আমাদের বাংলাদেশ নিউজ 24 ডেস্কঃ আমার কিছু শিষ্য ও শুভানুধ্যায়ী আমাকে আশুরার উপর কিছু আলোকপাত করার জন্য অনুরোধ করেন। গতকাল রাতেও আমি ইউরোশিয়া ইয়ুথ ডেভেলপমেন্ট ফোরাম কর্তৃক আয়োজিত একটি অনুষ্ঠানে এই বিষয়ে কথা বলি। আমি সাধারণত বিষয়টিকে তিনটি পয়েন্টে বিভক্ত করে আলোকপাত করে থাকি। এক. বিভিন্ন নবী- রাসূলগণের জীবনে ঘটে যাওয়া গুরুত্বপূর্ণ ইতিবাচক ও সুসংবাদের বার্তাবহ ঘটনাপঞ্জি, দুই . মহানবী সা. এর প্রিয় দৌহিত্র ইমাম হুসাইন রা. ও তাঁর পরিবারের সদস্যবৃন্দের জীবনে কারবালার প্রান্তরে ঘটে যাওয়া বিয়োগাত্মক লোমহর্ষক নারকীয় ঘটনা এবং তিন. মুহাররাম মাস ও আশুরার দিনে মুসলিম উম্মাহর করণীয়। এই আলোকে আমি অনেক আগে একটি গবেষণামূলক প্রবন্ধ রচনা করি যা ১৯৯৭ সালে একটি গবেষণা জার্নালে প্রকাশিত হয়। যেহেতু এই বিষয়ে মসজিদ, মাদ্রাসা, বিভিন্ন মাহফিল ও সেমিনারে অনেক গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা হয়ে থাকে, তাই আমি এই প্রসঙ্গে দুই একটা পয়েন্ট আলোচনা করবো সাধারণত যা এই সব মজলিসে আলোচনা করা হয় না।
হিজরী ৬০ সাল। যিলহাজ্জ মাসের প্রথম দিকে ইমাম হুসাইন রা. ছিলেন পবিত্র মক্কা নগরীতে। এর আগে তিনি পবিত্র মদীনায় অবস্থান করছিলেন। কিন্তু এখানে ইয়াজীদের উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত রাষ্ট্রক্ষমতা গ্রহণ বিষয়ে বায়'আত হওয়ার জন্য তাঁর উপর চাপ প্রয়োগ করা হলে তিনি মক্কা চলে যান। তখন লোকজন পবিত্র হজ্জ্ব পালনের নিমিত্তে পবিত্র মক্কা নগরীতে এসে পৌঁছছিলেন। আর এখানেও তাঁর উপর একই রকম চাপ প্রয়োগ অব্যাহত থাকে। আর এই সময় কূফা গমনের জন্য অসংখ্য পত্র পেয়ে তিনি কূফার উদ্দেশ্যে রওনা হন। কিছু সংখ্যক ভক্ত অনুরক্ত ও কয়েকজন বিশিষ্ট সাহাবী তাঁকে পবিত্র হজ্জ্ব পালনের পর যাওয়ার পরামর্শ দেন। কিন্তু ইমাম হুসাইন রা. চিন্তা করলেন, এই হজ্জ্ব তো পালিত হবে আমীর মুয়াভিয়্যাহ রা. কর্তৃক মনোনীত আমীরের তত্ত্বাবধানে। এই মনোনয়ন ছিল খুলাফা রাশিদূনের যুগে খলীফা নির্বাচনের অনুসৃত ধারার ব্যাতিক্রম। যেহেতু তিনি ইয়াযীদকে বৈধ খলীফা মনে করেন না, তাই তাঁর তত্ত্বাবধানে হজ্জ্ব পালন করে ইয়াযীদের খিলাফতকে বৈধতা দিতে চান না।
এখন প্রশ্ন হলো, যেখানে মহানবীর সা. সাহাবীগণ এমন কি তাঁর আত্মীয় স্বজন এবং তাবিয়ীগণ ইয়াযীদের খিলাফত মেনে নিয়ে বায়'আত হন সেখানে ইমাম হুসাইন রা. কেন তাঁর হাতে বায়'আত করতে অস্বীকার করেন। এই বিষয়টি বুঝতে হলে আমাদেরকে Principles of Islamic Jurisprudence এর দিকে ফিরে যেতে হবে। এখানে দুটি বিষয় আলোচিত হয়। এক. 'আযীমাত আর দুই. রুখসাত। 'আযীমাত হলো যে কোন বিধানের যথাযথ অনুসরণ। আর রুখসাত হলো একাধিক অবকাশ থাকলে তার মধ্য হতে সুবিধাজনক বিধানের অনুসরণ।
ইয়াযীদের খিলাফত প্রশ্নে সাহাবীগণ ধরে নিয়েছেন এটি উম্মাহর একটি আভ্যন্তরীণ সমস্যা। এই সমস্যার সাথে কোন বহিঃ জাতি, গোষ্ঠী কিংবা ভিন্ন ধর্মের অনুসারীদের কোন প্রকার ষড়যন্ত্র জড়িত নয়। তাই এই বিষয়টি নিয়ে উম্মাহর মধ্যে বিভক্তি সৃষ্টি করা উচিত হবে না। আর ইমাম হুসাইন রা. চিন্তা করলেন, আহলে বায়তের একজন গুরুত্বপূর্ণ সদস্য এবং মহানবীর সা. এর দৌহিত্র হিসাবে তাঁকে 'আযীমাতের পথটি অনুসরণ করা উচিত। নতুবা 'আযীমাতের পথ অনুসরণের কথা উম্মাহ বিস্মৃত হয়ে যাবে। তা ছাড়া, খিলাফত প্রশ্নে রাজনীতিতে উত্তরাধিকার মনোনয়নের মাধ্যমে রাজতন্ত্রের যে বিদ'আতের অনুপ্রবেশ ঘটেছে তা যদি প্রতিহত করা না হয় তা হলে নবী সা. এর দৌহিত্র ইয়াজীদের হাতে বায়'আত হওয়ার ফলে এটি অনুমোদন দেওয়ার কারণে তা সুন্নাহর রূপ পরিগ্রহ করবে, যা কোন ক্রমেই কাম্য হতে পারে না। তাই তিনি এই বিষয়ে কঠিন পথ তথা 'আযীমাতের পথটি অনুসরণ করেন, যার পরিসমাপ্তি ঘটে তাঁর শাহাদাতের মধ্য দিয়ে।
ইমাম হুসাইন রা. তাঁর শাহাদাতের প্রাক্কালে ফোরাত নদীর তীরে দাঁড়িয়ে ইয়াযীদ কর্তৃক নিয়োজিত সেনাবাহিনীকে উদ্দেশ্য করে এক হৃদয়গ্রাহী ভাষণ দেন। এই ভাষণটি ইমাম তাবারী তাঁর "তারীখ আল উমাম ওয়াল মলূক" গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন। এই ভাষণে তিনি নিজের অবস্থান এবং এখানে আগমনের উদ্দেশ্য ও তিনি কারো জন্য হুমকি নন বলে সুস্পষ্ট ভাবে ঘোষণা করেন। এবং তিনি নিজেকে মহানবীর সা. একমাত্র জীবিত দৌহিত্র হিসাবে দাবী করেন। এর পরও কেন তাঁকে শহীদ করা হয় এটি একটি বিরাট প্রশ্ন। আমার যা মনে হয়েছে, ইয়াযীদ কিংবা তাঁর বাহিনী মনে করেছে , মহানবীর সা. এর দৌহিত্র মানে মুসলিম উম্মাহর আবেগের কেন্দ্রস্হল। যদি তাঁকে জীবিত রাখা হয় তা হলে তাঁকে কেন্দ্র করে মুসলিম উম্মাহ ঐক্যবদ্ধ হতে পারে, যা পুনরায় ইসলামী খিলাফত প্রতিষ্ঠার আন্দোলনকে ত্বরান্বিত করার সমূহ সম্ভাবনা থেকে যায়। তাই তারা তাঁকে শহীদ করাকেই নিজেদের ক্ষমতা পাকা পোক্ত করার নিরাপদ ব্যবস্থা বলে মনে করেছে। কিন্তু ভাগ্য ইয়াজীদের সহায়ক হয় নি। এই ঘটনার মাত্র তিন বছরের মধ্যেই তাঁকে অনেক রক্তের বিনিময়ে অর্জিত ক্ষমতা ছেড়ে এই পৃথিবীর বুক থেকে চিরতরে বিদায় নিতে হয়েছে।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন