্রার্থী জাফর ইবনে আবু তালিবের (রা:) সত্য বক্তব্যে প্রভাবিত হয়ে বাদশাহ থাকা অবস্থায় ইসলাম গ্রহণ করেন।
৭. হযরত বেলাল ও হযরত খাব্বাব (রা:) : গোলাম থাকা অবস্থায় ইসলাম গ্রহণ করেন।
৮. হযরত আবু সুফিয়ান : বিজয়ের পর ইসলাম গ্রহণ করেন।
৯. Armstrong মুসলিম হন- চাঁদের ফাটল দেখে
১০. ড. ইসলামূল হক- তুলনামূলক ধর্মচর্চা করতে গিয়ে
১১. ড. মরিস বুকাইলী – কুরআনের ত্রুটি খুঁজতে গিয়ে
১২. মোহা: আলী ক্লে- ইসলামে সাম্যতা দেখে
১৩. মরিয়ম জামিলা- পত্রের মাধ্যমে প্রশ্নোত্তরে
১৪. গায়ক Ket Stiven ও ক্রিকেটার ইউসুফ ইউহানা- বন্ধুদের সান্নিধ্যে

দাওয়াত গ্রহণকারীর মন জয় করার ৬টি বিশেষ পদ্ধতি:
১. দাওয়াত গ্রহণকারীর সামনে নিজেকে আকর্ষণীয় করে তুলুন বা ভালভাবে উপস্থাপন করুন।
২. মানুষের নাম তার নিজের কাছে সবচেয়ে প্রিয়। তাই যথাসম্ভব মানুষের নাম মনে রাখার চেষ্টা করুন।
৩. আপনি যাকে দাওয়াত দিবেন তাকে গুরুত্ব দিন ও এটা মন থেকেই করুন।
৪. দাওয়াত গ্রহণকারী যে বিষয়ে কথা বলতে আগ্রহী, সে বিষয়ে আলোচনা করুন।
৫. ভাল শ্রোতা হন, দাওয়াত গ্রহণ কারীকে কথা বলতে দিন।
৬. বিজয়ী তিনিই যিনি কখনও হাল ছাড়েন না।

সফল দাওয়াত দান কারীর ব্যক্তিত্ব গঠনের কৌশল:
১. সুন্দরভাবে কথা বলা।
২. নিষ্ঠার সঙ্গে কাজ করা।
৩. বিশ্বাসী হতে হবে।
৪. দাওয়াত দানকারীর মুলধন কঠোর পরিশ্রম।
৫. সহিষ্ণু হতে হবে সহিষ্ণু ব্যক্তিরাই শেষ পযর্ন্ত টিকে থাকে, tough time does not last but only tough people do. .
৬. সময়ানুবর্তিতা

দাওয়াতী কাজে সফল হওয়ার নয়টি বিশেষ কৌশল:
১. লক্ষ্য নির্ধারণ করুন। যে জানে তার জীবনের লক্ষ্য-পৃথিবী তাকে সেখানে পৌঁছানোর পথ তৈরী করে দেয়।
২. লক্ষ্য অর্জনে সদা সচেষ্ট থাকুন।
৩. কৌশলী হন; কারণ যোগ্যতম ব্যক্তিরাই শেষ পযর্ন্ত টিকে থাকে।
৪. কোন কিছুই অসম্ভব নয়, যদি আপনি মনে করেন পারবেন, নিশ্চয়ই পারবেন।
৫. চিন্তা করুন, অবশ্যই ভালো উপায় খুঁজে পাবেন।
৬. আগে দর্শনধারী, পরে গুণবিচারী, আচার ও আচরণ যেন ইতিবাচক হয়।
৭. সবসময় হাসুন, তাহলে সমগ্র পৃথিবী আপনাকে দেখে হাসবে।
৮. সৃজনশীল ও উদ্যমী হোন।
৯. অন্যকে ভালবাসুন, আপনিও ভালবাসা পাবেন।
দাওয়াতী কাজে কার্যকরী যোগাযোগ ব্যবস্থাপনা:
১. কখনোই আশা করবেন না যে, দাওয়াত গ্রহণকারী আপনার কাছে এসে ধরণা দিবে।
২. ভাববেন না প্রথম সাক্ষাতেই দাওয়াত গ্রহণ করে ফেলবে।
৩. সুসংগঠিতভাবে নিয়মিত ফলোআপ করুন।
৪. প্রতি সপ্তাহে নতুন কিছু মানুষের সঙ্গে পরিচিত হওয়ার চেষ্টা করুন।
৫. যাদের সাথে পরিচিত হচ্ছেন, তাদের সাথে যোগাযোগ রক্ষার দায়িত্ব আপনারই।
৬. মনে রাখবেন, কিছু পেতে হলে, কিছু দিতে হবে। কেননা দিন আপনার আমার সবার জন্যই ২৪ ঘন্টা। শুধু লক্ষ্য রাখবেন, ত্যাগের চাইতে প্রাপ্তি যেন সবসময় ভারি থাকে।

জীবনে চলার পথে ধ্রুব সত্যঃ
স্বার্থবাদী এক অক্ষর বিশিষ্ট শব্দ I এড়িয়ে চলুন
সন্তোষজনক দুই শব্দ We সর্বদা ব্যবহার করুন
তিন অক্ষর বিশিষ্ট দূষিত শব্দ Ego ধ্বংস করুন
বহুল ব্যবহৃত চার অক্ষর বিশিষ্ট শব্দ Love মুল্যায়ন করুন
আনন্দদায়ক পাঁচ অক্ষর বিশিষ্ট শব্দ Smile সর্বদা ধারণ করুন
দ্রুতবেগে ছড়ানো ছয় অক্ষর বিশিষ্ট শব্দ Rumour অবজ্ঞা করুন
শ্রমসাধ্য সাত অক্ষর বিশিষ্ট শব্দ Succes অর্জন করুন
ঈর্ষা উদ্রেককারী আট অক্ষর বিশিষ্ট শব্দ Jealousy দূরে থাকুন
সবচেয়ে শক্তিশালী নয় অক্ষর বিশিষ্ট শব্দ Knowledge অধিকার করুন
সবচেয়ে দরকারী দশ অক্ষর বিশিষ্ট শব্দ Confidence বিশ্বাস করুন

দাওয়াতী কাজ সহজ কাজ নয় বা দাওয়াত হল যুদ্ধ ক্ষেত্র, এখানে যে যত বেশি কৌশলী হবেন, তিনি তত সফলকাম হবেন। এক বালতি পানি পাহাড়ের উপর থেকে নিচে ফেলে দেওয়া সহজ কিন্তু এক বালতি পানি পাহাড়ের উপর উঠান সহজ কাজ নয়।
দাওয়াতী কাজে বাধা আসবেঃ
(ক) রাষ্ট্র, সমাজ, পরিবার এবং নিজের নফস এর পক্ষ থেকে বাধা আসবে।
(খ) জীবন, স্বাস্থ্য ও সম্পদ ইত্যাদি ক্ষতিগ্রস্থ হবে।
(গ) কখনো কখনো অপ্রাপ্তি কাংখিত ফলাফল না পাওয়া অধৈর্যের কারণ হতে পারে।
– অসৎ কাজের পরিবেশ তৈরী করে তা করতে বাধ্য করে (সংস্কৃতি)।
– সৎ জীবন যাপনের প্রতি অনিহা ও নিুমান বোধ সৃষ্টির চেষ্টা করে।

সুতরাং আগামী দিনে ইসলামী বিপ্লবকে ত্বরান্বিত করতে হলে মানুষের মেজাজ বুঝে দাওয়াতী কাজ করতে হবে এবং বুদ্ধিবৃত্তিক অনেক ক্ষেত্র তৈরী করতে হবে।

Dunia is a class room
Quran is a syllabus
Muhammad (sm) is a teacher
Life is an exam
Allah is an examiner
So try to pass the exam……..

লেখক: কেন্দ্রীয় সভাপতি,
বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির

অগ্নি পরীক্ষার পরেই আসে আল্লাহর পুরস্কার" -এ কে এম নাজির আহমদ

আমাদের বাংলাদেশ নিউজ ডেস্কঃ পবিত্র কোরআনে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন ঘোষণা করেন-
১৫৩.‘ওহে তোমরা যারা ঈমান এনেছো, সবর ও সালাতের মাধ্যমে সাহায্য চাও। নিশ্চয়ই আল্লাহ সবর অবলম্বনকারীদের সঙ্গে আছেন।
১৫৪. আর যারা আল্লাহর পথে নিহত হয়, তাদেরকে তোমরা ‘মৃত’ বলো না। তারা তো আসলে জীবিত। কিন্তু তোমরা তা অনুধাবন করতে পার না।
১৫৫. এবং আমি অবশ্যই তোমাদেরকে ভীতিপ্রদ পরিস্থিতি, ক্ষুধা-অনাহার এবং অর্থ-সম্পদ, জান ও আয়-উপার্জনের লোকসান ঘটিয়ে পরীক্ষা করবো। এমতাবস্থায় যারা সবর অবলম্বন করবে, তাদেরকে সুসংবাদ দাও।’
আয়াত সমূহের ব্যাখ্যাঃ
১৫৩ নাম্বার আয়াত-
“ওহে তোমরা যারা ঈমান এনেছো, সবর ও সালাতের মাধ্যমে সাহায্য চাও। অবশ্যই আল্লাহ সবর অবলম্বনকারীদের সঙ্গে আছেন।”

মাদীনা রাষ্ট্রে উত্তরণের মাধ্যমে আল্লাহ রাব্বুল ‘আলামিন মুমিনদেরকে নেতৃত্বের আসনে বসিয়ে দেন। এর মাধ্যমে তাঁদেরকে যে বিরাট রকমের ঝুঁকির মধ্যে ফেলে দেয়া হয়েছে ইংগিতে সেই কথা তাঁদেরকে জানিয়ে দেন। সমাজ-সভ্যতার ইসলাহ করতে অগ্রসর হলে তাঁদেরকে যে বড়ো রকমের প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হতে হবে সেই কথা তাঁদেরকে জানিয়ে দেন।
আর এই চ্যালেঞ্জ মোকাবেলার জন্য তাঁদেরকে সবর ও সালাতের মাধ্যমে সাহায্য চাওয়ার আহ্বান জানান।
সবর অতীব গুরুত্বপূর্ণ একটি গুণ। মুমিনদেরকে এই গুণে গুণান্বিত হওয়ার জন্য আল্লাহ রাব্বুল ‘আলামিন বারবার তাকিদ করেছেন। আল হাদিসেও এই বিষয়ে তাকিদ রয়েছে।

সবরের যে সকল অর্থ রয়েছে--
১. রোগ-ব্যাধির কষ্ট বরদাশত করার নাম সবর।
২. দুঃখ-বেদনায় ভেঙে না পড়ার নাম সবর।
৩. অনভিপ্রেত কথা ও আচরণে উত্তেজিত না হওয়ার নাম সবর।
৪. পাপের পথে গিয়ে লাভবান হওয়ার চেয়ে পুণ্যের পথে থেকে তিক্ততাকে মেনে নেয়ার নাম সবর।
৫. মিথ্যা প্রচারণার মুখে অবিচলিত থাকার নাম সবর।
৬. ভীতিপ্রদ পরিস্থিতিতেও সঠিক পথে দৃঢ়পদ থাকার নাম সবর।
৭. কল্যাণ হাসিলের জন্য দুঃখ-কষ্ট সহ্য করার নাম সবর।
৮. কল্যাণ অর্জন বিলম্বিত হচ্ছে দেখে হতাশ বা নিরাশ না হওয়ার নাম সবর।
৯. বিরোধিতার বীরোচিত মোকাবেলার নাম সবর। ইত্যাদি।
সূরা আল মুদ্দাস্সিরের দ্বিতীয় ও তৃতীয় আয়াতে মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহকে (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) নবী হিসেবে তাঁর কর্তব্য কী তা জানিয়ে দেয়া হয়েছে। ময়দানে তিনি তখনো নামেননি। কিন্তু আল্লাহ রাব্বুল ‘আলামিন এই সূরারই সপ্তম আয়াতে এই কথাও তাঁকে অগ্রিম জানিয়ে দিলেন যে এই কর্তব্য পালন করতে গেলে তাঁকে বিরোধিতার সম্মুখীন হতে হবে। সেই অবস্থার সম্মুখীন হয়ে তাঁকে কর্তব্য কর্মে দৃঢ়পদ থাকতে হবে।
وَلِرَبِّكَ فَاصْبِرْ ০
(এবং তোমার রবের খাতিরে সবর অবলম্বন কর।)
সবর অবলম্বনের তাকিদ দিয়ে সূরা আল মুয্যাম্মিলের ১০ নাম্বার আয়াতে আল্লাহ রাব্বুল ‘আলামিন বলেন,
وَاصْبِرْ عَلى مَا يَقُولُوْنَ وَاهْجُرْهُمْ هَجْرًا جَمِيْلاً ০
‘ওরা যেইসব কথা বলে বেড়াচ্ছে তার মোকাবেলায় সবর অবলম্বন কর এবং ভদ্রভাবে তাদেরকে এড়িয়ে চল।’
সূরা আল মা‘আরিজের ৫ নাম্বার আয়াতে আল্লাহ রাব্বুল ‘আলামিন বলেন,
فَاصْبِرْ صَبْرًا جَمِيْلاً ০
‘অতএব তুমি সবর অবলম্বন কর, সুন্দর সবর।’
সূরা ইউনুসের ১০৯ নম্বর আয়াতে আল্লাহ রাব্বুল ‘আলামিন বলেন,
وَاتَّبِعْ مَا يُوْحى إِلَيْكَ وَاصْبِرْ حَتّى يَحْكُمَ اللهُ ج وَهُوَ خَيْرُ الْحَاكِمِيْنَ০
‘এবং তোমার প্রতি যা ওহি করা হয় তা মেনে চল এবং আল্লাহ ফায়সালা না করে দেয়া পর্যন্ত সবর অবলম্বন কর। আর তিনিই তো সর্বোত্তম ফায়সালাকারী।’
একই রূপ তাকিদ দিয়ে সূরা তা-হা-এর ১৩০ নম্বর আয়াতে আল্লাহ রাব্বুল ‘আলামিন বলেন,
‘অতএব ওরা যা কিছু বলে বেড়াচ্ছে তার মোকাবেলায় তুমি সবর অবলম্বন কর, আর সূর্যোদয়ের পূর্বে ও সূর্যাস্তের পূর্বে তোমার রবের প্রশংসাসহ তাসবিহ কর, রাতের বেলায়ও তাসবিহ কর এবং দিনের প্রান্তে। আশা করা যায় তুমি খুশি হবে।

সূরা আল আহকাফের ৩৫ নম্বর আয়াতে আল্লাহ রাব্বুল ‘আলামিন বলেন,
فَاصْبِرْ كَمَا صَبَرَ أُوْلُوْا الْعَزْمِ مِنَ الرُّسُلِ وَلاَ تَسْتَعْجِلْ لَّهُمْ ০
এ হচ্ছে সবর অবলম্বনের তাকিদ সংবলিত বহুসংখ্যক আয়াতের মাত্র কয়েকটি।
মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেন, “সবরের চেয়ে উত্তম ও প্রশস্ত আর কিছু কাউকে দেয়া হয়নি।” (আবু সায়িদ আল খুদরী (রা) সাহীহ মুসলিম, সহীহ আল বুখারী।)

সূরা আয্যুমারের ১০ নম্বর আয়াতে সবর অবলম্বনকারীদের প্রতিদান সম্পর্কে আল্লাহ রাব্বুল ‘আলামিন বলেন, “সবর অবলম্বনকারীদেরকে অগণিত পুরস্কার পূর্ণভাবে দেয়া হবে।” এই আয়াতের শেষাংশে-
اِنَّ اللهَ مَعَ الصَّابِرِيْنَِ ০
কথাটি জুড়ে দিয়ে আল্লাহ রাব্বুল ‘আলামিন সবর নামক গুণটির মাহাত্ম্য তুলে ধরেছেন। অন্য দিকে এই বাক্যাংশের মাধ্যমে তিনি মুমিনদের মনে নিশ্চিন্ততার আমেজ সৃষ্টি করেছেন।

আরেকটি অতীব গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে সালাত। এটি এমন এক প্রক্রিয়া যার অনুশীলন মুমিনদের মাঝে অনুপম নৈতিক শক্তি সৃষ্টি করে। সেই জন্য মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহকে (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) নবুওয়াত প্রদানের সঙ্গে সঙ্গেই জিবরিল (আ) কে পাঠিয়ে আল্লাহ রাব্বুল ‘আলামিন তাঁকে সালাত আদায়ের পদ্ধতি শিখিয়ে দেন। মাক্কী ও মাদানী যুগে নাজিলকৃত বহু আয়াতে আল্লাহ রাব্বুল ‘আলামিন সালাতের তাকিদ দিয়েছেন। আলোচ্য আয়াতটিতেও আমরা একই রূপ তাকিদ দেখতে পাই।
১৫৪ নম্বর আয়াতঃ
“আর যারা আল্লাহর পথে নিহত হয়, তাদেরকে তোমরা ‘মৃত’ বলো না। তারা তো আসলে জীবিত। কিন্তু তোমরা তা অনুধাবন করতে পার না।”
আল্লাহর পথে নিহত হওয়াকে ইসলামী পরিভাষায় শাহাদাত বলা হয়। যিনি আল্লাহর পথে নিহত হন, তাঁকে বলা হয় শহীদ।

শাহাদাতবরণ মৃত্যু বটে, কিন্তু অসাধারণ মৃত্যু, মহিমান্বিত মৃত্যু। সেই জন্য আল্লাহ রাব্বুল ‘আলামিন শহীদদেরকে ‘মৃত’ বলে আখ্যায়িত করতে নিষেধ করেছেন।
সূরা আলে ইমরানের ১৬৯ থেকে ১৭১ নম্বর আয়াতে আল্লাহ রাব্বুল ‘আলামিন শহীদদের অবস্থা বর্ণনা করতে গিয়ে বলেন, “যারা আল্লাহর পথে নিহত হয়েছে তাদেরকে তোমরা মৃত মনে করো না। বরং তারা জীবিত। তাদের রবের কাছ থেকে তারা রিজিক পাচ্ছে। আল্লাহ তাদেরকে তাঁর অনুগ্রহ থেকে যা কিছু দিয়েছেন, তাতে তারা খুশি ও তৃপ্ত। আর তারা এই বিষয়েও নিশ্চিত, যেই সব মুমিন তাদের পেছনে এখনো দুনিয়ায় রয়ে গেছে, তাদের জন্য কোন ভয় ও দুঃখের কারণ নেই। তারা আল্লাহর নিয়ামত ও অনুগ্রহ লাভ করে আনন্দিত এবং তারা জানতে পেরেছে, অবশ্যই আল্লাহ মুমিনদের পুরস্কার নষ্ট করেন না।”
শহীদের মর্যাদা সম্পর্কে মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেন, “জান্নাতে প্রবেশ করার পর দুনিয়ার সমস্ত সামগ্রী তার জন্য নির্ধারিত হলেও কোন ব্যক্তি পৃথিবীতে ফিরে আসতে চাইবে না। কিন্তু শহীদ এর ব্যতিক্রম। তাকে যেই মর্যাদা দেয়া হবে তা দেখে সে দশবার পৃথিবীতে এসে শহীদ হওয়ার আকাঙ্কা ব্যক্ত করবে।”
শাহাদাত লাভের পর পরই যাঁরা আল্লাহ রাব্বুল ‘আলামিনের সান্নিধ্যে এমনভাবে সমাদৃত হন, তাঁদেরকে ‘মৃত’ বলা আসলেই শোভনীয় নয়।

১৫৫ নম্বর আয়াতঃ
“এবং আমি অবশ্যই ভীতিপ্রদ পরিস্থিতি, ক্ষুধা-অনাহার এবং অর্থ-সম্পদ, জান ও আয়-উপার্জনের লোকসান ঘটিয়ে তোমাদেরকে পরীক্ষা করবো। এমতাবস্থায় যারা সবর অবলম্বন করবে, তাদেরকে সুসংবাদ দাও।”

এই আয়াতে আল্লাহ রাব্বুল ‘আলামিন তাঁর একটি শাশ্বত বিধানের কথা মুমিনদেরকে স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন। আর সেটি হচ্ছে : যাঁরা আল্লাহ রাব্বুল ‘আলামিনের প্রতি নিখাদ ঈমান আনার ঘোষণা দেবেন, তাঁদেরকে তিনি অবশ্যই পরীাক্ষার সম্মুখীন করবেন।
সূরা আল ‘আনকাবুতের ২ ও ৩ নম্বর আয়াতে আল্লাহ রাব্বুল ‘আলামিন বলেন,
اَحَسِبَ النَّاسُ اَنْ يُّتْرَكُوْآ اَنْ يَّقُوْلُوْآ امَنَّا وَهُمْ لاَ يُفْتَنُوْنَ ০ وَلَقَدْ فَتَنَّا الَّذِيْنَ مِنْ قَبْلِهِمْ فَلَيَعْلَمَنَّ اللهُ الَّذِيْنَ صَدَقُوْا وَلَيَعْلَمَنَّ الْكَاذِبِيْنَ০
‘লোকেরা কি মনে করেছে যে ‘আমরা ঈমান এনেছি’ এই কথা বললেই তাদেরকে ছেড়ে দেয়া হবে এবং তাদেরকে পরীাক্ষা করা হবে না? অথচ তাদের পূর্ববর্তীদেরকে আমি পরীাক্ষা করেছি। আল্লাহকে তো জানতে হবে- ঈমানের দাবিতে কারা সত্যবাদী আর কারা মিথ্যাবাদী।’

পরবর্তীকালে অবতীর্ণ সূরা মুহাম্মাদের ৩১ নম্বর আয়াতে আল্লাহ রাব্বুল ‘আলামিন বলেন, “আমি অবশ্যই তোমাদেরকে পরীাক্ষা করবো যাতে আমি জেনে নিতে পারি তোমাদের মধ্যে কারা ‘মুজাহিদীন’ এবং কারা ‘সাবেরিন’।”
সূরা আলে ইমরানের ১৪২ নম্বর আয়াতে আল্লাহ রাব্বুল ‘আলামিন বলেন, “তোমরা কি ভেবেছো এমনিতেই জান্নাতে চলে যাবে, অথচ আল্লাহ এখনো দেখেননি তোমাদের মধ্য থেকে কারা জিহাদ করে এবং কারা সবর অবলম্বনকারী?”
সূরা আত্ তাওবা-র ১৬ নম্বর আয়াতে আল্লাহ রাব্বুল ‘আলামিন বলেন,
اَمْ حَسِبْتُمْ اَنْ تُتْرَكُوْا وَلَمَّا يَعْلَمَ اللهُ الَّذِيْنَ جهَدُوْا مِِنْكُمْ وَلَمْ يَتَّخِذُوْا مِنْ دُوْنِ اللهِ وَلاَ رَسُوْلِه وَلاَ الْمُؤْمِنِيْنَ وَلِيْجَةٌ ج وَاللهُ خَبِِيْرٌم بِمَا تَعْمَلُوْنَ ০
‘তোমরা কি ভেবেছো যে তোমাদেরকে এমনিতেই ছেড়ে দেয়া হবে অথচ আল্লাহ এখনো দেখেননি যে তোমাদের মধ্য থেকে কারা জিহাদে নিবেদিত হয় এবং আল্লাহ, তাঁর রাসূল ও মুমিনদেরকে ছাড়া আর কাউকে বন্ধুরূপে গ্রহণ করেন না। আর তোমরা যা কিছু কর সেই সম্পর্কে আল্লাহ খবর রাখেন।’

সূরা আল বাকারার ২১৪ নাম্বার আয়াতে আল্লাহ রাব্বুল ‘আলামিন বলেন, “তোমরা কি ভেবেছো যে এমনিতেই তোমরা জান্নাতে প্রবেশ করবে, অথচ এখনো তোমাদের ঐরূপ অবস্থা আসেনি যেমনটি এসেছিলো তোমাদের পূর্ববর্তীদের ওপর।”
তাদের ওপর কঠিন অবস্থা আপতিত হয়েছে, মুসিবত এসেছে এবং তাদেরকে কাঁপিয়ে দেয়া হয়েছে যেই পর্যন্ত না রাসূল ও তাঁর সঙ্গীরা বলে উঠেছে, ‘কখন আসবে আল্লাহর সাহায্য!’ তখন তাদেরকে বলা হয়েছে, ‘ওহে, আল্লাহর সাহায্য অতি নিকটেই।’
সূরা আলে ইমরানের ১৪৬ নম্বর আয়াতে আল্লাহ রাব্বুল ‘আলামিন বলেন, “কত নবী গত হয়ে গেছে যারা লড়াই করেছে, তাদের সাথে মিলে লড়াই করেছে বহু আল্লাহওয়ালা লোক। আল্লাহর পথে যতো মুসিবাতই তাদের ওপর আপতিত হয়েছে তারা হতাশ হয়নি, দুর্বলতা দেখায়নি এবং বাতিলের নিকট মাথা নত করেনি। এমন সবর অবলম্বনকারীদেরকেই আল্লাহ ভালোবাসেন।”
ঈমানের দাবি হচ্ছে, আল্লাহর জমিনে আল্লাহর দীন প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে নিবেদিত হওয়া এবং এই সংগ্রাম চালাতে গিয়ে যত প্রকারের বাধাই আসুক না কেন তার মোকাবেলায় দৃঢ়পদ থাকা।
এই সংগ্রাম চালাতে গিয়ে মুমিনদেরকে অনিবার্যভাবে ভীতিপ্রদ পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হবে, কখনো কখনো অবস্থা এমন সঙ্গিন হতে পারে যে অনাহারে থাকতে হবে, কখনো কখনো বাগ-বাগিচা, ব্যবসায়-প্রতিষ্ঠান, ঘরদোরের ওপর হামলা হতে পারে, কখনো কখনো ইসলাম বিদ্বেষীদের হাতে আপনজন ও সহকর্মীদের কেউ কেউ প্রাণ হারাতে পারেন এবং কখনো কখনো আয়-উপার্জনের পথ বন্ধ হয়ে যেতে পারে।
এমন সব কঠিন পরিস্থিতিতেও যাঁরা সবর অবলম্বন করতে পারবেন, তাঁদেরকে সুসংবাদ দেয়ার জন্য আল্লাহ রাব্বুল ‘আলামিন মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহকে (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) নির্দেশ দিয়েছেন।
আয়াতে কারীমাগুলোর শিক্ষাঃ
১.সমাজ ও সভ্যতার ইসলাহ বা পরিশুদ্ধি করতে গেলে মুমিনদেরকে অবশ্যই বাধা-বিপত্তির সম্মুখীন হতে হবে।
২.এমতাবস্থায় তাঁদেরকে সবর ও সালাতের মাধ্যমে আল্লাহর সাহায্য চাইতে থাকতে হবে।
৩.আল্লাহর পথে যাঁরা শহীদ হন তাঁদেরকে ‘মৃত’ বলে আখ্যায়িত করা যাবে না।
৪.আল্লাহ রাব্বুল ‘আলামিন ভীতিপ্রদ পরিস্থিতি, ক্ষুধা-অনাহার এবং অর্থ-সম্পদ, জান ও আয়-উপার্জনের লোকসান ঘটিয়ে মুমিনদেরকে পরীাক্ষা করবেন।
৫.যাঁরা দৃঢ়তা-অটলতা-অবিচলতা অবলম্বন করবেন, তাঁদের জন্যই রয়েছে আল্লাহর বিপুল অনুগ্রহ ও রাহমাত।

মঙ্গলবার, ১৫ জানুয়ারী, ২০১৯

ইসলামী আদর্শের কর্মীদের করণীয় -মুহাম্মদ আবদুল জব্বার


Amader Bangladesh News Desk: আল-ইসলাম আল্লাহর মনোনীত একমাত্র জীবনব্যবস্থার নাম। যারা এই আদর্শের ছায়াতলে নিজেদেরকে সর্বতোভাবে সমর্পণ করে তারাই মুসলমান। মুসলমান হওয়ার সুযোগ দুনিয়ার জীবনে সবচেয়ে বড় সৌভাগ্যের।
আবার জাহেলিয়াতের সকল চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে সেই মুসলমানিত্ব যথাযথভাবে টিকিয়ে রাখার জন্য সংগঠিত জীবনের কোনো বিকল্প নেই। এ জন্যই আল্লাহ তায়ালা বলেন, “তোমরা সংঘবদ্ধভাবে আল্লাহর রুজ্জুকে ধারণ কর এবং পরস্পর বিচ্ছিন্ন হয়ো না।” (আল কুরআন) 
হাদিসেও এর বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে বলা হয়েছে, “তোমরা তিনজন সফরে বের হলেও তোমাদের মধ্যে একজনকে নেতা বানাও।” অনত্র বলা হয়েছে, “যে ব্যক্তি সংগঠন থেকে দূরে সরে গেল সে ব্যক্তি ইসলাম থেকে তার গর্দান সরিয়ে ফেলল।”
সঙ্ঘবদ্ধভাবে যারা ইসলামের সৌন্দর্য প্রচার-প্রসার ও আল্লাহর নির্দেশিত পন্থায় এর প্রতিষ্ঠার জন্য সাধ্যাতীত চেষ্টার কাজে নিজেদেরকে নিয়োজিত করে তারাই ইসলামী আদর্শের কর্মী। আদর্শিক আন্দোলনের কর্মী মানেই আন্দোলনের পক্ষ থেকে ব্যক্তির ওপর আন্দোলনের যে দায়িত্ব অর্পিত হবে তা যথাযথভাবে পালন করবে। কর্মীর সকল দায়িত্ব-কর্তব্য পালনের উদ্দেশ্যের মূলে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন।
এ দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে কোথাও যদি দুনিয়ার সম্মান মর্যাদা অর্জিত হয় এতে আনন্দে আত্মহারা হয়ে যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই। চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে গিয়ে মুষড়ে পড়ে যাওয়ারও জো নেই। আবার পরিস্থিতির শিকার হয়ে বা কাজের চাপে জীবনের প্রকৃত লক্ষ্য উদ্দেশ্য বেমালুম ভুলে গেলেও চলবে না। জীবনের প্রকৃত সার্থকতা লাভ করাই হবে একজন আদর্শ কর্মীর অন্যতম কাজ। ইসলামী আদর্শের কর্মীদের কিছু মৌলিক বিষয় সার্বক্ষণিক স্মরণ রাখা জরুরি। 
আন্দোলনের কর্মীদের মৌলিক বিষয়ে যদি বোঝার বা চিন্তার ঘাটতি থাকে, তা আন্দোলনের প্রকৃত সফলতার ক্ষেত্রে অন্তরায় সৃষ্টি করে। সাময়িক আদর্শের বিজয়ার্জন হলেও আদর্শিক কর্মীদের সঠিক বোধ ও চিন্তার লালনের অভাবে বিজয়ার্জন টেকসই হয়ে ওঠে না। ইসলামী আদর্শের কর্মীদের নিম্নের বিষয়গুলোতে সঠিক চিন্তার লালন জরুরি।
(১) আল্লাহর সন্তুষ্ট অর্জনই জীবনের মূল লক্ষ্যঃ
যেকোনো সচেতন ব্যক্তি মাত্রই কোনো কাজ করার আগে সে কাজের ফলাফল কী হতে পারে তা ভেবেচিন্তে কাজ শুরু করেন। যেমন একজন ব্যক্তি তার সন্তানের পড়াশুনার জন্য ভালো স্কুলে ভর্তি করেন, দক্ষ হাউজ টিউটর রাখেন। কারণ তার ছেলে ভালো পড়াশুনা করে দুনিয়ার বাজারে নিজেকে সুদক্ষ করে তুলবে। তেমনি একজন ব্যবসায়ী তার ব্যবসায় ভালো করার জন্য সব পুঁজি ও শ্রম বিনিয়োগ করেন।
কারণ ব্যবসায়ী তার ব্যবসায়ো ভালো করতে চান। ঠিক এমনিভাবে একজন বুদ্ধিমান মুমিন মাত্রই স্থায়ী লাভের চিন্তায় জীবনের সকল কাজের কেন্দ্রবিন্দুকে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনকে স্থির করেন। ইহজাগতিক অর্জিত সকল যোগ্যতা অর্জনও দ্বীনের কাজে সঁপে দেন। একজন মুসলমান ছাত্র ডাক্তারি বা ইঞ্জিনিয়ারিং শিক্ষার্জন করে সেই পেশায় আত্মনিয়োগ করলেও সেই পেশার মাধ্যমে মানবতার কল্যাণ সাধন করে আল্লাহর রাজি-খুশি অর্জন করাই হবে মূল টার্গেট।
তাই একজন মুসলমান দুনিয়ার ভোগ বিলাসের কাছে নিজেকে ভাসিয়ে দিয়ে আল্লাহকে ভুলে যাবে তা কখনো হতে পারে না। তাই মুমিন মাত্রই জীবনের প্রতিটি কাজ কত সুন্দর করে আল্লাহর নির্দেশিত পন্থায় তাঁর সন্তুষ্টির উপযোগী করা যায় সে ব্যাপারে সচেতন ও যত্নবান হবেন।
(২) আদর্শের প্রতি অবিচলতাঃ
যেকোনো আদর্শিক আন্দোলনের কর্মীদের সে আদর্শের প্রতি অবিচল বিশ্বাস লালন করতে হয়। বিরোধী পক্ষের শত জুলুম নির্যাতন, অপপ্রচার তাদেরকে তাদের পথ চলা থেকে বিচ্যুত করতে পারে না। আদর্শের কর্মীরা যদি সে আদর্শকে কথায় ও কাজে রূপান্তরিত করতে পারে তাহলে স্বল্প সময়ে এর প্রভাব সমাজের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়তে থাকে।
ইসলামী আন্দোলনের কর্মীদের আদর্শ হচ্ছে আল ইসলাম, ইসলামের আদর্শের ওপর আমৃত্যু টিকে থাকাই হবে ইসলামী আদর্শের কর্মীদের অন্যতম কাজ। ইসলামবিদ্বেষী চক্রের নানাবিধ ষড়যন্ত্র, অত্যাচার-নিপীড়ন ও বর্তমান সময়ে ইসলামী আদর্শের কর্মীদের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ। এসব চ্যালেঞ্জ যত কঠিন হয় আন্দোলনের জনশক্তির মাঝে তত নতুন নতুন প্রশ্ন ও ভাবনার জন্ম নেয়। নিজেদের ভবিষ্যৎ ও আন্দোলনের ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তিত বা হতাশ হয়ে পড়ে। তাই এর সঠিক জবাব জনশক্তিদের সামনে স্পষ্ট করার পাশাপাশি বিরোধীদের ষড়যন্ত্রের বিষয়ে সচেতন করতে হবে।
পরিস্থিতির ভয়াবহতা দেখে সময়ে সময়ে যারা নিজেদের চিন্তার পরিবর্তন করে, সেই দোদুল্যমান আদর্শবাদী কর্মীদের নিয়ে প্রকৃত সফলতা দেখার কোনো যৌক্তিক কারণ আছে বলে আমার হয় না। রাসূল (সা:) ও সাহাবীদের ওপর জুলুম-নির্যাতনের মাত্রাতিরিক্ততা ছিল অবর্ণনীয়, মুনাফিকরা সর্বত্র ষড়যন্ত্রের জাল পেতে রেখেছিল, পারস্পরিক সন্দেহ সংশয় সৃষ্টি করা তাদের দৈনন্দিন রুটিনে পরিণত হয়েছিল। এরপরও রাসূলের (সা:) সাহাবীরা ইসলামের আদর্শের প্রতি ছিলেন ঠায় অবিচল।
কোনো কিছুই (লোভ-লালসা, জুলুম-নির্যাতন) তাদেরকে তাদের আদর্শ থেকে চুল পরিমাণ টলাতে পারেনি। তেমনি ইসলামী আদর্শের কর্মীদের সামনে যত চ্যালেঞ্জ বিদ্যমান আছে তা চারিত্রিক দৃঢ়তা ও আদর্শের প্রতি অবিচল থেকেই মোকাবেলা করতে হবে।
(৩) আদর্শের ভিত্তিতে সমাজ গঠন করাঃ
যেকোনো রাষ্ট্রব্যবস্থা গঠিত হয় কোনো একটি আদর্শের ওপর। রাষ্ট্রে যে আদর্শের প্রভাব বেশি থাকবে সে আদর্শের ধারকরাই স্বাভাবিকভাবে রাষ্ট্র পরিচালনা করবে। বর্তমান সময়ে জোর করে আদর্শিক রাষ্ট্রব্যবস্থা পৃথিবীতে কায়েমের নজির কমে গেছে। কারণ সেই জনপদের মানুষের ভেতর গঠিত রাষ্ট্রের আদর্শের ব্যাপারে যদি প্রশ্ন থাকে, সেই প্রতিষ্ঠিত আদর্শিক রাষ্ট্র টেকসই হয় না।
যার ফলে কালান্তরে সে আদর্শের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত রাষ্ট্রের শোচনীয় পরাজয়ের প্রহর গুনতে হয়। তাই একটি সফল কল্যাণমূলক রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য সে দেশের মানুষের মাঝে আদর্শের প্রচার প্রসার ঘটাতে হবে। বিশ্বজুড়ে প্রতিষ্ঠিত সকল মতাদর্শের ওপর নিজের মতাদর্শকে সেরা আদর্শ হিসেবে উপস্থাপন করতে হবে এবং তা বাস্তবে রূপ দেয়ার সাধ্যাতীত চেষ্টা করবে। আদর্শের লালনকারীরা জনগণের জন্য কী করতে চায় তার প্রচার করতে হবে।
সকল অপপ্রচারের যৌক্তিক জবাবও তাদের দিতে হবে। ইসলামী আদর্শের সাথে মানুষের পরিচয় ঘটাতে হবে। যেহেতু ইসলামী আদর্শে বিশ্বাসীরা ইসলামী কল্যাণরাষ্ট্র কায়েম করতে চায়, তাই দেশের বেশির ভাগ মানুষের মধ্যে ইসলামে পক্ষে জনমত গঠনের মাধ্যমে ইসলামের পক্ষে মানুষের অবস্থান তৈরি করা এবং এর মাধ্যমেই চূড়ান্ত টেকসই আদর্শিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব।
সাধারণত রাষ্ট্রের সবাই আদর্শিক আন্দোলনের কর্মী নাও হতে পার। কিন্তু সে ব্যক্তি চিন্তা চেতনা যদি আদর্শের পক্ষে তৈরি হয় তাহলেই একটি আদর্শিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে বড় সহায়ক ভূমিকা পালন করবে।
(৪) জনশক্তির চিন্তার ঐকমত্যঃ
একটি আন্দোলনের সফলতার জন্য সেই আন্দোলনের জনশক্তিদের চিন্তার ঐকমত্য অত্যন্ত জরুরি। চিন্তার ঐকমত্য ব্যতীত সম্মিলিত কাজে মতদ্বৈধতা ও মতবিরোধ সৃষ্টি হবে। পারস্পরিক সম্পর্ক বিনষ্ট হবে, যা একটি আন্দোলনের স্বপ্নসাধ অঙ্কুরেই নষ্ট করে ফেলে। তাই সংগঠনের মূল ব্যক্তি থেকে শুরু করে শেষ ব্যক্তি পর্যন্ত সংগঠনের চিন্তার ভিত্তির ওপর ঐকমত্যের কোনো বিকল্প নেই।
যেখানে সবার উদ্দেশ্য একই সুতোয় গাঁথা, স্মরণ রাখতে হবে আন্দোলনকে গতিশীল ও প্রাণবন্ত রাখার জন্য সবার মতামত ব্যক্ত করার মতো সুযোগ থাকতে হবে। যাতে সবার চিন্তা একই ¯্রােতে প্রবাহিত হয়। মতপ্রকাশ করতে না পারার কারণে যেন ভিন্ন কোন ধারা-উপধারা বা পরিবেশ দূষিত না হয় সে ব্যাপারে তীক্ষè দৃষ্টি রাখা।
যারা আন্দোলনের পরিচালক তাদেরও স্মরণ রাখতে হবে হাউজে জনশক্তিদের কথা বলার অবারিত সুযোগ থাকতে হবে। উত্থিত বিষয়ে সার্বিক বিশ্লেষণ পূর্বক সবচেয়ে বাস্তবভিত্তিক ও কল্যাণকর সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষেত্রে নেতৃত্ব সচেষ্ট হবেন। জোরপূর্বক কোনো সিদ্ধান্ত ময়দানে চাপিয়ে দেয়া যাবে না। যে বিষয়ে সিদ্ধান্ত গৃহীত হলো সে বিষয়ে যৌক্তিক বিষয়গুলো হাউজে পুনরায় আলোকপাত করা।
যাতে সর্বপর্যায়ে একই চিন্তার নিরিখে কাজ করার ক্ষেত্রে কোনো প্রকার দ্বিধা না থাকে। আন্দোলনের জনশক্তির টপটু-বটম সংগঠনের চিন্তাই আমার চিন্তা হিসেবে গ্রহণ করে নেয়াকেই চিন্তার ঐকমত্য বলা হয়।
(৫) সাধ্যমাফিক নিজের ওপর অর্পিত কর্তব্য পালন করাঃ
প্রবাদ প্রবচনে প্রচলিত আছে- ‘মানুষ অসাধ্যকে সাধন করে।’ এ কথা মোটেও ঠিক নয়, কারণ সাধ্যাতীত কাজ কেউ করতে পারে না, মানুষের যা সাধ্য কেবল তাই সে করতে পারে। বৈজ্ঞানিক গবেষণায় দেখা যায় প্রত্যেক মানুষের যে মেধাশক্তি থাকে মানুষ তার কিয়াদংশও ব্যবহার করে না। যারা চেষ্টা করে তাদের ব্যতিক্রমধর্মী কর্ম আপাতদৃষ্টিতে অসম্ভব কিছু করেছে বলে মনে হলেও মূলত সেই কৃতকাজ মানুষের দ্বারাই সাধ্য। আমরা বিপদ মুসিবতে মুষড়ে পড়ি, কোন কাজে প্রত্যাশিত ফল না পেলে থমকে যাই, হীনমন্যতায় ভোগী, চিন্তার অনৈক্য দেখা দেয়।
মনে হয় আমরা বা আমি পারলাম না; যারা ইসলামী আদর্শ লালন করে তারা এমন ধারণা পোষণ করতে পারে না। কারণ প্রত্যেক ঈমানদার মানেই বিশ্বাস করে, “ভালো-মন্দ সব কিছু আল্লাহর পক্ষ থেকে হয়ে থাকে” এটি ঈমানের অংশ। রাসূল (সা:) হাদিস শরিফ থেকে এর চমৎকার ব্যাখ্যা পাওয়া যায়। তিনি বলেন, “তোমরা ঘোড় সাওয়ারকে বেঁধে রেখে আল্লাহর ওপর ভরসা কর।” 
আরো একটি হাদিসে রাসূল (সা:) নির্দেশ করেছেন, “তোমরা যখন ছাদে ঘুমাবে তখন প্রয়োজনীয় নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিয়ে আল্লাহর দরবারে ভরসা করবে।” এতে বোঝা যায় একজন মানুষ হিসেবে শক্তি-সামর্থ্যর যতটুকু পারা যায় ততটুকু দায়দায়িত্ব মানুষকে পালন করতে হবে।
আল্লাহ তায়ালা ফরমান, “আল্লাহ কারোর ওপর তার সামর্থ্যর অতিরিক্ত দায়িত্বের বোঝা চাপান না। প্রত্যেক ব্যক্তি যে নেকি উপার্জন করেছে তার ফল তার নিজেরই জন্য এবং যে গোনাহ সে অর্জন করেছে, তার প্রতিফলও তারই ওপর বর্তাবে। (হে ঈমানদারগণ, তোমরা এভাবে দোয়া চাও:) হে আমাদের রব! ভুল-ভ্রান্তিতে আমরা যেসব গোনাহ করে বসি, তুমি সেগুলোর জন্য পাকড়াও করো না। হে প্রভু! আমাদের ওপর এমন বোঝা চাপিয়ে দিয়ো না, যা তুমি আমাদের পূর্ববর্তীদের ওপর চাপিয়ে দিয়েছিলে। হে আমাদের প্রতিপালক! যে বোঝা বহন করার সামর্থ্য আমাদের নেই, তা আমাদের ওপর চাপিয়ে দিয়ো না। আমাদের প্রতি কোমল হও, আমাদের অপরাধ ক্ষমা করো এবং আমাদের প্রতি করুণা করো। তুমি আমাদের অভিভাবক। কাফেরদের মোকাবেলায় তুমি আমাদের সাহায্য করো। (সূরা বাকারা : ২৮৬)
রাসূল (সা:) যখন তাবুক অভিযানে বের হলেন তিনি তার সাহাবীদের অভিযানে বের হওয়ার জন্য আহবান জানান। কিছু সাহাবী মনের নানা দুর্বলতার (ফসলের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির আশঙ্কা) কারণে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করতে চাননি। তারা মানসিকভাবে এমন কষ্টদায়ক সফরে বের হতে চাইছেন না অথচ আল্লাহ তায়ালা তাদের সফর করতে বলেছেন।
এতে বোঝা যায় আল্লাহর পক্ষ থেকে যা নির্দেশিত হয়েছে তা তার বান্দাদের সাধ্যের মধ্যেই। সাধ্যের মধ্যে থাকার পরও যদি অভিযানে বের হবে না তাদের ব্যাপারে আল্লাহ তায়ালা কড়াভাবে সতর্ক করেছেন। আল্লাহ তায়ালা বলেন, “তোমরা যদি না বের হও তাহলে আল্লাহ তোমাদের যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি দেবেন এবং তোমাদের জায়গায় আর একটি দলকে উঠাবেন, আর তোমরা আল্লাহর কোনো ক্ষতি করতে পারবে না। তিনি সব জিনিসের ওপর শক্তিশালী।” (সূরা তওবা : ৩৯) আল্লাহর গোলাম সাধ্যমোতাবেক চেষ্টা না করার কী কারণ থাকতে পারে?
সেই কারণকে সামনে উপস্থাপন করে আল্লাহ তায়ালা বলেন, “হে ঈমানদারগণ! তোমাদের কী হলো? যখনই তোমাদের আল্লাহর পথে বের হতে বলা হলো, অমনি তোমরা মাটি কামড়ে পড়ে থাকলে? তোমরা কি আখেরাতের মোকাবেলায় দুনিয়ার জীবন পছন্দ করে নিয়েছো? যদি তাই হয় তাহলে তোমরা মনে রেখো, দুনিয়ার জীবনের এমন সাজ সরঞ্জাম আখেরাতে খুব সামান্য বলে প্রমাণিত হবে।” (সূরা তওবা : ৩৮) সুতরাং ইসলামী আদর্শের ধারকদের উচিত হবে নিজের সামর্থ্যরে সবটুকু উজাড় করে দিয়ে নিজের দায়িত্ব পালন করা এবং বাকি অপারগতার জন্য আল্লাহর সাহায্য চাওয়া। নিজেকে আল্লাহর সাহায্যপ্রাপ্তির উপযুক্ত করে গড়ে তোলা।
(৬) বিপদে মুষড়ে না পড়াঃ
আল্লাহ তায়ালা তার বান্দাদেরকে এমনি বিপদ মুসিবতে ঠেলে দেন না। বরং অনেক পরীক্ষা ঈমানদারদেরকে যাচাই করার জন্য একটি মাধ্যম মাত্র। আল্লাহর পথে চলতে গেলে আল্লাহদ্রোহীদের নানামুখী অপতৎপরতার কারণে বিপদ মুসিবতে পড়তে হয়, যে বিপদগুলো মানুষ সৃষ্টি করে আবার কিছু বিপদ আছে যেখানে মানুষের হাত নেই। এমন বিপদসঙ্কুল অবস্থায় আদর্শিক কর্মীদের কাজ হবে আল্লাহর ওপর ভরসা করা। বিপদগুলোর ধরন “আর নিশ্চয়ই আমরা ভীতি, অনাহার, প্রাণ ও সম্পদের ক্ষতির মাধ্যমে এবং উপার্জন ও আমদানি হ্রাস করে তোমাদের পরীক্ষা করবো।
এ অবস্থায় যারা সবর করে তাদেরকে সুসংবাদ দিয়ে দাও এবং যখনই কোনো বিপদ আসে বলে, “আমরা আল্লাহর জন্য এবং আল্লাহর দিকে আমাদের ফিরে যেতে হবে।” (সূরা বাকারা : ১৫৫-১৬৫)
ঈমানদাররা যেকোনো পরিস্থিতিতে ঘাবড়ে না গিয়ে দ্বিধাহীনচিত্তে আল্লাহর পথেই তাদের সকল চেষ্টা ও তৎপরতা অব্যাহত রাখবে। আল্লাহ তায়ালা বলেন, প্রকৃত ঈমানদার তারাই যারা আল্লাৎহ ও তাঁর রাসূলের ওপর ঈমান এনেছে এবং এ ব্যাপারে পরে আর কোনো সন্দেহ পোষণ করেনি। তারপর প্রাণ ও অর্থসম্পদ দিয়ে জিহাদ করেছে। তারাই সত্যবাদী। (সূরা হুজুরাত ১৫)
আমরা যারা ইসলামী আদর্শের অনুসারী আমাদের জীবনচলার পথে জাহেলিয়াতের নানামুখী অপঘাতে থমকে দাঁড়াই বোধ করি এই মনে হয় জীবন গেল, এই মনে হয় সর্বস্ব খোয়ালাম! কিন্তু আমাদের ভুলে গেলে কি চলবে? এসব অপঘাতে যদি আদর্শবাদী দলের কর্মীরা থমকে যায় জীবনের মায়ায় ও দুনিয়ার লোভ-লালসায় জড়িয়ে পড়ে, আল্লাহপ্রদত্ত দায়িত্বের চাইতে দুনিয়ার সাময়িক প্রাপ্তিতে নিজেকে বিকিয়ে দেয়, হার মেনে নেয় তাহলে তারা কী করে আদর্শের কর্মীরা কী করে জাহেলিয়াতের ওপর ইসলামের বিজয়ের স্বপ্ন দেখে?
(৭) বিজয় আনন্দে অতিমাত্রায় উল্লসিত না হওয়াঃ
ইসলামী আদর্শের অনুসারীরা সমগ্র বিশ্বমানবতাকে আল্লাহর দাসত্ব গ্রহণের আহবান জানাবে। সামগ্রিকভাবে আল্লাহর জমিনে তার প্রতিনিধিত্বের ভিত্তিতে হুকুমাতে ইলাহি বা ইসলামী কল্যাণমূলক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টা করবে। জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে ইসলামী কল্যাণরাষ্ট্রে সবার অধিকার সুনিশ্চিত হবে। অর্থাৎ আল্লাহপ্রদত্ত ও রাসূল (সা:) প্রদর্শিত বিধান অনুযায়ী মানবজীবনের কল্যাণ সাধনের চেষ্টায় ব্রত থাকাই ইসলামী আদর্শের অনুসারীদের অন্যতম কাজ।
এর মাধ্যমেই আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করাই মূল লক্ষ্য। আদর্শ প্রতিষ্ঠার কাজ করতে গিয়ে যদি চূড়ান্ত বিজয় চলে আসে তখন বিজয় আনন্দে অতিমাত্রায় উল্লসিত হয়ে পড়া ইসলামী আদর্শের অনুসারীদের জন্য শোভা পায় না। বরং ইসলামী খেলাফতের বিজয়ের পর দায়িত্ব অনেক বেড়ে যায়। দুনিয়া ও আখেরাতে দায়িত্বের জবাবদিহিতার পেরেশানি বেড়ে যাওয়ায় নিজের সর্বস্ব উজাড় করে দিয়ে অর্পিত দায়িত্ব পালনের চেষ্টা করে।
এ কারণেই হজরত ওমর (রা:)-এর ওপর যখন খেলাফতের দায়িত্ব অর্পিত হলো তখন নিজের প্রতি আফসোস করে বলেছিলেন, “হে ওমর! তুমি যদি আজ ওমর না হয়ে সামান্য খড়কুটা হয়ে জন্ম নিতে তাহলে আল্লাহর কঠিন জবাবদিহি থেকে বেঁচে যেতে।” তিনি একইভাবে দায়িত্বানুভূতির পেরেশানি থেকে বলেছিলেন, “ফারাত নদীর তীরে একটি কুকুরও যদি অভুক্ত হয়ে মারা যায় এ জন্য আমাকে আল্লাহর দরবারে কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হবে।” বিজয় অনেক সময় নিজেদের আত্মভোলা করে ফেলে, অহঙ্কারী করে তোলে। আল্লাহর দরবারে শুকরিয়া আদায় করা ও আমানতের সুরক্ষার জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা
করা। যেমন রাসূল (সা:) মক্কা বিজয়ের পর আল্লাহ অহি প্রেরণ করলেন, “যখন আল্লাহর সাহায্য এসে যায় এবং বিজয় লাভ হয়। আর (হে নবী!) তুমি (যদি) দেখ যে লোকেরা দলে দলে আল্লাহর দ্বীন গ্রহণ করছে, তখন তুমি তোমার রবের হামদসহকারে তাঁর তাসবিহ পড়ো এবং তাঁর কাছে মাগফিরাত চাও। অবশ্য তিনি বড়ই তওবা কবুলকারী (সূরা নাসর)
(৮) প্রকৃত সফলতার মানদন্ড কী?
ইসলামী আদর্শের ঝান্ডাধারীদের প্রকৃত সফলতার মানদন্ড কী? জাগতিক জগতে নেতৃত্ব-কর্তত্ব, যশ-খ্যাতি, অর্থ-বিত্ত-বৈভব সফলতার মানদন্ড বলে বিবেচিত হলেও ইসলামী আদর্শের অনুসারীদের প্রকৃত সফলতার মানদন্ড হলো আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করা। কারণ আল্লাহর সন্তুষ্টির মাধ্যমেই কেবলমাত্র দুনিয়া ও আখেরাতে প্রকৃত সফলতা লাভ করা সম্ভব বলে বিশ্বাস করে ইসলামী আদর্শের কর্মীরা। ইসলামী খেলাফাত প্রতিষ্ঠা করার প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখা ইসলামী আদর্শের কর্মীদের খুবই গুরুত্বপূর্ণ কাজ যা ফরজ।
ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা লাভ করলে সামগ্রিকভাবে রাষ্ট্রের জনগণ রাষ্ট্রের কল্যাণ লাভ করে। একদল আদর্শিক কর্মী যদি আদর্শিক আন্দোলনের নিবেদিতপ্রাণ হয় তাহলে তারা ইসলামী কল্যাণমূলক রাষ্ট্রপ্রতিষ্ঠার কাজ করে ক্ষমতাপ্রাপ্তির লোভে নয়, আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্যই এই প্রচেষ্টা। অব্যাহত প্রচেষ্টার পর যদি ইসলামী রাষ্ট্রপ্রতিষ্ঠা হয়ে যায়, আলহামদুলিল্লাহ! তা হবে খুব খুশির খবর। কিন্তু যদি ব্যক্তি হিসেবে যদি পরওয়ারদিগারের সন্তুষ্টি অর্জিত না হয় তাহলে ইসলামী আদর্শের কর্মী প্রকৃতভাবে সফল হয় না।
ইসলামী আদর্শের কর্মীর চেষ্টার ফলে ইসলামী কল্যাণমূলক রাষ্ট্রপ্রতিষ্ঠা না হলেও একজন মুমিন আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করতে পারলেই প্রকৃত সফলতা অর্জিত হয়েছে বলে বিবেচিত হবে। আল্লাহ তায়ালা বলেন, “নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাদের চেহারা, অবয়বের দিকে তাকান না বরং তিনি তাকান তোমাদের মনের দিকে। (আল কুরআন)
সুতরাং আমরা যারা আদর্শিক আন্দোলনের কর্মী হিসেবে কাজ করছি ইসলামী রাষ্ট্রপ্রতিষ্ঠা করার চেষ্টায় যদি সফল হয়ে যাই তা হবে বেজায় খুশির খবর আর আখেরাতের সফলতা যদি অর্জন করতে না পারি তা হবে প্রকৃত ব্যর্থতা। তাই আমাদের জীবনের চাকাটা সে পথেই পরিচালিত করা প্রয়োজন, যে পথে লৌকিকতা নেই, নেই আত্মতুষ্টি, যেখানে সব কাজের মূলে আল্লাহর সন্তুষ্টি।
দুনিয়া প্রত্যেক মানুষের জন্য একটি পরীক্ষাক্ষেত্র। পরীক্ষার কথা জেনেও যারা দিব্যি প্রস্তুতি না নিয়ে হেলায় খেলায় সময় ক্ষেপণ করে, দুনিয়ার জাহেলিয়াতের কাছে নিজেকে বিকিয়ে দেয়, তাদেরকে ইসলামী আদর্শের কর্মী বলা যায় না।
যারা আল্লাহর গোলামি কাছে পৃথিবীর সকল চাওয়া পাওয়াকে উৎসর্গ করে তাঁর সন্তুষ্টির জন্য জানপ্রাণ বিলিয়ে দিয়ে তাঁরই নির্দেশিত পথে চলতে স্বাচ্ছ্যন্দ বোধ করে সেই মর্দে মুমিন, সেই ইসলামী আদর্শের জিন্দাদিল মুজাহিদ। তাঁর কাছেই দুনিয়া পদানত হয়, দুনিয়ার কাছে সে পদানত হয় না। তখন সে আল্লাহর জন্য হয়ে যায় আর আল্লাহ হয়ে যান সেই বান্দার।
আজ বড়ই প্রয়োজন সেই আদর্শিক কর্মী মূসা, খালিদ, তারিক, কাশিম, তিতুমীর ও হাজী শরীয়তুল্লাহর। যারা মরেও মরেনি। যাদের ঈমানী দীপ্ততায় এখনো তেজোদীপ্ত হয় লক্ষ কোটি তরুণ, খোঁজে ফেরে হেরার আলোক দ্যুতি। সেই আদর্শিক আলোয় উদীপ্ত আগামীর বিশ্ব। যে আদর্শ নিশ্চিত করবে বিশ্বমানবতার প্রকৃত কল্যাণ।

মঙ্গলবার, ১ জানুয়ারী, ২০১৯

আদর্শচ্যুত রাজনীতির অবধারিত পরিনাম - মাহমুদুর রহমান

আমাদের বাংলাদেশ নিউজ24 ডেস্কঃ আমি রাজনীতির সাথে জড়িত হয়েছি ২০০৭ সাল থেকে। আমার মত একজন সাধারন ব্যক্তি সম্পর্কেও খোঁজখবর রাখেন এমন বোদ্ধা পাঠক প্রতিবাদ করে বলে উঠতে পারেন, আপনি সত্য বলছেন না কারন বিনিয়োগ বোর্ডের নির্বাহী চেয়ারম্যান হয়ে ২০০১ সালের নভেম্বরে আপনি সরকারে যোগদান করেছেন।
আমি সবিনয়ে বলবো যে সরকারে টেকনোক্রেট হিসেবেই যোগ দিয়েছিলাম। আমার কাজ-কর্ম রাষ্ট্রীয় অর্থনৈতিক গন্ডির মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। তৎকালিন প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া দলীয় কাজ-কর্মে আমাকে একেবারেই সম্পৃক্ত করেননি। এমনকি কোন রাজনৈতিক বিষয়ে আমার কাছ থেকে কোনদিন কোন মতামত চাননি। ২০০৭ সালে জেনারেল মইনের নেতৃত্বে এক বিভ্রান্ত সেনাবাহিনী শত্রু দেশের কাছে স্বাধীনতা বন্ধক দিলে তারই প্রতিবাদে আমার রাজনীতিতে আগমন। আমার লেখক সত্তার জন্মও সেই সময়েই।
আমি শহীদ জিয়ার বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ তত্ত্বের একজন অনুসারী। রাজনীতিতে সম্পৃক্ত হওয়ার পর থেকে কখনও সেই আদর্শ অনুসরণে কোন রকম কপটতা কিংবা সুবিধাবাদিতার আশ্রয় গ্রহন করিনি। সাময়িক এবং সস্তা কোন জনপ্রিয় অভিমতকে গ্রহন করিনি। একজন বাঙালী মুসলমানের বিশ্বাস, ঐতিহ্য এবং আদর্শকে ধারন করে স্রোতের বিপরীতে অনেক সময় অবস্থান নিয়েছি। এক এগারোর সরকার প্রাথমিক পর্যায়ে জনগনকে বিভ্রান্ত করে সাময়িক জনপ্রিয়তা অর্জনে সক্ষম হয়েছিল। বিএনপির নেতৃবৃন্দের মধ্যে অধিকাংশই তখন সেনা সমর্থিত সরকারের কৃপা ভিক্ষার জন্যে দোরে দোরে ঘুরেছেন। অনেকেই দেশ ছেড়ে পালিয়েছিলেন। তথাকথিত ‘আয়রন লেডি’ শেখ হাসিনাও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং যুক্তরাজ্যে পাড়ি দিয়েছিলেন। সেই বৈরী সময়েও জেনারেল মইনের জাতির পিতা তত্বের বিরোধিতা করে নয়া দিগন্ত পত্রিকায় আমি লিখেছিলাম, দেশে-বিদেশে জাতির পিতা ফেব্রুয়ারী, ২০০৭)। শেখ মুজিবকে আমাদের জাতির পিতা মানতে আমি অস্বীকার করেছিলাম এবং এখনও করি।

ভারত-মার্কিন-ইসরায়েলী লবির সঙ্গে ষড়যন্ত্রক্রমে এক এগারোর সেনা সমর্থিত সরকার শেখ হাসিনাকে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত করার পর থেকেই দিল্লির দালাল সকারের চরিত্র আমার দেশ পত্রিকায় অব্যাহতভাবে উন্মোচিত করে গেছি। ইসলাম বিদ্বেষী সেক্যুলার সরকারের দুর্নীতির খবর ছেপেছি তাদের ক্ষমতা লাভের এক বছরে মধ্যেই। বিএনপির অনেক বিজ্ঞ নেতা আমাকে হঠকারী বলে গালমন্দ করেছে। বলেছে সরকারের প্রথম বছরেই এত কথা পত্রিকায় লেখার দরকার কী? এগুলো বাড়াবাড়ি। সবার আগে উচ্চ আদালতের কদাকার এবং দলবাজ চেহারা জাতির সামনে তুলে ধরেছি। আদালত অবমাননার মামলা হলে বিএনপির তাবৎ আইনজীবী এবং নীতিনির্ধারকবৃন্দ ক্ষমা চাওয়ার জন্য আমার ওপর চাপ সৃষ্টি করলেও নীতির প্রশ্নে অবিচল থেকেছি। পুলিশ হেফাজতে অমানুষিক অত্যাচার সহ্য করেও আপীল বিভাগে দাঁড়িয়ে বলেছি, ক্ষমা চাইব না, যা লিখেছি সত্য লিখেছি।
২০১২ সালে স্কাইপ কেলেংকারীর তথ্য হাতে এলে সেগুলো যাচাই-বাছাই করে নিশ্চিত হওয়ার পর প্রকাশ করতে এতটুকু দ্বিধা করিনি। সরকার, বিচারবিভাগ এবং দিল্লির হুমকির পরওয়া করিনি। ২০১৩ সালে দেশি-বিদেশি মিডিয়া সম্মিলিতভাবে দিল্লির প্রকল্প, গনজাগরন মঞ্চকে গৌরবান্বিত করলেও তার বিরুদ্ধে একা আমার দেশ লড়াই করেছে। ইসলাম বিদ্বেষী শহুরে মধ্যবিত্তদের বিরাগভাজন হব জেনেও পত্রিকার শিরোনাম করেছি, শাহবাগে ফ্যাসিবাদের পদধ্বনি। বিএনপির সুবিধাবাদী নেতারা আবারও অসন্তুষ্ট হয়েছেন। তারা তখন বেগম খালেদা জিয়াকে শাহবাগে নেয়ার জন্য পায়তারা করছেন। এদের মধ্যে বদ্ধমূল ধারনা জন্মেছে যে ভারতের কৃপা ব্যতীত ক্ষমতায় প্রত্যাবর্তন সম্ভব নয়। শহীদ জিয়ার আদর্শকে জলাঞ্জলি দেয়ার জন্য সব এক পায়ে খাড়া। তাদের কাছে মনে হলো গনজাগরনে যোগদান করলে দিল্লি খুশী হবে। সেক্যূলার বিএনপির ধারনা দলের মধ্যে অবয়ব নিতে আরম্ভ করেছে।
জেল থেকে মুক্তি পেলাম ২০১৬ সালের ২৩ নভেম্বর। এর মধ্যে ২০১৪ সালের ভুয়া নির্বাচন হয়ে গেছে এবং বিএনপির ২০১৪ এবং ২০১৫ সালের আন্দোলন ফ্যাসিস্ট সরকারকে হটাতে ব্যর্থ হয়েছে। দ্বিতীয় দফার চার বছরের জেল জীবনে বিএনপি এবং জামাতের অসংখ্য নেতা-কর্মীদের সঙ্গে রাজনৈতিক আলোচনার সুযোগ পেয়েছি। বিস্ময়ের সঙ্গে লক্ষ্য করেছি যে বিএনপির অধিকাংশ শীর্ষ নেতাই ২০১৪ সালের নির্বাচন বর্জন করার জন্য বেগম জিয়াকে দোষারোপ করছেন। বেগম জিয়ার সিদ্ধান্ত সঠিক বিবেচনা করে আমি তাদের সাথে অনবরত তর্ক করেছি। এবং পরিনামে অধিকতর বিরাগভাজন হয়েছি। বিএনপির ভারত অভিমুখি যাত্রার বিষয়টি জেলে বসেই টের পাচ্ছিলাম। কাশিমপুর থেকে বেরিয়ে জানলাম দলের ভিতরকার ভারতপন্থী গোষ্ঠী শীর্ষ নেতৃত্বকেও প্রভাবিত করতে সক্ষম হয়েছে। বিভিন্ন সভা-সেমিনারে ভারতের বিষয়ে আমার অনড় অবস্থান তাদের অস্বস্তিতে ফেলছে। এমনকি বেগম খালেদা জিয়াও ভারত এবং ইসলাম প্রশ্নে আমাকে আকারে-ইঙ্গিতে সংযত হতে পরামর্শ দিলেন। আমার কারনে নাকি ভারত এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বিএনপির প্রতি বিরক্ত হচ্ছে। আমি বেগম জিয়াকে বোঝানোর চেষ্টা করেছি যে দিল্লি কখনও শেখ হাসিনার পরিবর্তে তাকে মসনদে বসাবে না। শেখ পরিবারের সাথে ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা এবং দিল্লির এস্টাবলিশমেন্টের সেই পাকিস্তানী আমল থেকে গভীর সম্পর্ক।
বিজেপি কিংবা কংগ্রেস, দিল্লিতে যারাই ক্ষমতায় থাকুক না কেন, আওয়ামী লীগ এবং শেখ পরিবারই তাদের মিত্র। একবিংশ শতকের ভূ-রাজনৈতিক বাস্তবতায় আমেরিকাও ভারতের ইচ্ছার বিরুদ্ধে বাংলাদেশে কোন দলকে সমর্থন করবে না। তাছাড়া, ইসলাম বিদ্বেষের মাপকাঠিতে শেখ হাসিনা, হিন্দুত্ববাদী ভারত এবং জায়নবাদী শ্বেতাঙ্গ গোষ্ঠী একে অপরের পরিপূরক। বাংলাদেশের সংখ্যাগুরু জনগোষ্ঠীকে ঐক্যবদ্ধ করেই বিএনপিকে লড়াই করে যেতে হবে। বলা বাহুল্য, বিএনপির নীতিনির্ধারনী ফোরামে আমার রাজনৈতিক আদর্শ ইউটোপিয়ান এবং হঠকারী বিবেচিত হলো। এক সময় লক্ষ্য করলাম, দলটির ইন্টেলেকচুয়াল ফোরাম থেকে আমাকে বাদ দেয়া হচ্ছে। এক এগারোর সুবিধাবাদী এবং ভারতপন্থী বুদ্ধিজীবীদের আগমন ঘটলো চেয়ারপার্সনের গুলশান কার্যালয়ে। এই নব্য বিএনপি বুদ্ধিজীবীদের রাজনৈতিক নেতৃত্বে থাকলেন দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর এবং স্থায়ী কমিটির সদস্য আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরী। এই বুদ্ধিজীবীরা সময়ের অনেক আগেই ভারতের পরামর্শ অনুযায়ী বিএনপিকে একতরফা নির্বাচনের ট্রেনে তুলে ফেলেছেন। বিএনপি নেতৃত্ব আমার পরামর্শে কান দিচ্ছে না জেনেও তাদেরকে জিয়াউর রহমানের আদর্শে ফেরানোর সর্বাত্বক চেষ্টা করেছি। সব চেষ্টাই ব্যর্থ হয়েছে। বিএনপির মধ্যকার ভারতীয় দালালগোষ্ঠী শেখ হাসিনার অবৈধ শাসনামলকে বৈধতা দেয়ার নীল নকশা তৈরী করে ততদিনে তার বাস্তবায়ন শুরু করেছে। ২০১৪ সালের নির্বাচন বর্জন ভুল ছিল শ্লোগান তুলে বেগম জিয়াকেও মানসিকভাবে দূর্বল করে ফেলেছিল একই চিহ্নিত গোষ্ঠী। এই প্রসঙ্গে ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার একটি ঘটনার উল্লেখ করছি।
জেল থেকে বের হওযার পর নতুন এবং পুরনো ১২৫ মামলার হাজিরা দিতে আমাকে সারা দেশ চষে বেড়াতে হত। সেরকম এক হাজিরায় দিনাজপুর গেছি। আদালতে দিনাজপুরের কোন এক আসনের বিএনপি দলীয় সাবেক সংসদ সদস্য আখতারুজ্জামানের সঙ্গে সাক্ষাৎ হলো। সজ্জন মানুষ, এলাকার দলের নেতা-কর্মীদের খোঁজ-খবর রাখেন। রাজনীতি নিয়ে আলোচনার এক পর্যায়ে তিনি বলে উঠলেন, ২০১৪ সালে নির্বাচন বর্জন করে বেগম জিয়া পর্বতসম ভুল করেছেন, ২০১৮ সালেও বর্জন করলে দল থাকবে না। আমি সাধ্যমত চেষ্টা করলাম শেখ হাসিনাকে বৈধতা না দেয়ার পক্ষে যুক্তি দিয়ে তাকে বোঝাতে । কোন কাজ হলো না। তিনি জোর দিয়ে বললেন যে বিএনপির মহাসচিবসহ সকল সম্ভাব্য প্রার্থীরাই নাকি নির্বাচনের পক্ষে। সেদিনই নিশ্চিৎ হয়ে গেলাম যে বিএনপিতে আত্মঘাতী রাজনীতির পচন আরোগ্যের উর্ধ্বে চলে গেছে। আদর্শচ্যুত, সুবিধাবাদী গোষ্ঠী দলের Rank and File কে বিভ্রান্ত করতে সক্ষম হয়েছে। আমি জানি না সেই আখতারুজ্জামান তামাশার নির্বাচনে মনোনয়ন পেয়েছেন কিনা কিংবা পেয়ে থাকলে তার জামানত রক্ষা পেয়েছে কিনা। সে খবর জানারও আমার কোন আগ্রহ নেই। কেবল ভাবি আখতারুজ্জামানের মত পুরনো এবং তৃণমূল রাজনীতিবিদদের বিভ্রান্তি দল এবং দেশের বড় ক্ষতি করে দিল। এক ভয়ংকর ফ্যাসিস্ট শাসকের অধীনে নির্বাচনে অংশগ্রহনের ভুল কৌশলের চোরাবালিতে একা আখতারুজ্জামান পা দেন নি, আমার ধারনা বিএনপির বিভিন্ন পর্যায়ের নেতৃত্বের বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ একই কাজ করেছেন। এমনকি শুধু বিএনপি নয়, জামায়াতে ইসলামীর নেতৃত্বও একই বোকার স্বর্গে বাস করেছেন। নির্বাচন করতেই হবে, এই উন্মাদনায় দলের নিবন্ধন না থাকলেও তারা ধানের শীষ নিয়ে কাড়াকাড়ি করেছেন। দিল্লি এবং শেখ হাসিনা এবং জামাতে ইসলামীকে যে একটি আসনও দিতে পারে না এই সহজ সত্য দলের নেতৃবৃন্দ দেখতে পাননি। এই কৌশলকে কি নামে ডাকবো. অবিমৃষ্যকারিতা, সুবিধাবাদিতা নাকি স্রেফ নির্বুদ্ধিতা?
বিএনপি নেতৃত্বের আত্মবিশ্বাসের ঘাটতি তাদের নেতা ভাড়া করে আনার মধ্য দিয়েও প্রমানিত হয়েছে। দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে সাবেক আওয়ামী লীগারদের জোটে ভিড়িয়ে ড: কামালের নেতৃত্বে নির্বাচনী লড়াইয়ে নেমেছিলেন। ড: কামাল, কাদের সিদ্দিকী, আ স ম রব, মাহমুদুর রহমান মান্না, ইত্যাদিদের কেন প্রয়োজন হলো তার একটা ব্যাখ্যা খোঁজার চেষ্টা করেছি। ইন্দো-মার্কিন বলয়কে সন্তুষ্ট করার লক্ষ্যে বিএনপি যথাসম্ভব তাদের কল্পিত ইসলামী লেবাস ত্যাগ করবার চেষ্টা করেছে। এক সময়ের আওয়ামী নেতাদের দলে ভেড়ানোর উদ্যোগ বর্ণিত কৌশলেরর অংশ বলেই আমার কাছে মনে হয়েছে। দলের মহাসচিবের এই উদ্যোগে বেগম জিয়া এবং তারেক রহমানের যে সম্পূর্ন সায় ছিল তাতে সন্দেহ পোষন করারও কোন কারণ নেই। মজার কথা হলো বিএনপির নীতিনির্ধারনী মহলে ব্যক্তিজীবনে সেক্যুলারদেরই একচেটিয়া প্রাধান্য।
দূর্ভাগ্যবশত: তাদের গায়ে ইসলামী লেবাস লেগে যাওয়ার কারন হলো দলের প্রতিষ্ঠাতার বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের আদর্শ এবং জামাতে ইসলামীর সাথে নির্বাচনী মৈত্রী। আশ্চর্য্যরে বিষয় হল জামায়াতে ইসলামীকে ত্যাগ না কলেও বিএনপি নেতৃত্ব এবার জিয়াউর রহমানকে পরিত্যাগ করতে দ্বিধা করেনি। নির্বাচনের আগে কিংবা পরে ড: কামালের মুখে জিয়া নামটি একবারের জন্যও উচ্চারিত হয়নি। মির্জা ফখরুলকে পাশে বসিয়ে তিনি সারাক্ষন বাংলাদেশের প্রথম গনতন্ত্র হত্যাকারী শেখ মুজিবের বন্দনা করে গেছেন। প্রবাসে বসে শুনেছি যে নির্বাচনী ইশতেহারে বিসমিল্লাহির রাহমানুর রাহীম রাখা নিয়ে বিএনপি নীতিনির্ধারকদের মধ্যে যথেষ্ট দোদূল্যমানতা ছিল। আওয়ামী লীগের ইসলাম বিদ্বেষ সর্বজনবিদিত এবং প্রাচীন। শেখ হাসিনা অবলীলাক্রমে বাংলাদেশের সংবিধান থেকে আল্লাহর প্রতি আস্থা এবং পূর্ন বিশ্বাসের ঘোষনা প্রত্যাহার করতে পারেন। তাই বলে তারই অনুকরনে বিএনপি নেতৃবৃন্দ আল্লাহর নাম নিয়ে দ্বিধায় ভুগবেন এটা মেনে নেয়া কঠিন।
বিএনপির রাজনীতির দেউলিয়াত্ব নির্বাচনের প্রাক্কালে ভারতীয় পত্রিকায় দেয়া মহাসচিব মির্জা ফখরুলের ইন্টারভিউ থেকেও দৃশ্যমান। তিনি অবলীলায় স্বীকার করেছেন যে বিএনপি ভারতের ক্ষমতাসীন হিন্দুত্ববাদী বিজেপির সাধারন সম্পাদকের সাথে ব্যাংককে বৈঠকের আপ্রান চেষ্টা করেও অন্য পক্ষের অনীহার কারনে ব্যর্থ হয়েছে। ঢাকাস্থ ভারতীয় দূতাবাসের লোকজনও নাকি বিএনপিকে পাত্তা দিতে চায় না। এর আগে তারেক রহমানের ব্যক্তিগত সহকারী জনৈক হুমায়ুন কবির, স্থায়ী কমিটির সদস্য আমির খসরু এবং ভাইস চেয়ারম্যান আবদুল আউয়াল মিন্টু অযাচিত ভাবে ভারতে গিয়ে জিয়াউর রহমান ও বেগম জিয়ার রাজনীতির প্রকাশ্য সমালোচনা করে দিল্লির মনোরঞ্জনের আপ্রান চেষ্টা করেছেন। আদর্শচ্যূত এবং আত্মসম্মানহীন একটি রাজনৈতিক দল দেশে এবং বিদেশে কোথাও যে মর্যাদা পাবে না এটাই প্রত্যাশিত।
অনলাইন সংবাদ মাধ্যমের তথ্য অনুযায়ী বিএনপি এবং গনফোরামকে শেখ হাসিনা সর্বমোট সাতটি আসনের ভিক্ষা দিয়েছেন। ভিক্ষা প্রাপ্তদের মধ্যে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরও আছেন। তবে তাকে ঠাকুরগাঁও এর নিজস্ব আসন না দিয়ে বগুড়ার বেগম জিয়ার আসন থেকে বিজয়ী ঘোষনা করা হয়েছে। শেখ হাসিনার অধীনে নির্বাচনে অংশ নিলে তার পরিনতি সম্পর্কে দেশের জনগনকে আমি একাধিকবার সতর্ক করে বলেছিলাম যে, বিরোধী দল কটি আসন পাবে এবং কারা বিজয়ী হবে সেটি শেখ হাসিনা এবং ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা ‘র’ মিলে নির্ধারন করবে। আমার আশংকা সত্যে পরিনত হয়েছে।

বিরোধী দলের ৭ আসন প্রাপ্তি প্রসঙ্গে পুরনো দুটি তথ্যের কথা মনে পড়লো। বাংলাদেশে তামাশার নির্বাচনের সূচনা হয়েছিল ১৯৭৩ সালে। বিএনপি দ্বারা বৈধতাপ্রাপ্ত ফ্যাসিস্ট প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পিতা সেই সময় বিরোধী দলকে একইভাবে ৭টি আসন দিয়ে বাকি ২৯৩ আসনে আওয়ামী লীগকে বিজয়ী দেখিয়েছিলেন। ওই নির্বাচনে ঐক্যফ্রন্টের ড: কামালও আওয়ামী লীগের প্রার্থী হয়ে এক আসনে জিতেছিলেন। শেখ মুজিবের কন্যা পিতার আদর্শ অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছেন। এখানে ৭ আসন সংখ্যাটি কাকতালীয় নয়। এমন ভয়ানক ফ্যাসিজম মোকাবেলার সক্ষমতা বিএনপি এবং জামাতের বর্তমান নেতৃত্বের আছে কিনা সেই প্রশ্ন জনমনে উত্থাপিত হচ্ছে। দ্বিতীয় ঘটনা ১৯৯১ সালের। নির্বাচনের আগে ভারতীয় পত্রিকায় প্রদত্ত সাক্ষাৎকারে শেখ হাসিনা ভবিষ্যদ্বানী করেছিলেন যে, তিনি প্রধানমন্ত্রী হবেন এবং জেনারেল এরশাদের জাতীয় পার্টি দ্বিতীয় অবস্থানে থাকবে।
বিএনপি সম্পর্কে তার মন্তব্য ছিল দলটি সর্বোচ্চ দশ আসন পেতে পারে। আমার ধারনা ঘটনাটি শেখ হাসিনার স্মরণে ছিল। তিনি কথা রেখেছেন। ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচনী তামাশায় জাতীয় পার্টি ২২ আসন পেয়ে দ্বিতীয় হয়েছে। আর ড: কামালকে ভাড়া করেও বিএনপি দশ আসন পায়নি। ২০০৭ সালে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী ভারতের কাছে আমাদের স্বাাধীনতা বিসর্জনের যে প্রক্রিয়া শুরু করেছিল সেটি ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বরে বিএনপি-জামাতের সহায়তাক্রমে শেখ হাসিনা সম্পন্ন করলেন। পলাশীর ট্রাজেডির মত করেই দেশপ্রেমিকের দাবীদার বাংলাদেশ সেনাবাহিনী ও নিশ্চল দাঁড়িয়ে থেকে পরাধীনতার দলিলে সিলমোহর লাগাতে দেখলো। বাংলা এবং ভারতের স্বাধীনতা পুনরুদ্ধারে ১৯০ বছর লেগেছিল। আমাদের কত বছর লাগবে সেটি দেখার জন্য হয়ত পৃথিবীতে থাকব না। তবু স্বাধীনতা পুনরুদ্ধারের স্বপ্ন নিয়েই জীবন কাটাতে চাই। বাংলাদেশের জনগনের উদ্দেশ্যে বহুবার বলা কথা আবারও বলছি। স্বাধীনতা কিংবা অধিকার কেউ স্বেচ্ছায় দেয় না। অনেক লড়াই করে, বহু প্রানের বিনিময়ে ওটা অর্জন করতে হয়। গোলামী যেন দেশবাসসির অভ্যাসে পরিনত না হয় মহান আল্লাহতালার কাছে সেই প্রার্থনাই করছি।।
ভিন্ন প্রসঙ্গ: নির্বাচনের আগের দিন বিকেল থেকে সরকারপন্থী দুই টেলিভিশন চ্যানেল, সময় এবং ডিবিসিতে একেবারে অপ্রাসঙ্গিকভাবে আমাকে নিয়ে তথ্য সন্ত্রাস চালানো হয়েছে। মিনিট খানেকের একটি অডিও বাজিয়ে দাবী করা হয়েছে যে ২০১৭ সালের ডিসেম্বরে ওমরাহ পালনকালে আমি নাকি আইএসআই এর কোন এজেন্টের সাথে সাক্ষাৎ করেছি।
এক বছর পুরনো ঘটনা টেনে এনে এমন অপপ্রচার কোন উদ্দেশ্যে চালানো হয়েছে তার ব্যাখ্যা বাংলাদেশের ক্ষমতাসীন ভারতীয় দালাল সরকার এবং দুই টেলিভিশন চ্যানেলের কর্তৃপক্ষই ভাল করে দিতে পারবে।
আমি অডিওটি শুনেছি। সেখানে জনৈক মেহমুদ আমার সঙ্গে সাক্ষাৎ চেয়ে ফোন করেছেন। আমি জবাবে বলেছি যে পরের দিনই পবিত্র মদিনা ছেড়ে যাব। তাই দেখা করতে চাইলে তাকে ওই দিনই হোটেলে আসতে হবে। অডিওটি শুনলেই যে কেউ বুঝবেন যে, ফোনের অপর প্রান্তের মেহমুদের পরিচয় আমি জানি না এবং পূর্বে তার সঙ্গে আমার কখনও সাক্ষাৎ হয়নি। এখন মেহমুদ যে ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা ‘র’ কিংবা মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা, সিআই এর এজেন্ট নন তার প্রমান কী? মক্কা এবং মদীনায় হাজারো মানুষের সঙ্গে আমার সাক্ষাৎ ঘটেছে। তারা সকলেই মুসলামান কারন বিধর্মীদের ওই দুই পবিত্র শহরে যাওয়ার সুযোগ নেই। আমি দেশে এবং বিদেশে মোটামুটি পরিচিত।
তাছাড়া মানুষের সঙ্গ আমাকে আনন্দ দেয়। তাদের সঙ্গে কথা বলে আমি সর্বদাই জ্ঞানলাভ করি, অনুপ্রানিত হই। কারো সঙ্গে দেখা করতেই আমার আপত্তি নেই। ওই অচেনা ভদ্রলোকের নাম মেহমুদ না হয়ে যদি মোদি হতো তাহলেও আমি আগ্রহ নিয়ই দেখা করতাম। কে, কার এজেন্ট এটা জানার আমার কোন সুযোগ নেই।
আরো মজার কথা হলো সংবাদে দাবী করা হয়েছে যে, আমি নাকি বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য খন্দকার মোশাররফের পক্ষ থেকে ওই মেহমুদের সাথে দেখা করেছি। আরে ভাই, ড. খন্দকার মোশাররফ এবং আমার গ্রামের বাড়ি দাউদকান্দিতে হলেও তার সাথে আমার যে বিশেষ কোন প্রীতির সম্পর্ক নাই এটা বেগম খালোদ জিয়া সহ বিএনপির অনেকেই জানেন।
২০০১ থেকে ২০০৬ সাল সরকারে থাকতে খন্দকার মোশাররফ আমার বিরুদ্ধে নালিশ নিয়ে বেগম জিয়ার কাছে উপস্থিত হয়েছিলেন। আমাদের মধ্যে অপ্রীতিপূর্ন ডিও চালাচালিও হয়েছিল। সবচেয়ে বড় বিষয় হলো, আমি ভীষনভাবে স্বাধীনচেতা এবং একগুঁয়ে মানুষ। কারো পক্ষ হয়ে বিদেশী এজেন্টের সঙ্গে সাক্ষাৎ করা আমার চরিত্রের সাথে যায় না। এতদিনে দেশবাসীর আমার সম্পর্কে জানা হয়ে গেছে। অতএব, এসব মিথ্যাচার থেকে বিরত থাকুন।
সর্বশেষ কথা, বাংলাদেশে নাকি কী সব ডিজিটাল আইন হয়েছে। টেলিভিশন চ্যানেলে এইসব বানোয়াট ফোনালাপ ফাঁস কী ডিজিটাল আইন অনুযায়ী ফৌজদারী অপরাধের মধ্যে পড়ে? ফ্যাসিবাদের পতন হলে এই সব চ্যানেলের কর্তাব্যক্তিরা কোথায় থাকবেন তাই ভাবছি। এই সব মিথ্যাচার করে ফ্যাসিবাদ এবং ভারতীয় আধিপত্যবাদ বিরোধী লড়াই থেকে আমাকে নিবৃত করতে পারবেন না। বাংলাদেশের প্রকৃত দেশপ্রেমিক জনগন আমার পক্ষেই থাকবেন ইনশাআল্লাহ্ ।।
সম্পাদক, দৈনিক আমার দেশ।

সোমবার, ১৫ আগস্ট, ২০১৬

ইসলামী শিক্ষা আন্দোলনের অগ্রপথিক শহীদ আব্দুল মালেক -ড. মুহাম্মদ রেজাউল করিম


আমাদের বাংলাদেশ অনলাইন নিউজ ডেস্কঃ   আজকের এই দিনে ইসলামী শিক্ষাকে জাতীয় শিক্ষানীতি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে গিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী ছাত্র জনপ্রিয় ছাত্রনেতা আব্দুল মালেক ভাই সন্ত্রাসীদের হাতে ১৯৬৯ সালের ১২ আগষ্ট আহত হয়ে ১৫ আগষ্ট শাহাদাত বরণ করেন। 
একজন মানুষ এ ভূবনে স্ব-মহিমায়,জ্ঞানে,ধ্যানে,চিন্তা-চেতনায় কত উজ্জ্বল ভাস্বর হতে পারে শহীদ আব্দুল মালেক তারই এক জ্বলন্ত উদাহরণ হয়ে থাকবে অনাগত পৃথিবীর কাছে। একটি জাতির মেরুদণ্ড হলো শিক্ষা,সেই ইসলামী শিক্ষা আন্দোলনের অগ্রনায়ক,বীর সেনানী শহীদ আব্দুল মালেক। একটি উন্নত নৈতিক চরিত্র সম্পন্ন যুব -ছাত্রসমাজ ছাড়া একটি জাতির এগিয়ে যাওয়া অসম্ভব। এরাই জাতির মূল চালিকা শক্তি। শহীদ আব্দুল মালেক সেটি উপলব্ধি করেছেন বলেই তিনি শিক্ষাব্যবস্থার গোড়াপত্তনের ভিত্তি আবিস্কার করেছেন,সে লড়াইয়ে বিলিয়ে দিয়েছেন নিজের প্রাণ। এদেশ ঋণী হয়ে থাকবে শহীদ আব্দুল মালেকের আত্নার কাছে যুগের পর শতাব্দীর পর শতাব্দী। বিশেষ করে আজকের আধুনিকতার নামে নব্য জাহিলিয়াতের যাতাকলে পিষ্ট তরুণ প্রজন্মকে শহীদ আব্দুল মালেক দিয়েছেন এক অনন্য পথের দিশা। তাই আজকের নতুন প্রজন্মের কাছে শহীদ আব্দুল মালেক একটি প্রেরণা,একটি বিশ্বাস, একটি আন্দোলন,একটি ইতিহাস,একটি মাইলস্টোন। শহীদ আব্দুল মালেককে হত্যা করে ইসলামী আদর্শকে স্তদ্ধ করা যায়নি। বরং এক মালেকের রক্ত বাংলার ৫৬ হাজার বর্গমাইলের মধ্যে ছড়িয়ে একটি আন্দোলনের জন্ম দিয়েছে। লক্ষ-কোটি মালেক আজ একই আদর্শের ছায়াতলে সমবেত। সুতরাং শহীদ আব্দুল মালেকের খুনীরা আজ অভিশপ্ত, ঘৃণিত এবং পরাজিত। জাতি তাদের ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করেছে।
মূলত ইংরেজরা সুকৌশলে চিন্তার বিভ্রান্তি ও বিভাজন সৃষ্টির জন্যই সাধারণ শিক্ষা ও ধর্মীয় শিক্ষা এই দুই ধরনের শিক্ষা ব্যবস্থা চালু করে গিয়েছিল। স্কুল,কলেজ,বিশ্ববিদ্যালয়কে মাস্টার এবং ধর্মীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বা মাদরাসা থেকে মোল্লা তৈরির একটি ব্যবস্থা ইংরেজ সরকার প্রবর্তন করেন। লক্ষ্য ছিল জাতির উন্নতি অগ্রগতির মূল স্রোত থেকে মুসলমানদের আলাদা রাখা। অথচ আজাদী লাভের পর পরই প্রয়োজন ছিল দুই বিপরীত ধর্মী শিক্ষা ব্যবস্থার অবসান ঘটিয়ে একটি বহুমুখী সার্বজনীন শিক্ষা ব্যবস্থা চালু করা। সরকারি এই ভ্রান্তনীতির কারণেই শিক্ষা সংস্কারের বিষয়টি একটি জাতীয় ইস্যুতে পরিণত হয়। পাকিস্তান আমল থেকেই অনেকগুলো কমিশন গঠিত হয়। এসব শিক্ষা কমিশনের কোনো রিপোর্টে জাতীয় আদর্শ ইসলামের প্রতিফলন ঘটেনি। পক্ষান্তরে সেক্যুলার,নাস্তিক্যবাদী ও ধর্মবিমুখ সমাজতন্ত্রীরা মুসলিম জাতিসত্তার বিলোপ সাধন করে সেক্যুলারিজম বা ধর্মহীনতা চাপিয়ে দেয়ার জন্য সর্বাত্নক পদক্ষেপ গ্রহণ করে। যে ষড়যন্ত্র এখনো অব্যাহত। আজকের মতো সে সময়েও রাম-বাম আর সেক্যুলারিস্ট বুদ্ধিজীবীরা ইসলাম ধর্ম আর মুসলমানদের বিরোধিতা একটি কর্মসূচিতে পরিণত হয়। তা স্পষ্ট হয় ১৯১২ সালের ২ ফেব্রুয়ারি ভারত সরকার ঢাকায় একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দিলেন তখন। এই ঘোষণা হিন্দু সম্প্রদায়ের মধ্যে তীব্র ক্ষোভের সঞ্চার করে। শিক্ষা জাতির মেরুদণ্ড। মুসলমানরা শিক্ষিত হয়ে উঠলে মেরুদণ্ড সোজা করে দাঁড়াবে,তখন আর তাদের সেবাদাস করে রাখা যাবে না। এই ভয়ে রবীন্দ্রনাথের মতো মনীষী পর্যন্ত এর বিরোধিতা করেন। ১৯১২ সালের ২৮ মার্চ কলকাতায় গড়ের মাঠে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ করে তারা সভা করলো। এই সভায় সভাপতিত্ব করেন স্বয়ং বিশ্বকবি। তার মুসলমান প্রজারা শিক্ষিত হয়ে উঠলে জমিদারের শাসন ও শোষণ চালানো হয়ত বাধাগ্রস্ত হবে,এই ভয়ে তিনি চাননি মুসলমানরা শিক্ষিত হয়ে উঠুক। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিরুদ্ধে হিন্দু সংবাদপত্রগুলো বিষোদগার করতে থাকে। বাবু গিরীশচন্দ্র ব্যানার্জী,ড. স্যার রাম বিহারী ঘোষ এবং কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর স্যার আশুতোশ মুখার্জীর নেতৃত্বে বাংলার এলিটগণ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিরুদ্ধে ১৮ বার স্মারকলিপি সহকারে তদানীন্তন ভাইসরয় লর্ড হার্ডিঞ্জের উপর চাপ সৃষ্টি করেছিলেন। বড়লাটের কাছে এই বলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিরুদ্ধে যুক্তি প্রদর্শন করলেন যে,পূর্ব বাংলার মুসলমানগণ অধিকাংশই কৃষক। অতএব,বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করলে তাদের কোনো উপকার হবে না। ঢাকার হিন্দুরা পর্যন্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিরোধিতা করতে লাগলেন। ‘এ হিস্ট্রি অব ফ্রীডম মুভমেন্ট’গ্রন্থে তারই উল্লেখ আছে।
কিন্তু সকল যড়যন্ত্র আর বিরোধিতা ছাপিয়ে প্রাচ্যের অক্সফোর্ড এখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়,আর ইসলামী শিক্ষা আন্দোলনের অগ্রপথিক এখন শহীদ আব্দুল মালেক। সুতরাং শহীদ আব্দুল মালেক আজ একটি সফল আন্দোলনের নাম। একটি প্রেরণার বাতিঘর। যে ঘরে আশ্রয় নেয়া তরুণ-যুবক, বৃদ্ধ-বনিতা সবার উপলদ্ধি আর শূন্যতা যেখানে, শহীদ আবদুল মালেক ১৯৬৯ এর ২ আগস্ট ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে নিপা আয়োজিত মুক্ত আলোচনা সভায় Milton প্রদত্ত শিক্ষার সংজ্ঞাটির বিশ্লেষণ করেছেন ঠিক এভাবেই- ‘Harmonious development of body, mind and soul কখনো কোনো আদর্শের ভিত্তি ছাড়া হতে পারে না।’ এই উচ্চারণ এখন জাতীয় শ্লোগানে পরিণত হয়েছে। সেই কালজয়ী শ্বাসত বিধান আল-ইসলাম। সেরা দায়ীর উজ্জ্বল নজির স্থাপন করেছেন শহীদ আব্দুল মালেক। আজকের আধুনিক পৃথিবী এ কথাই প্রমাণ করছে যে মানুষের শান্তির জন্য প্রধান হুমকি অনুন্নয়ন ও দরিদ্রতাই নয় বরং অনৈতিকতাও একটি বড় সমস্যা। Morality, Manner বা Ethics.আর সেই জিনিস মানুষের মধ্যে কেবলমাত্র জাগ্রত করতে পারে ইসলামী শিক্ষা। পশ্চিমারা তার গগণচুম্বী উন্নতি, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির দূরতিক্রম্য অগ্রযাত্রা সত্ত্বেও মানবিকতার এক করুণ সঙ্কট (Crisis) মোকাবেলা করছে। Education does not necessary mean mare acquisition of Degrees and Diplomas. It emphasizes he need for acquisition of knowledge to life a worthy life. শিক্ষার উদ্দেশ্য শুধুমাত্র কিছু ডিগ্রি বা ডিপ্লোমা অর্জন নয় বরং সম্মানজক জীবন যাপনের জন্য প্রয়োজনীয় জ্ঞান অর্জন।’
আমরা শিক্ষাব্যবস্থাকে ধর্ম ও নৈতিকতাবিহীন একটি কারখানায় পরিণত করেছি। ধর্মবোধ তথা স্রষ্টার প্রতি আনুগত্যই মানুষকে দায়িত্ববোধ সম্পন্ন,কর্তব্যনিষ্ঠ,ন্যায়পরায়ণ,সৎকর্মশীল,জবাবদিহিতা ও বিনীয় হতে শেখায়। বিখ্যাত মনীষী Sir Stanely Hull -এর মতে, ‘If you teach your children three R’s : Reading, Writing and Arithmetic and leave the fourth ‘R’ : Religion, then you will get a fifth ‘R’ : Rascality.’ অর্থাৎ ‘যদি আপনি আপনার শিশুকে শুধু তিনটি ‘R’ (Reading, Writing, Arithmetic) তথা পঠন,লিখন ও গণিতই শেখান কিন্তু চতুর্থ ‘R’ (Religion) তথা ধর্ম না শেখান তাহলে এর মাধ্যমে আপনি একটি পঞ্চম ‘R’ (Rascality) তথা নিরেট অপদার্থই পাবেন।
আলবার্ট সিজার তার Teaching of Reference of or Life গ্রন্থে শিক্ষা সংক্রান্ত আলোচনা রাখতে গিয়ে বলেছেন, ‘Three kinds of progress are significant. These are progress in knowledge and technology, progress in socialization of man and progress in spirituality. The last one is the most important’.তার ভাষায় ‘আধ্যাত্মিকতার বিকাশই হচ্ছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।’তাহলে আমরা সামগ্রিকভাবে বলতে পারি যে,শিক্ষার ল্য হচ্ছে আমাদের আত্মার বিকাশ,আধ্যাত্মিকতার বিকাশ,মানসিক বিকাশ। শিক্ষা মানুষকে মনুষ্যত্ব দান করে,মানুষ হিসেবে গড়ে তোলে,চরম সভ্যতায় উন্নীত করে,পরম আলোকে পৌঁছে দেয়। শহীদ মালেক সেদিন ক্ষুরধার তথ্য ও যুক্তিপূর্ণ উপায়ে ইসলামী শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরেছেন।
মহাগ্রন্থ আল-কুরআনে আল্লাহ তায়ালা এরশাদ করেছেন,“মানুষ কি মনে করেছে,আমরা ঈমান এনেছি এ কথা বললেই তাদেরকে ছেড়ে দেয়া হবে আর তাদের পরীক্ষা করা হবে না?” আব্দুল মালেক শহীদ তাঁর জীবনের প্রতিটি পরতে পরতে সেই পরীক্ষাই দিয়ে গেছেন। সারাটা জীবন কষ্ট করেছেন। আর্থিকভাবে খ্বুই অসচ্ছল একটি সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে বগুড়া জেলায় এই ক্ষণজন্মা নক্ষত্র আবিভূত হয়েছিল। জীবন যাপনের অতি প্রয়োজনীয় উপকরণ থেকেও তিনি ছিলেন বঞ্চিত। কিন্তু তিনি ছিলেন মোহমুক্ত। সেই কচি বয়সে তাঁর মায়ের কোলে থাকার পরিবর্তে তিনি বাড়ি থেকে অনেক দূরে লজিং থেকেছেন। দীর্ঘ পথ পায়ে হেঁটে আর সাতরিয়ে স্কুলে যেতে হয়েছে তাকে। ক্ষুধার যন্ত্রণা, অমানুষিক পরিশ্রম কিংবা দুঃখ-কষ্টের দিনযাপন কোনো কিছুই পিচ্ছিল করতে পারেনি তাঁর চলার পথ। “অহংকার হচ্ছে আল্লাহর চাদর” প্রিয়নবী (সা.) এই হাদীসের বাস্তব উদাহরণ ছিলেন শহীদ আব্দুল মালেক। তাঁর বুদ্ধিবৃত্তিক শ্রেষ্ঠত্ব সত্ত্বেও মনের দিক থেকে ছিলেন একেবারেই নিরহঙ্কার। এসএসসি,ও এইচএসসিতে মেধা তালিকায় স্থান আর ঢাবি সেরা ছাত্রের পোশাক বলতে ছিল একটি কমদামী সাদা পাজামা ও পাঞ্জাবী যাতে ইস্ত্রির দাগ কেউ কখনো দেখেছে বলে জানা যায় না। শহীদ আব্দুল মালেক প্রাণ দিয়ে ভালোবাসতেন তাঁর কর্মীদের। সে ভালোবাসা ছিল নিখাদ নিঃস্বার্থ। জনাব ইবনে মাসুম লিখেছেন :” তিনি ছিলেন তাদের দুঃখ-বেদনার সাথী। তাঁর এই আন্তরিকতার জন্য অনেক কর্মীর কাছে তিনি ছিলেন অভিভাবকের মতো। কর্মীর যোগ্যতাকে সামনে রেখে উপদেশ দিতেন,অনুপ্রেরণা যোগাতেন প্রতিভা বিকাশে। ভাবতে অবাক লাগে,প্রতিটি কর্মী সম্পর্কে তিনি নোট রাখতেন। প্রতিটি কর্মীর ব্যাপারে নিজের ধারণা লেখা থাকতো তাঁর ডাইরিতে। এমনিভাবে ভাবতেন তিনি কর্মীদের নিয়ে। ফলে কর্মীদের কাছে তিনি ছিলেন প্রিয় মালেক ভাই,একজন অভিভাবক,একজন নেতা।” মালেক ভাই হয়ত কাস করছেন,সময় পেলে পড়ছেন। এরপর আন্দোলনের কাজের জন্য বিভিন্ন জায়গায় ছুটে চলছেন। রাতে হয়তো পোস্টারও লাগাচ্ছেন কর্মীদের সাথে। আবার অনেক সময় পোস্টার লাগাবার পর অন্যান্যদের কাজ শেষ করার পূর্ব পর্যন্ত একটু সময় পেতেন,তখন সিঁড়িতে ঠেস দিয়ে অথবা পীচঢালা নির্জন পথে একটু বসে বিশ্রাম নিতেন।” নূর মুহাম্মদ মল্লিক লিখেছেন,-”সারাদিন কাজ করে রাতের বেলায় তাঁর নিজের হাতে কান্ত শরীরে সেই একমাত্র পাজামা পাঞ্জাবী ধোয়া রুটিন কাজের কথা। কোনো এক রাতে সেটি ধোয়া সম্ভব হয়নি বলে সকালে ধোয়া পাঞ্জাবী আধা ভেজা অবস্থায় গায়ে জড়িয়ে মালেক ভাই গিয়েছিলেন মজলিসে শূরার বৈঠকে যোগ দিতে। মালেক ভাইয়ের পোশাক যেমন সাধাসিধে ছিল,দিলটাও তেমন সাধাসিধে শুভ্র মুক্তার মত ছিল। প্রাণখোলা ব্যবহার তাঁর চরিত্রের অন্যতম বৈশিষ্ট্য।” প্রতিকূল পরিবেশকে নিজের অনুকূলে নিয়ে আসা নেতৃত্বের যোগ্যতার অন্যতম উপাদান। আর প্রতিকূলতাকে জয় করার নামই তো আন্দোলন। এই কাজের জন্য চাই অসাধারণ বুদ্ধিমত্তা ও প্রত্যুৎপন্নমতিত্ব। শহীদ আব্দুল মালেক ছিলেন তার জীবন্ত ইতিহাস। তার অসাধারণ কর্মকাণ্ডের তুলনা যেন তিনি নিজেই।
ভাষা সৈনিক মরহুম অধ্যাপক গোলাম আযম লিখেছেন- “শহীদ আব্দুল মালেক তরুণ বয়সেই এমন এক উজ্জ্বল নজির রেখে গেছেন যা এদেশে ইসলামী আন্দোলনের কর্মীদেরকে চিরদিন প্রেরণা যোগাবে। এতগুলো গুণ একজন ছাত্রের মধ্যে এক সাথে থাকা অত্যন্ত বিরল। একজন মেধাবী ছাত্র হিসেবে শিক্ষক ও ছাত্র মহলে তার সুখ্যাতি সত্ত্বেও তার নিকট ছাত্রজীবন থেকে আন্দোলনের জীবনই বেশী প্রিয় ছিল। যথাসম্ভব নিয়মিত কাসে হাজির হওয়াই যেন তার জন্য যথেষ্ট ছিল। পরীক্ষায় ভাল করার জন্য তার মধ্যে কোনো ব্যস্ততা ছিলনা। ওটা যেন অতি সহজ ব্যাপার ছিল। কাসের বাইরে তাঁকে ইসলামী আন্দোলন ছাড়া অন্য কোনো চিন্তাধারা বা আলাপ-আলোচনা করতে বড় একটা দেখা যেত না। তার সহপাঠী ও সহকর্মীরা তাকে পরীক্ষায় খুব ভাল ফল করার দিকে মনোযোগী হওয়ার পরামর্শ দিলে মৃদু হেসে বলতেন,বেঁচে থাকার প্রয়োজনে ডিগ্রি নিতে হবে যাতে আয়-রোজগারের একটা পথ হয়। কিন্তু ওটাকে জীবনের চরম লক্ষ্য বানিয়ে নিতে চাই না। খুব ভাল রেজাল্টের ধান্ধা করলে ক্যারিয়ার গড়ে তুলবার নেশায় পেয়ে বসবার আশঙ্কা আছে। আব্দুল মালেকের শাহাদাত আর পরবর্তী শাহাদাতের তুলনা করলে এটাই দেখি একজন নেতৃস্থানীয় ব্যক্তির শাহাদাতের ফলে যে ধরনের প্রতিক্রিয়া হয়েছিল,ঐ ধরনের প্রতিক্রিয়া পরবর্তীদের ক্ষেত্রে হয়নি। আন্দোলন যখন শক্তি সঞ্চয় করেছে মাত্র তখন একজন নেতৃস্থানীয় ব্যক্তির শাহাদাত আন্দোলনের শক্তি বহুগুণ বাড়িয়ে দিয়েছিল।” আর আজকের এ সময়ে শহীদ আবদুল কাদের মোল্লার শাহাদাত বিশ্বমুসলিম উম্মাহর প্রেরণার উচ্চতর মিনার রচনা করতে সক্ষম হয়েছে,আলহামদুলিল্লাহ।
১৯৬৯ সালে ইসলামী ছাত্রসংঘের এ সাংগঠনিক ক্রান্তিকালে শহীদ আব্দুল মালেকের ভূমিকা সম্পর্কে শহীদ মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী লিখেছেন,“দায়িত্বশীল ব্যক্তিদের সবাই স্বীকার করেছেন,ব্যাপারটা আমাদের সাংগঠনিক শৃংখলার সম্পূর্ণ পরিপন্থি। কিন্তু একে স্থায়ীভাবে প্রতিহত করার জন্য কোনো পদক্ষেপ নিতে কেউই সাহস পাচ্ছে না। আমার কাছে ব্যাপারটা অত্যন্ত পরিষ্কার ছিল। ঢাকা এবং পূর্ব-পাক সংগঠনের নেতৃত্বকে দূর্বল এবং অসহায় মনে করে সংগঠনকে ক্ষতিগ্রস্থ করার মানসে কিছু সংখ্যক অ-কর্মী কর্মী সেজে এ অপচেষ্টা চালাচ্ছে। বলিষ্ঠ পদক্ষেপ নিয়ে এগুলো দমন করার জন্য যখন দায়িত্বশীল কর্মীদের রাজী করাতে পারিনি, তখন দায়িত্ব ছেড়ে সরে পড়ার মনোভাব আমার প্রবল হয়েছিল। ‘আমার হাতে সংগঠন ক্ষতিগ্রস্থ হওয়ার আগে আমি সরে পড়ি,তারপর যাদের উপর দায়িত্ব আসবে তারা পারলে সংগঠনকে বাঁচাবে নতুবা নিজেরাই দায়ী হবে’ এমন বাজে চিন্তা আমার মধ্যে একাধিকবার এসেছে। সংগঠন জীবনে এ ছিল আমার সবচেয়ে দূর্বল মুহুর্ত। আব্দুল মালেকের একক হস্তক্ষেপে সেদিন দরবেশী কায়দায় এহেন শয়তানী ওয়াসওয়াসা থেকে আমি রক্ষা পেয়েছিলাম।” 
শহীদ আব্দুল মালেক ছিলন একটি চলমান ইনসাকপিডিয়া। জানতে হলে পড়তে হয়। অধ্যয়নের কোনো বিকল্প নেই। শহীদ আব্দুল মালেক এ বিষয়ে আমাদের সকলের জন্য অনুকরণীয় আদর্শ। আন্দোলনী কর্মকাণ্ডের শত ব্যস্ততা মালেক ভাইয়ের জ্ঞানার্জনের পথে কোনো বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারেনি। এমনকি আর্থিক সঙ্কট সত্ত্বেও তিনি নাশতার পয়সা বাঁচিয়ে বই কিনতেন, সংগঠনের এয়ানত দিতেন। অথচ তাঁর রেখে যাওয়া এই দেশের ইসলামী আন্দোলনের অধিকাংশ নেতা কর্মীই এক্ষেত্রে দুঃখজনকভাবে পিছিয়ে আছেন। শ্রদ্ধেয় কৃতী শিক্ষাবিদ ড. কাজী দীন মুহাম্মদ-এর স্মৃতিচারণ থেকে আমরা জানতে পারি,শত ব্যস্ততার মাঝেও জ্ঞানপিপাসু আব্দুল মালেক দীন মুহম্মদ স্যারের কাছে মাঝে মধ্যেই ছুটে যেতেন জ্ঞানের অন্বেষায়। ইসলামী আন্দোলন করতে হলে নানা বিষয়ে জ্ঞান থাকতে হয়। কুরআন- হাদীস,অর্থনীতি,রাজনীতি,ব্যবসা-বাণিজ্য,ব্যাংকিং-বীমা,সমাজনীতি,বিচারব্যবস্থা,আন্তর্জাতিক সম্পর্ক ইত্যাদি মরহুম আব্বাস আলী খান এ প্রসঙ্গে এক স্মৃতিচারণমূলক প্রবন্ধে বলেন : “বিশ্ব পরিস্থিতি সম্পর্কে তাঁর পাকা হাতের লেখা পড়তাম মাসিক পৃথিবীতে। বয়স তখন তাঁর উনিশ-বিশ বছর। একেবারে নওজোয়ান। কিন্তু তার লেখার ভাষা ও ভঙ্গী বিশ্ব পরিস্থিতি সম্পর্কে তাঁর তীক্ষè ও গভীর জ্ঞান তাঁর প্রতি এক আকর্ষণ সৃষ্টি করে।” জনাব কামারুজ্জমান লিখেছেন-রাতে ঘুমানোর আগে দেখতাম মালেক ভাই ইংরেজি একটি ম্যাগাজিনের পাতা উল্টাচ্ছেন। আবার কিছু কিছু নোট করছেন। তিনি মাসিক পৃথিবীতে চলমান বিশ্ব পরিস্থিতির উপর লিখতেন। বুঝলাম সেই লেখার জন্য মালেক ভাই প্রস্তুতি নিচ্ছেন। তখন থেকেই বিদেশী ম্যাগাজিন পড়ার ব্যাপারে আমার মধ্যে আগ্রহের সৃষ্টি হয়। মালেক ভাইয়ের অনেক স্মৃতি আমাদের তাড়িয়ে বেড়ায়।
যুগে-যুগে নবী-রাসূল (সা.) সাহাবায়ে আজমাইন,আর সত্যপথের পথিকদের যে কারণে বাতিলরা হত্যা ঠিক একই কারণে শহীদ আব্দুল মালেক,শহীদ আবদুল কাদের মোল্লা,সাইয়েদ কুতুব আর হাসাল আল-বান্নাকে হত্যা করা হয়েছে। তারা সারা পৃথিবীর মানুষের প্রেরণা। তারা মরেও অমর। তারা এক অনন্য জীবনের সন্ধান পেয়েছে, সেই অনন্ত জীবনের নাম শাহাদাত। চিঠিতে তিনি স্পষ্ট করে সেই নিঃস্বার্থ ও নির্মোহ সিদ্ধান্তের কথাই বলেছেন শহীদ আব্দুল মালেক,“বাইরের পৃথিবীতে যেমন দ্বন্দ্ব চলছে তেমনি আমার মনের মধ্যেও চলছে নিরন্তর সংঘাত। আমার জগতে আমার জীবনে আমি খুঁজে নিতে চাই এক কঠিন পথ,জীবন-মরণের পথ। মায়ের বন্ধন ছাড়া আমার আর কিছুই নেই। বৃহত্তর কল্যাণের পথে সে বন্ধনকে ছিঁড়তে হবে। কঠিন শপথ নিয়ে আমার পথে আমি চলতে চাই। আশির্বাদ করবেন। সত্য প্রতিষ্ঠার এ সংগ্রামে যেন আমার জীবনকে আমি শহীদ করে দিতে পারি। আমার মা এবং ভাইরা আশা করে আছেন আমি একটা বড় কিছু হতে যাচ্ছি। কিন্তু মিথ্যা সে সব আশা। আমি বড় হতে চাইনে, আমি ছোট থেকেই সার্থকতা পেতে চাই। বিশ্ববিদ্যালয়ের সেরা ছাত্র হয়ে বিলেত ফিরে যদি বাতিলপন্থীদের পিছনে ছুটতে হয় তবে তাতে কি লাভ?
জাতির এই শ্রেষ্ঠ সন্তানের বিদায়ে কেঁদেছে গোটা জাতি। দলমত নির্বিশেষে সবাই এই হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদ ও তীব্র নিন্দা জানিয়েছে। সে সময়ের সংবাদ পত্র তার সাক্ষী। মরহুম শেখ মুজিবুর রহমানসহ সকল জাতীয় নেতারা নিন্দা ও ক্ষোভ জানিয়েছিল। আওলাদে রাসুল শহীদ আব্দুল মালেকের জানাজার পূর্বে আবেগ-আপ্লুত কণ্ঠে বলেছিল- “শহীদ আব্দুল মালেকের পরিবর্তে আল্লাহ যদি আমাকে শহীদ করতেন তাহলে আমি নিজেকে ধন্য মনে করতাম। শহীদ আব্দুল মালেকের শাহাদাতী তামান্নার তীব্রতা প্রতিধ্বনিত হয়েছে সাবেক লজিং মাস্টার জনাব মহিউদ্দিন সাহেবের কাছে লেখা চিঠির ভাষায়- “জানি,আমার কোনো দুঃসংবাদ শুনলে মা কাঁদবেন। কিন্তু উপায় কি বলুন? বিশ্বের সমস্ত শক্তি আল্লাহর দেয়া জীবন বিধানকে পৃথিবীর বুক থেকে মুছে ফেলার চেষ্টা করছে। আমরা মুসলমান যুবকরা বেঁচে থাকতে তা হতে পারে না। হয় বাতিলের উৎখাত করে সত্যের প্রতিষ্ঠা করবো,নচেৎ সে চেষ্টায় আমাদের জীবন শেষ হয়ে যাবে। আপনারা আমায় প্রাণভরে আশির্বাদ করুন,জীবনের শেষ রক্তবিন্দু দিয়েও যেন বাতিলের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করতে পারি। কারাগারের নিরন্দ্র অন্ধকার,সরকারি যাঁতাকলের নিষ্পেষণ আর ফাঁসির মঞ্চও যেন আমাকে ভড়কে দিতে না পারে।” শহীদ আব্দুল মালেকের হত্যাকারীদের বিচার এখনো হয়নি। এই দুনিয়ার আদালতে তাদের বিচার না হলেও আল্লাহর আদালত থেকে তারা রেহাই পাবেনা এটাই আমাদের বিশ্বাস। শহীদ আব্দুল মালেকের খুনীরা অনেকেই এখন রাষ্ট্রযন্ত্রের অনেক গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় অধিষ্ঠিত। শহীদ আব্দুল মালেকের হত্যার প্রতিশোধ তার উত্তরসূরীরা এই জমিনে কালেমার পতাকা উড্ডীন করার মাধ্যমে গ্রহণ করবে,ইনশাল্লাহ। 
হে! আরশের মালিক, শহীদ আব্দুল মালেক এবং তাঁর সহযোদ্ধা শহীদ মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী সহ সকল শহীদদের জান্নাতুল ফেরদাউস দান করুন। আমীন।

About

ব্লগ সংরক্ষাণাগার

আমার ব্লগ তালিকা

Translate

Translate

আমাদের বাংলাদেশ নিউজ 24

সর্বশেষ

অনুসরণকারী