সূরা বাকারাহ, আয়াত ৯৯-১০১
প্রারম্ভিকাঃ
আলোচ্য আয়াতগুলো মহাগ্রন্থ আলকুরআনের সূরা আল বাকারাহ এর ৯৯,১০০ ও ১০১ নং আয়াত।৯৯ নং আয়াতে আল কুরআনও রাসূল(সাঃ) এঁর মহিমা বর্ণনা করা হয়েছে এবং ১০০ ও ১০১ নং আয়াতে ইহুদীদের চরিত্র উম্মোচন করা হয়েছে।নিম্নে আমরা কয়েকটি প্রসিদ্ধ তাফসীর গ্রন্থের আলোকে আয়াতগুলো অধ্যয়নান্তে এর অন্তর্নিহিত শিক্ষা বুঝে নেবার প্রয়াস পাবো ইনশাআল্লাহ।
আয়াতঃ৯৯
অনুবাদঃ
"আমি তোমার প্রতি এমন সব আয়াত নাযিল করেছি যেগুলো দ্ব্যর্থহীন সত্যের প্রকাশে সমুজ্জ্বল। একমাত্র ফাসেক গোষ্ঠী ছাড়া আর কেউ তার অনুগামিতায় অস্বীকৃতি জানায়নি।"
তাফসীর পড়ে যা বুঝলামঃ
আলোচ্য আয়াতে আলকুরআন ও রাসূল (সাঃ) এঁর মহিমা বর্ণনা করে বলা হয়েছে যে, রাসূল (সাঃ)এঁর প্রতি যে আয়াত, নিদর্শন বা Sign গুলো নাজেল করা হয়েছে সেগুলো সত্য প্রকাশে সমুজ্জ্বল সাক্ষ্য।মূলতঃ ফাসিকরা তা মানতে পারে না।
তাফসীর ইবনে কাসীরঃ
বলা হচ্ছে, হে মুহাম্মদ(সাঃ) আমি এমন এমন নিদর্শনাবলী তোমার উপর অবতীর্ণ করেছি যা তোমার নবুয়তের জন্য প্রকাশ্য দলীল।ইয়াহুদীদের বিশেষ জ্ঞান ভান্ডার,তাওরাতোর গোপনীয় কথা,তাদের পরিবর্তন কৃত আহকাম ইত্যাদি সব কিছুই আমি অলৌকিক কিতাব আলকুরআন মজীদে বর্ণনা করেছি।ওটা শুনে প্রত্যেক জীবিত অন্তর তোমার নবুয়তের সত্যতা স্বীকার করতে বাধ্য হয়।তবে ইহুদীরা যে হিংসা বিদ্বেষ বশতঃ মানছে না ওটা অন্য কথা।নতুবা প্রত্যেক লোকই বুঝতে পারে যে,একজন নিরক্ষর লোক কখনো এরকম পবিত্র অলংকার ও নিপূনতাপূর্ণ কথা বানাতে পারে না।'
ইয়াহুদীদের নিকট শেষ নবী (সাঃ)কে স্বীকার করার উপর অংগীকার নেওয়া হয়েছিলো তা অস্বীকার করেছিলো বলে আল্লাহ তাআলা বলেন যে,অংগীকার ভঙ্গ করা এটাতো ইহুদীদের চিরাচরিত অভ্যাস,বরং তাদের অধিকাংশের অন্তরইতো ঈমান শূণ্য।
ফাসিক কারাঃ
যারা সত্য স্বীকার করে কিন্তু কার্যতঃ মানেনা তারাই ফাসিক।
ফাসিক আরবী শব্দ ফিসক থেকে এসেছে যার অর্থ অবাধ্য।এরা জানে কিন্তু মানেনা।হীন দুনিয়াবী স্বার্থে ফাসিকরা জেনে বুঝেই সত্য গোপন করে।
তওবা নসূহা করে মরতে না পারলে ফাসিকরাও জাহান্নামী হবে।
আয়াতঃ১০০
অনুবাদঃ
"যখনই তারা কোন অঙ্গীকার করেছে তখনই কি তাদের কোন না কোন উপদল নিশ্চিতরূপেই তার বুড়ো আঙুল দেখায়নি? বরং তাদের অধিকাংশই সাচ্চা দিলে ঈমান আনে না।"
তফসীর পড়ে যা বুঝলামঃ
আলোচ্য আয়াত টিতে বনি ইসরাইলদের সম্পর্কে বলা হয়েছে তারা যখনই অঙ্গীকার করেছে তখনই তাদের এক দল তা ভঙ্গ করেছে।অথচ তারা নিজদেরকে ঈমানদার দাবী করে।তাদের এই নাম সর্বস্ব ঈমানের কোন দাম নেই।
তাফসীর বয়ানুল কুরআনঃ
মুহাম্মদ(সাঃ) ও কুরআন আবির্ভূত হলে তাঁর প্রতি ঈমান আনার জন্য তাওরাতে ইহুদীগণ হতে গৃহিত ওয়াদা তাদেরকে স্মরণ করিয়ে দিলে তারা সেওয়াদা পরিস্কার অস্বীকার করে বসলো।এ আয়াতে তা ই বর্ণিত হয়েছে।
আয়াত ১০১
অনুবাদঃ
"আর যখনই তাদের কাছে পূর্ব থেকে রক্ষিত কিতাবের সত্যতা প্রমাণ করে ও তার প্রতি সমর্থন দিয়ে কোন রসূল এসেছে তখনই এই আহলি কিতাবদের একটি উপদল আল্লাহর কিতাবকে এমনভাবে পেছনে ঠেলে দিয়েছে যেন তারা কিছু জানেই না।"
তাফসীর পড়ে যা বুঝলামঃ
আল কুরআন পূর্ববর্তী সকল কিতাবের সত্যায়ন কারী।তাওরাত, যাবুর এবং ইঞ্জিলেরও সত্যায়ন কারী।কুরআন প্রকাশিত হবার পর বনি ইসরাইলগণ এমন ভাবে তা অস্বীকার করছে যেন তারা তাদের অঙ্গীকার সমূহ সম্পর্কে কিছুই জানে না।
তাফসীর বয়ানুল কুরআনঃ
শেষ নবী হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) এঁর আগমনের পর তাঁর উপর ঈমান আনার ব্যাপারে আল্লাহ তা'আলা ইহুদী ও নাসারাদের নিকট থেকে যে প্রতিশ্রুতি গ্রহন করেছিলেন তাওরাত ও ইঞ্জিলে তার উল্লেখ রয়েছে।ইঞ্জিলে নবীজীকে আহমাদ নামে উল্লেখ করা হয়েছে।একবার নবীজী ইহুদী পন্ডিত মালিক ইবনে সায়িফকে সে প্রতিশ্রুতির কথা স্মরণ করিয়ে দেন।তখন সে শপথ করে বলে, কোথায় মুহাম্মদ সম্পর্কে আমাদের নিকট হতে কোন প্রতিশ্রুতি নেওয়া হয়নিতো! তার এ অস্বীকৃতির জবাবে আলোচ্য আয়াতটি নাজেল হয়।
তাফসীর আহসানুল বয়ানঃ
মহান আল্লাহ নবী করীম (সাঃ)-এর প্রতি ইঙ্গিত করে বলছেন যে, আমি রসূলকে বহু উজ্জ্বল নিদর্শনাবলী দান করেছি; যা দেখে ইয়াহুদীদেরও ঈমান আনা উচিত ছিল। তাছাড়া তাদের কিতাব তাওরাতেও তার গুণাবলীর উল্লেখ এবং তার উপর ঈমান আনার অঙ্গীকার রয়েছে, কিন্তু তারা পূর্বে কি কোন অঙ্গীকারের কোনই পরোয়া করেছে যে, এই অঙ্গীকারেরও করবে? অঙ্গীকার ভঙ্গ করা তাদের একটি দলের অভ্যাসই ছিল। এমন কি আল্লাহর কিতাবকেও তারা পশ্চাতে নিক্ষেপ করল; যেন তারা তা (আল্লাহর বাণী বলে) জানেই না।
আল কুরআন অধ্যয়নে আমরা জানতে পারি আল্লাহ বনি ইসরাইলদের থেকে নিম্মোক্ত অঙ্গীকার সমূহ নিয়ে ছিলেন-
১. আল্লাহর কিতাবকে শক্ত ভাবে আঁকড়ে ধরার অঙ্গীকার
২.কিতাবে যে সকল বিধান রয়েছে তা মেনে চলার অঙ্গীকার
৩.আল্লাহ ছাড়া আর কারো ইবাদত না করার অঙ্গীকার
৪.মা বাবার সাথে ভালো ব্যবহারের অঙ্গীকার
৫.আত্মীয়ের সাথে ভালো ব্যবহারের অঙ্গীকার
৬.ইয়াতিমের সাথে ভালো ব্যবহারের অঙ্গীকার
৭.মিসকিনের সাথে ভালো ব্যবহারের অঙ্গীকার
৮.সকল মানুষের সাথে ভালো আচরণের অঙ্গীকার
৯.নামাজ কায়েমের অংঙ্গীকার
১০.যাকাত আদায়ের অঙ্গীকার
১১.পরস্পরকে হত্যা না করার অংঙ্গীকার
১২.পরস্পরকে গৃহচ্যুত না করার অঙ্গীকার
শিক্ষনীয়ঃ
আলকুরআনের আলোচ্য আয়াত গুলো থেকে আমাদের জন্য নিন্মোক্ত শিক্ষনীয় বিষয় রয়েছে-
আল কুরআন নিরংকুশ সত্যের স্বাক্ষ্যবাহী এক ও একমাত্র কিতাব।ইহা পরম সত্য ও বিগত সত্যের সত্যায়নকারী।আলকুরআনের নির্ভুল জ্ঞানের একমাত্র উৎস।আলকুরআন মহান আল্লাহর অমীয় বাণী ও বিশ্ব মানবতার অবশ্যপালনীয় সংবিধান।আল কুরআনকে ধারণ করেই কেবল দুনিয়া আখিরাতের সার্বিক সফলতা সম্ভব।
আল কুরআনে অবিশ্বাসীরা ফাসিক,কাফির,জালিম,জাহিল।অবিশ্বাসী অবস্থায় মৃত্যু বরণকারীর পরিণাম নিশ্চিত জাহান্নাম।
বনি ইসরাইলগণ এক ভয়ানক পাপী জাতির উদাহরণ।অঙ্গীকার ভঙ্গ করা তাদের বৈশিষ্ট্য।সূচনালগ্ন থেকে অধ্যাবদি তারা তাদের গৃহিত ছোট বড় সকল অঙ্গীকারই ভঙ্গ করে চলেছে।
পরিশেষঃ
বনি ইসরাইল তথা ইহুদী খৃষ্টানদের সত্য প্রত্যাখ্যানের প্রবনণতা চিরন্তন।তারা কেবল সত্য প্রত্যাখ্যান ই করে না বরং সত্য পন্থীদের বিরুদ্ধে নানামুখি ষড়যন্ত্রেও লিপ্ত থাকে।তারা কোন অঙ্গীকারই রক্ষা করে না।তারা নিচক দুনিয়াদার।দুনিয়াবী হীন স্বার্থ,মূর্খতা ও অহংকার বশতঃ তারা ইসলাম ও মুহাম্মদ (সাঃ)কে অস্বীকার করে কুফরীতে লিপ্ত রয়েছে।
বনি ইসরাইলদের ঘটনাবলী ও ইতিহাসকে আলকুরআনে মুসলিমদের জন্য শিক্ষনীয় করা হয়েছে।
আজকের নামধারী মুসলিমরাও আলকুরআনকে বেমালুম ভুলে রয়েছে।তাদের সংবিধান,রাষ্ট্র পরিচালনা, আইন, বিচার কোথাও আজ আলকুরআন মানা হয় না।যে জাতি জীবনের সকল ক্ষেত্রে কুরআন মানে না সে জাতি মুসলিম হতে পারে না।
তাই আমাদের উচিত আমাদের ঈমানী জেন্দেগীর অবস্থা পূনর্বিবেচনা করা।যে টুকু ঈমান আর ঈামানী জেন্দেগীর দুরাবস্থা নিয়ে আমরা নিজেদের মুসলিম দাবী করছি তা যেন বনি ইসরাইলদের ঈমানের দাবীর মতো অসার ও বাস্তবতা বিবর্জিত প্রমাণিত না হয়।
আল্লাহ আমাদেরকে আলকুরআনের বাস্তব অনুসারী হিসাবে কবুল করুন।আমিন
মামুন প্লাবন
৬/২/২১ঈসাব্দ
ঢাকা।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন