বাংলাদেশ শিপিং কর্পোরেশনের জন্য বিদেশ থেকে ৬টি জাহাজ কিনতে গিয়ে ব্যাপক অনিয়ম ও দুর্নীতির আশ্রয় নিচ্ছে নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয়। প্রকৃত দামের চেয়ে প্রায় ২২৩ কোটি টাকা বেশি দামে জাহাজ ক্রয়ের বাণিজ্যিক চুক্তি করা হয়েছে। তাও অনভিজ্ঞ এক প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে এই জাহাজ সরবরাহ করা হচ্ছে। গত বছরের ৩০ এপ্রিল বাণিজ্যিক চুক্তি স্বাক্ষরের পর অন্যান্য সকল আনুষ্ঠানিকতা এখন সম্পন্নপ্রায়। আর্থিক চুক্তির প্রক্রিয়া চলছে বর্তমানে। এই জাহাজ ক্রয়কে কেন্দ্র করে এ পর্যন্ত যা কিছু হয়েছে প্রতিটি পদে পদে লাগামহীন দুর্নীতির চিহ্ন স্পষ্ট। এমনকি সর্বশেষ যে আর্থিক চুক্তি সম্পাদন হতে যাচ্ছে, এতে অর্থ পরিশোধের শর্তসমূহে নজিরবিহীন অনিয়মের আশ্রয় নেয়া হয়েছে। সরকারের স্বার্থ মোটেই দেখা হচ্ছে না। মোটা অংকের কমিশনের লোভে চুক্তিতে বড় ধরনের ঘাপলা রেখে দেওয়া হয়েছে। সংশ্লিষ্ট সূত্রমতে, এই ৬টি জাহাজ কেনা হচ্ছে ১৪৩৯ কোটি টাকায় (১৮৪.৫ মিলিয়ন ডলার), যা মূল্যায়ন কমিটির সুপারিশের চেয়ে প্রায় ২২৩ কোটি টাকা বেশি। তাও যে কোম্পানির সঙ্গে প্রাথমিকভাবে আলোচনা হয়েছে এবং মূল্যায়ন কমিটি কর্তৃক যাদের ডকইয়ার্ড পরিদর্শন করা হয়েছে তাদের কাছ থেকে এই জাহাজ সরবরাহ নেওয়া হচ্ছে না। অন্য একটি কোম্পানি থেকে জাহাজ নেওয়া হচ্ছে, যাদের জাহাজ তৈরির কোনো পূর্ব অভিজ্ঞতাই নেই। বাণিজ্যিক চুক্তি স্বাক্ষরের পর দরপত্র মূল্যায়ন কমিটি কর্তৃক এদের ডকইয়ার্ডও পরিদর্শন করা হয়নি।
সবচে’ অবাক ব্যাপার হচ্ছে, চায়না ন্যাশনাল ইমপোর্ট এন্ড এক্সপোর্ট কর্পোরেশন নামে যে প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে জাহাজ ক্রয়ের প্রাথমিক চুক্তি সম্পাদিত হয়েছে তাতে বাংলাদেশ শিপিং কর্পোরেশন অর্থাৎ সরকারের স্বার্থ মোটেই দেখা হয়নি। সকল রেওয়াজ ও নিয়ম-কানুন উপেক্ষা করে চুক্তিমূল্যের শতকরা ৫৫ ভাগ অর্থই জাহাজ তৈরির কাজ শুরুর আগে অর্থাৎ অগ্রিম পরিশোধের ব্যবস্থা করা হয়েছে। যে কারণে আইন মন্ত্রণালয় এই চুক্তির খসড়া এক দফায় ফেরত পাঠিয়েছে। পরবর্তীতে আইন মন্ত্রণালয়কে অন্যভাবে ম্যানেজ করে চুক্তিটির ওপর ইতিবাচক মতামত নেওয়া হয়েছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে।
সূত্র জানায়, চূড়ান্ত করা এই চুক্তিতে বিভিন্নভাবে চুক্তিমূল্যের শতকরা ৫৫ ভাগ অর্থ অগ্রিম পরিশোধের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে, যা নজিরবিহীন। আন্তর্জাতিক চুক্তির রীতি অনুযায়ী, জাহাজ ক্রয় চুক্তিতে সংশ্লিষ্ট জাহাজ তৈরি ও ডেলিভারির বিভিন্ন ধাপে মূল্য পরিশোধের নিয়ম রয়েছে। এই ধাপগুলো হলো- কাঠামো নির্মাণ, ইঞ্জিন বসানো, ইন্টেরিওর ফিনিশিং, সী ট্রায়াল প্রভৃতি। জাহাজটি যাতে মানসম্মতভাবে তৈরি হয়, জাহাজ তৈরিতে পর্যবেক্ষণ যাতে ভালো ফলাফল দেয়, সেজন্যই এই ধাপগুলো চুক্তিপত্রে নির্দিষ্ট করা হয়ে থাকে। চুক্তিস্বাক্ষর বা ধারাগুলো সেভাবেই হয়ে থাকে। কিন্তু, এই চুক্তিতে দেখা যাচ্ছে, কাজ শুরুর আগেই তিন ধাপে শতকরা ৫৫ ভাগ অর্থ পরিশোধের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। বস্তুত, নিজেদের কমিশনের অর্থ হাতিয়ে নিতেই নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয়ের কর্তাব্যক্তিরা এমনটি করেছেন।
এই চুক্তিতে মূল্য পরিশোধের বিষয়ে বলা হয়েছে, প্রথম ধাপে আর্থিক চুক্তি স্বাক্ষরের ১০ দিনের মধ্যে শতকরা ১৫ ভাগ অর্থ পরিশোধ করতে হবে। এরপর জাহাজ নির্মাণের জন্য যখন প্রথম স্টিল প্লেট কাটা হবে, তার ৭ দিনের মধ্যে দিতে হবে চুক্তিমূল্যের ১৫ ভাগ অর্থ। তৃতীয়ত, যখন জাহাজ তৈরির কাজ শুরু করা হবে তার ৭ দিনের মধ্যে দিতে হবে আরো ২৫ ভাগ অর্থ। অর্থাৎ মাত্র কয়েক দিনের মধ্যেই ৫৫% অর্থ আদায় করে নেবে কোম্পানিটি। অথচ, জাহাজ ডেলিভারি দেওয়ার সময় নির্ধারণ করা হয়েছে প্রথম ১৫% প্রাপ্তি থেকে ২৭ মাস পর্যন্ত। এর অর্থ দাঁড়াচ্ছে, চুক্তি স্বাক্ষরের কিছু দিনের মধ্যে পর পর তিন দফায় ১৫% অর্থ আদায় করে নিয়ে সেই অর্থ অন্যত্র বিনিয়োগ করে সেখান থেকেও বড় অংকের অর্থ আয় করার সুযোগ পাবে কোম্পানিটি।
সংশ্লিষ্ট মহলের মতে, প্রথম স্টিল প্লেট কাটা বাবদ অর্থ পরিশোধের শর্তটি অত্যন্ত হাস্যকর। যা পৃথিবীর অন্য কোনো চুক্তিতে নেই। তাছাড়া, চুক্তি স্বাক্ষরের ১০ দিনের মধ্যে ১৫% অর্থ পরিশোধের শর্তটিও সম্পূর্ণ অস্বাভাবিক। এক্ষেত্রে শুধুমাত্র কাজ শুরুর সময় ১০% পর্যন্ত অর্থ পরিশোধ করে বাকি ৯০% অর্থ জাহাজ তৈরির বিভিন্ন ধাপে পরিশোধের ব্যবস্থা রাখা যেতো। সেক্ষেত্রে জাহাজটি মানসম্মতভাবে তৈরি হচ্ছে কিনা, পর্যবেক্ষণ করা যেতো। অগ্রিম অর্থ পরিশোধের কারণে বাড়তি যে সুদের বোঝা সেটা থেকেও রক্ষা পাওয়া যেতো। কিন্তু, নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয়ের প্রভাবশালী ব্যক্তিরা নিজেদের দুর্নীতির বড় অংকের কমিশন হাতিয়ে নেওয়ার লোভে সরকারি স্বার্থকে জলাঞ্জলি দিচ্ছেন এক্ষেত্রে। ২০১৪ সালের ৩০ এপ্রিল নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয়ের তৎকালীন সচিব সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম নিজে উপস্থিত থেকে মন্ত্রী শাহজাহান খানের সঙ্গে যোগসাজশে বাংলাদেশ সরকারের স্বার্থবিরোধী এই অবৈধ বাণিজ্যিক চুক্তিটি সম্পন্ন করেছেন। এরপর বাকি কাজ আনুষ্ঠানিকতার ধারায়ই এগুচ্ছে।
প্রথম নেগোসিয়েশন কমিটির দরপত্র মূল্যায়ন
৬টি জাহাজ ক্রয়ের প্রাথমিক প্রক্রিয়া শুরু হয় ২০১২ সালের জুলাই মাসে। এই প্রকল্পের ডিপিপি অনুমোদনের জন্য পরিকল্পনা কমিশনে প্রেরণ করা হয়।
এরপর ২০১২ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর মন্ত্রণালয়ের যুগ্মসচিব আলাউদ্দিনের নেতৃত্বে প্রথম নেগোসিয়েশন কমিটি গঠন করা হয়। চীনা প্রতিষ্ঠান সিএমসি’র সঙ্গে আলোচনা চলে। উল্লেখ্য, সিএমসি জাহাজ নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠান নয়। এটি একটি চীনা সরবরাহকারী অর্থাৎ মধ্যস্বত্বভোগী প্রতিষ্ঠান। সিএমসি’র প্রস্তাব অনুযায়ী জাহাজ ক্রয় সংক্রান্ত কমিটির সদস্যরা সংশ্লিষ্ট জাহাজ প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানের ডকইয়ার্ড পরিদর্শন করেন। এছাড়া কমিটি ক্লার্কসমসহ কয়েকটি এডজাস্টার কোম্পানির মতামত নেয়। পরিদর্শন এবং এডজাস্টার কোম্পানির মতামতের ভিত্তিতে ওই ক্যাটাগরির ৬টি জাহাজ ক্রয়ের ব্যয় নির্ধারণ করে ১৫৬ মিলিয়ন ডলার। কমিটি সে অনুযায়ী একটি প্রস্তাবনা তৈরি করে মন্ত্রণালয়ে রিপোর্ট জমা দেয়।
কিন্তু, মন্ত্রী এবং তৎকালীন সচিব এতে ক্ষুব্ধ হন। মন্ত্রী শাহজাহান খান এবং তৎকালীন সচিব সৈয়দ মঞ্জুরুল ইসলাম চেয়েছিলেন আরো বেশি দর নির্ধারণ করতে। এজন্য কমিটির ওপর চাপও প্রয়োগ করেছিলেন। তাতে কাজ হয়নি। কমিটি প্রকৃত রিপোর্টই জমা দেয়। এর জের হিসেবে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে তদবির করে কমিটির সদস্য, শিপিং করপোরেশনের নির্বাহী পরিচালক (কমার্শিয়াল) মোস্তফা কামাল উদ্দিন ও নির্বাহী পরিচালক (অর্থ) গোলাম মওলাকে ওএসডি’র ব্যবস্থা করেন মন্ত্রী।
পছন্দের দরপ্রস্তাব
এই কমিটি থেকে দুই সদস্যকে ওএসডি করানোর পর নতুন একজন সদস্য এই কমিটিতে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। তিনি হলেন বিএসসি’র নতুন নির্বাহী পরিচালক (অর্থ) ইয়াসমিন আফসানা। নতুন কমিটির ওপরও প্রচ-ভাবে চাপ প্রয়োগ করা হয় বেশি মূল্য নির্ধারণ করে রিপোর্ট পেশ করার জন্য। একে কেন্দ্র করে কমিটির একাধিক সদস্য এ সংক্রান্ত সভাতেও অংশ নেননি।
এসবের ফলে মন্ত্রণালয় এবং সংশ্লিষ্ট দফতরে চাপা ক্ষোভ বিরাজ করলেও থেমে থাকেনি মন্ত্রীর অপতৎপরতা। কর্মকর্তাদের চাপ দিয়ে কমিটির কাছ থেকে অস্বাভাবিক দামে জাহাজ কেনার সুপারিশ আদায় করা হয়েছে। এই কমিটি বস্তুত মন্ত্রী এবং তৎকালীন সচিবের ইচ্ছা পূরণ করেছে। কমিটি এই ৬টি জাহাজের দাম সুপারিশ করেছে ১৭৫ মিলিয়ন ডলার এবং এর সঙ্গে আরো সার্ভিস চার্জও যুক্ত করতে বলেছে। প্রস্তাবকৃত জাহাজের মান অনুযায়ী বাজারের যে দর তারচেয়ে এই মূল্য অনেক বেশি। অবাক ব্যাপার হলো, এই দরও পরে ঠিক থাকেনি।
আরো পছন্দের দ্বিতীয় নেগোসিয়েশন কমিটি
বাংলাদেশ শিপিং কর্পোরেশনের তৎকালীন ব্যবস্থাপনা পরিচালক, চিহ্নিত দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা কমোডোর মকসুমুল কাদেরের নেতৃত্বে গঠন করা হয় দ্বিতীয় নেগোসিয়েশন কমিটি। মন্ত্রী-সচিবের অত্যন্ত পছন্দের এই কমিটি গঠন করা হয় ২০১৩ সালের ৯ এপ্রিল। এই কমিটির সদস্য হিসেবে রাখা হয় মন্ত্রী-সচিবের অত্যন্ত অনুগত কর্মকর্তাদেরকে। এদের মধ্যে ছিলেন সমুদ্র পরিবহন অধিদফতরের পরিচালক (প্রশাসন) মো. আলাউদ্দিন। তিনি এর আগে দীর্ঘ ৪ বছর চট্টগ্রাম বন্দরে শাস্তিমূলক পোস্টিং হিসেবে নিম্নপদে কাজ করেছেন। নেগোসিয়েশন কমিটির অন্য একজন সদস্য ছিলেন ইলিয়াস রেজা। ইলিয়াস রেজা মূলত চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের চিফ অডিট অফিসার। কিন্তু, তাকে শাস্তিমূলকভাবে গভীর সমুদ্র বন্দর কর্তৃপক্ষে সংযুক্ত করে রাখা হয়েছিলো। নতুন শাস্তি থেকে বাঁচার জন্য নেগোসিয়েশন কমিটির এই সদস্যরা মন্ত্রী-সচিব যেভাবে বলেছেন, ঠিক সেভাবেই কাজ করতে বাধ্য হয়েছেন।
জানা গেছে, নেগোসিয়েশনের জন্য সিএমসির প্রতিনিধিদল ঢাকা আসেন এপ্রিল, ২০১৪ এর প্রথমার্ধে। তারা প্রায় দু’সপ্তা ঢাকা থাকেন। কিন্তু, তারা শেষদিন বৈঠকে বসেন বিএসসির নেগোসিয়েশন কমিটির সদস্যদের সঙ্গে। এর আগে কমিটির সদস্যদের সঙ্গে তাদের সাক্ষাতই হয়নি, যা অবাক করার মতো ঘটনা। বস্তুত, নেগোসিয়েশন কমিটির সদস্যরা ছিলেন ভয়ভীতির মধ্যে। মন্ত্রী-সচিবের আদেশ পালন ছাড়া তাদের করার কিছুই ছিলো না।
এমনও অবাক করার মতো ঘটনা ঘটেছে, নেগোসিয়েশন কমিটির সদস্যরা সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত এবং রিপোর্ট তৈরি করার আগেই শিপিং কর্পোরেশনের তৎকালীন দুর্নীতিবাজ এমডি কমোডোর মকসুমুল কাদের কারো সঙ্গে আলোচনা না করেই সিএমসির চীনাস্থ প্রধান কার্যালয়ে ই-মেইল করে জানিয়ে দেন ১৮৩.৫ মি. ডলার দর ধরার সিদ্ধান্ত হয়েছে। তার এই ই-মেইলটি ছিলো সম্পূর্ণ অনৈতিক। বিএসসির এমডির এই অনৈতিক কর্মকাcBgeর কারণে নেগোসিয়েশন কমিটি বেকায়দায় পড়ে যায়। দর এর থেকে কমানো সম্ভব হয়নি আর।
অবশ্য, ইতিমধ্যে আরো একটি ঘটনা ঘটে যায়। এপ্রিল, ২০১৪ এর ১৬/১৭ তারিখের দিকে মন্ত্রী শাহজাহান খানের সভাপতিত্বে বিএসসির একটি বোর্ড সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় নেগোসিয়েশন কমিটির সদস্যরাও উপস্থিত ছিলেন। মন্ত্রী ওই সভায় বলেন, চীনা প্রতিনিধিদলের সঙ্গে নাকি তার নেগোসিয়েশন হয়েছে। তিনি ১৮৫.৫০ মি. ডলার দরে রাজি হয়েছেন। সচিব সৈয়দ মনজুরুল ইসলামেরও এতে সায় আছে বলে মন্ত্রী জানিয়েছিলেন। মন্ত্রীর এমন বক্তব্যে নেগোসিয়েশেন কমিটির সদস্যরা অবাক হন।
নেগোসিয়েশন কমিটির রিপোর্টের আগেই চুক্তিস্বাক্ষর
৬টি জাহাজ ক্রয়ের ব্যাপারে বাণিজ্যিক চুক্তি সম্পন্ন হয় ৩০ এপ্রিল, ২০১৪। অথচ এ সময় পর্যন্ত নেগোসিয়েশন কমিটি তাদের রিপোর্টই পেশ করেনি। নেগোসিশেন কমিটির কাছ থেকে পরবর্তী মাসের অর্থাৎ মে মাসের ২২ তারিখে চাপ প্রয়োগ করে বেক ডেট দিয়ে রিপোর্ট আদায় করা হয়েছে। সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র এ তথ্য নিশ্চিত করেছে।
জানা গেছে, নেগোসিয়েশন কমিটির দু’জন সদস্য (নৌ পরিবহন মন্ত্রণালয় ও জ্বালানি মন্ত্রণালয়) তাদের রিপোর্টে ১৮৩.৫০ মি. ডলার দরের কথা উল্লেখ করেছেন। এমনকি তারা এও বলেছেন যে, যেহেতু জাহাজ নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠানটি একেবারেই নতুন এবং যেহেতু পূর্বের প্রতিষ্ঠান থেকে জাহাজ কেনা হচ্ছে না তাই এ জাহাজগুলোর দর আরো কম হওয়া উচিত।
উল্লেখ্য, প্রথম যে মূল্যায়ন কমিটি গঠন করা হয়েছিল সেই কমিটি বিদেশে গিয়ে সরেজমিন পরিদর্শন করে এসে ওই ৬ জাহাজের দাম নির্ধারণ করে ১৫৬ মিলিয়ন ডলার বা ১,২১৬ কোটি টাকা (প্রতি ডলার ৭৮ টাকা ধরে)। কিন্তু, পরবর্তীতে মন্ত্রীর ইচ্ছানুযায়ী চুক্তি হয়েছে ১৮৪.৫ মিলিয়ন ডলার (প্রায় ১,৪৩৯ কোটি টাকা)। যা মূল্যায়ন কমিটির প্রস্তাবনার চেয়ে ২৮.৫ মিলিয়ন ডলার (প্রায় ২২৩ কোটি টাকা) বেশি।
উল্লেখ্য, পরবর্তীতে নতুন কমিটি মন্ত্রীর পছন্দের যে রিপোর্ট পেশ করেছিল তাতে মূল্য ধরা হয়েছিল ১৭৫ মিলিয়ন ডলার। অর্থাৎ দেখা যাচ্ছে, এই কমিটির সুপারিশের চেয়েও প্রায় ৭৪ কোটি টাকা বেশি দাম ধরে চুক্তি করা হয়েছে।
নির্ভরযোগ্য সূত্র মতে, জাহাজ ক্রয়ের এই চুক্তিতে সবচে’ বড় জালিয়াতিটি হয়েছে, যে প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে জাহাজ কেনার জন্য আলাপ-আলোচনা চলছিল এবং কমিটির সদস্যরা জাহাজ নির্মাণকারী যে প্রতিষ্ঠানের শিপইয়ার্ড পরিদর্শন করে ১৫৬ মিলিয়ন ডলার দাম নির্ধারণ করেছিল সেখান থেকে এখন জাহাজ কেনা হচ্ছে না। চুক্তিতে নতুন যে প্রতিষ্ঠানের নাম উল্লেখ করা হয়েছে সে সম্পর্কে দরপত্র মূল্যায়ন কমিটির সদস্যরা আগে থেকে জানতেনই না। নতুন এই প্রতিষ্ঠানের নামও শোনেননি তারা কখনো।
৬টি জাহাজ ক্রয়ে এক নজরে বড় দাগের যেসব অনিয়ম
১. বাংলাদেশ শিপিং কর্পোরেশনের জন্য ৬টি জাহাজ ক্রয় করার জন্য যে বাণিজ্যিক চুক্তি করা হয়েছে তাতে আইন মন্ত্রণালয় এবং ইআরডির মতামত নেয়া হয়নি। অথচ বিদেশি ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যে কোনো চুক্তির আগে এ ধরনের মতামত নেয়াটা অপরিহার্য।
২. বাণিজ্যিক চুক্তির আগে অর্থনৈতিক বিষয় সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির অনুমোদন নেয়াটাও অপরিহার্য ছিলো। অথচ এগুলোর কোনোটিই করা হয়নি।
৩. চুক্তি স্বাক্ষরের পর তা অনুমোদনের জন্য পাঠানো হয় অর্থনৈতিক বিষয় সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটি (সিসিইএ)তে। কিন্তু, তখন মন্ত্রিসভা কমিটির আর কিছুই করার থাকে না, এটি অনুমোদন করা ছাড়া। যেহেতু ইতিমধ্যে চীনের মতো একটি প্রভাবশালী দেশের সঙ্গে চুক্তি হয়ে গেছে। ফলে প্রথমে অনুমোদন না করলেও পরে অনুমোদন করতে বাধ্য হয়েছে সিসিইএ।
৪. একই অবস্থা হয়েছে আইন মন্ত্রণালয় এবং ইআরডির মতামতের ক্ষেত্রেও। যেহেতু চুক্তি আগেই হয়ে গেছে, তাই আইন মন্ত্রণালয় এবং ইআরডি ইতিবাচক মতামত দিতে বাধ্য হয়েছে। তবে মতামতের সঙ্গে তারা যেসব নির্দেশনা দিয়েছে সেগুলোও যথাযথভাবে মানা হয়নি।
৫. জাহাজ ক্রয়ের জন্য প্রথম যে মূল্যায়ন কমিটি গঠন করা হয়েছিলো তারা দর যাচাই এবং চীনের ডকইয়ার্ড পরিদর্শন করে ১৫৬ মিলিয়ন ডলার দর সুপারিশ করেছে। পরবর্তীতে অবৈধভাবে সেই কমিটির দর পরিবর্তন করা হলো। অবৈধভাবে গঠিত পছন্দের কমিটি সুপারিশ করলো ১৭৫ মিলিয়ন ডলার। সেটাও অনুসরণ করা হয়নি। চুক্তি করা হলো ১৮৪.৫ মিলিয়ন ডলারে।
এ প্রসঙ্গে যুক্তি দেখানো হয়েছে যে, ক্লাকসমের (জাহাজের বাজার দর পর্যালোচনাকারী প্রতিষ্ঠান) তথ্য অনুযায়ী বাজার দর ইতিমধ্যে নাকি সাড়ে ৫% বেড়ে গেছে। যদি তা-ই হয়ে থাকে তাহলে অবশ্যই ১৫৬ মিলিয়ন ডলারের উপর সাড়ে ৫%। কিন্তু এক্ষেত্রে ধরা হয়েছে ১৭৫ মি. ডলারের উপর সাড়ে ৫%, যা সম্পূর্ণ অযৌক্তিক।
৬. চীনের যে প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে জাহাজ ক্রয়ের চুক্তি করা হয়েছে তারা নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠান নয়, সরবরাহকারী। দরপত্র মূল্যায়নকারী কমিটি চীনের যে জাহাজ নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠানের ডকইয়ার্ড সরেজমিন পরিদর্শন করে এসেছে সেখান থেকে এখন জাহাজ নেয়া হচ্ছে না। যে নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠানের জাহাজ এখন নেয়ার জন্য চুক্তি করা হয়েছে দরপত্র মূল্যায়ন কমিটির সদস্যরা তাদের চেনেন না, তাদের ডকইয়ার্ড পরিদর্শন করেননি বা তাদের সঙ্গে কোনো রকমের আলোচনাও হয়নি। চুক্তি স্বাক্ষরের পর বিএসসির এমডিসহ মন্ত্রী-সচিবের পছন্দের কর্মকর্তারা এই নতুন প্রতিষ্ঠানের অর্থায়নে ও আতিথেয়তায় চীন সফর করে এসেছেন। বস্তুত, এটি ছিলো প্রমোদ ভ্রমণ।
৭. অর্থ পরিশোধের পদ্ধতি এবং কিস্তি যেভাবে নির্ধারণ করা হয়েছে তাতে চুক্তির আন্তর্জাতিক রীতি-নীতি মোটেই অনুসরণ করা হয়নি। এতে সরকারের স্বার্থ মোটেই দেখা হয়নি। দেখা যাচ্ছে যে, জাহাজ সরবরাহের সময় দেয়া হয়েছে ২৭ মাস পর্যন্ত। অথচ জাহাজ নির্মাণের শুরুতেই তিন কিস্তিতে (১৫%+১৫%+২৫%) মোট চুক্তিমূল্যের শতকরা ৫৫% ভাগ অর্থ পরিশোধ করে দেয়া হচ্ছে, যা সম্পূর্ণ অযৌক্তিক। প্রাপ্ত এই অর্থ সংশ্লিষ্ট নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠান বাইরে যে কোনো খাতে দীর্ঘ সময় ধরে বিনিয়োগ করে রাখতে পারবে। অন্যদিকে অগ্রিম এতো অর্থ পরিশোধের কারণে বাংলাদেশ সরকারকে এরজন্য বিপুল অংকের সুদের বোঝা বইতে হবে।
৮. চুক্তি স্বাক্ষরের পর ১৫%, প্রথম স্টিল প্লেট কাটা বাবদ ১৫% এবং জাহাজ নির্মাণ শুরু বাবদ ২৫% অর্থ দেওয়া হবে। জাহাজ নির্মাণের ক্ষেত্রে এ ধরনের চুক্তি আন্তর্জাতিক রীতিনীতি বিরোধী। ‘প্রথম স্টিল প্লেট কাটা’ বাবদ ১৫% পরিশোধের যে শর্তটি দেওয়া হয়েছে তা অত্যন্ত হাস্যকর।
৯. জাহাজ ক্রয়ের ক্ষেত্রে অর্থ পরিশোধের কিস্তিগুলো নির্ধারণ করার নিয়ম হলো, নির্মাণকাজ শুরু, কাঠামো নির্মাণ, ইঞ্জিন বসানো, ক্রেন বসানো, ইন্টেরিওর ফিনিশিং, সী ট্রায়াল প্রভৃতি। জাহাজটি যাতে মানসম্পন্নভাবে তৈরি হয়, জাহাজ তৈরিতে পর্যবেক্ষণ যাতে ভালো ফলাফল দেয় সেজন্যই অর্থ পরিশোধের ক্ষেত্রে এই ধাপগুলো চুক্তিপত্রে নির্ধারণ করা হয়ে থাকে।
১০. ইআরডির মতামতে যা বলা হয়েছে-
ক) চুক্তিমূল্য আন্তর্জাতিক বাজার মূল্যের সঙ্গে প্রতিযোগিতামূলক হওয়া প্রয়োজন। কিন্তু, চুক্তির পর দর বাড়ানো বা কমানোর কোনো সুযোগ নেই। যেহেতু বাণিজ্যিক চুক্তি ইতিমধ্যে হয়ে গেছে, দর নির্ধারণ হয়ে গেছে তাই ইআরডি এ বিষয়ে কোনো মতামত দেয়া থেকে বিরত থেকেছে।
খ) ইআরডি প্রথম দুটি কিস্তি ১৫% এবং ১০% করার কথা বলেছে।
অথচ, এক্ষেত্রে ইআরডির নির্দেশনাও মানা হয়নি। প্রথম দুটি কিস্তি করা হয়েছে ১৫% এবং ১৫%।
গ) ইআরডির মতামতে বলা হয়েছে, চুক্তিটিতে পারফরমেন্স গ্যারান্টি এর সিকিউরিটি ডিপোজিট/বন্ড এর বিষয়টি পরিষ্কার নয়, Warranty Period এর জন্য কী পরিমাণ অর্থ জমা থাকবে তা উল্লেখ করা প্রয়োজন।
কিন্তু, ইআরডির নির্দেশনার পরও এ ব্যাপারে কোনোই পদক্ষেপ নেয়া হয়নি। দেখা যাচ্ছে, Warranty Period এর সময় কোনো অর্থই জমা থাকছে না। চুক্তিতে শুধুমাত্র এই সময়ে তাদের একজন ইঞ্জিনিয়ার এখানে উপস্থিত থাকার কথা বলা হয়েছে।
ঘ) নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে জাহাজ সরবরাহ করতে না পারলেও ৪৫ দিন পর্যন্ত কোনো জরিমানা দিতে হবে না, চুক্তিতে বলা আছে। এটা শূন্য দিনে নামিয়ে আনার জন্য ইআরডি বলেছে। অর্থাৎ নির্ধারিত তারিখের মধ্যে জাহাজ সরবরাহ করতে না পারলে যাতে ওই তারিখের পরই জরিমানা আরোপ করা যায় সেজন্য ইআরডি এই পদক্ষেপ নিতে বলেছে।
অথচ, ইআরডির এই নির্দেশনাও মানা হয়নি।
ঙ) বিলম্বে জাহাজ সরবরাহের জন্য প্রতিদিন ১২০০০ ডলার জরিমানা নির্ধারণের কথা বলেছে ইআরডি।
কিন্তু, ইআরডির এই নির্দেশনা না মেনে প্রতিদিনের জন্য জরিমানা নির্ধারণ করা হয়েছে ৫ হাজার ডলার মাত্র।
চ) জাহাজের মান নিশ্চিত করার জন্য আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত ইন্ডিপেন্ডেন্ট সার্ভেয়ার নিয়োগ এবং তাদের খরচ বহনের বিষয়টি বাণিজ্যিক চুক্তির যথাযথস্থানে সন্নিবেশিত করতে বলা হয়েছে।
কিন্তু দেখা যাচ্ছে, ইআরডির নির্দেশনার পরও চুক্তিতে এর কোনো ব্যবস্থা রাখা হয়নি।
১১. আইন মন্ত্রণালয়ের মতামতে বলা হয়েছে-
ক) রেগুলেশন, রুলস, কনভেনশনস, কোড, রেজুলেশন ইত্যাদি নথিতে না থাকায় চুক্তির ক্ষেত্রে এগুলোর সংশ্লিষ্টতা পরীক্ষা করা সম্ভব হচ্ছে না।
খ) প্রতিযোগিতামূলক পদ্ধতিতে দরপত্র মূল্যায়ন এবং পিপিআর অনুসরণ করতে বলা হয়েছে আইন মন্ত্রণালয়ের মতামতে।
অথচ, প্রতিযোগিতামূলক দর বা পিপিআর এক্ষেত্রে অনুসরণ করা হয়নি।
অভিজ্ঞতাহীন প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে জাহাজ ক্রয়
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, জোসান চ্যাংহোং ইন্টারন্যাশনাল শিপইয়ার্ড কোম্পনি লি. নামে একটি চীনা প্রতিষ্ঠান এই জাহাজগুলো নির্মাণ করবে। কিন্তু, এই প্রতিষ্ঠানটি একেবারেই নতুন। জাহাজ রফতানির কোনো পূর্ব অভিজ্ঞতাই এদের নেই।
এদিকে চীনের যে সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান মধ্যস্বত্বভোগী হিসেবে এক্ষেত্রে কাজ করছে অর্থাৎ যাদের সঙ্গে বাণিজ্যিক চুক্তি সম্পাদিত হয়েছে সিএমসি নামে ওই প্রতিষ্ঠানটি নিজেরা কোনো জাহাজ নির্মাণ করে না। সিএমসি একটি ট্রেডিং প্রতিষ্ঠান। বিভিন্ন মেকানিকেল এবং ইলেক্ট্রিকেল দ্রব্যাদি আমদানি-রফতানি করে থাকে এই প্রতিষ্ঠান। জাহাজ উৎপাদন তো নয়ই, সরবরাহকারী হিসেবেও এদের অভিজ্ঞতা নেই।
নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয় এবং বাংলাদেশ শিপিং কর্পোরেশনের জাহাজ ক্রয়ের কাগজপত্র ও চুক্তিতে সিএমসিকে চীনের রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।
বাস্তবে সিএমসি চীনের সরাসরি রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান নয়। চীনের রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানসমুহের তালিকায় সিএমসির নাম নেই। সিএমসির ওয়েবসাইটেই বলা আছে, এটি চীনের অন্য একটি রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানের অধীন প্রতিষ্ঠান মাত্র। শীর্ষ কাগজের সৌজন্যে
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন