১) ভূমিকাঃ-
শান্তি (ইংরেজি: Peace) বলতে বুঝায়কোন প্রকার সংঘর্ষ কিংবা যুদ্ধবিহীন সময়কাল। বৃহৎ পরিসরে শান্তি বলতে রাষ্ট্রের ঐক্য, শান্ত অবস্থা বিরাজমান যা অন্য কোন কিছু বিঘ্নতা সৃষ্টিকারী পরিবেশ দ্বারা আক্রান্ত না হওয়াকে বুঝায়। শান্তির স্বপক্ষে চিরজাগরুক ব্যক্তিত্ব মার্টিন লুথার কিং, জুনিয়র বার্মিংহ্যাম কারাগার থেকে এক চিঠিতেলিখেছেন যে –সত্যিকারের শান্তি কেবলমাত্র উদ্বিগ্নেরই অনুপস্থিতি ঘটায় না; বরঞ্চ ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠা ও উপস্থিতিজনিত কারণে হয়ে থাকে।অন্যভাবে বলা যায় যে, প্রকৃত শান্তি তখনই ঘটে যখন সমস্যা, ভয়-ভীতির পরিবেশ দূরীভূত হয়।শান্তি বিভিন্ন পর্যায়ে হতে পারে- যেমনঃ পারিবারিক পর্যায়ে শান্তি, সামাজিক পর্যায়ে শান্তি, রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে শান্তি এবং সর্বোপরি আন্তর্জাতিক পর্যায়ে শান্তি।পৃথিবীর বুকে প্রত্যেক মানুষই সুখ-শান্তি পাওয়ার চেষ্টা করে। তাদের মতবাদ, জাতি, বর্ণ, উৎপত্তি, লক্ষ্য- উদ্দেশ্য যাই হোক না কেন সবাই একটি উদ্দেশ্যে একমত, তা হলো সুখ ও প্রশান্তি তালাশ করা। যদি কোন লোককে জিজ্ঞেস করা হয়ঃ তুমি এ কাজটি কেন কর? উহা কি কারণে করবে? সে বলবেঃ সুখ–শান্তির জন্য!! চাই তা শব্দগতভাবে বলুক বা অর্থগতভাবে বলুক। শান্তির প্রকৃত বা রূপক যেকোন অর্থেই হোক।মানুষ ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক, রাষ্ট্রীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে শান্তি অনুভব করতে পারলে তার সামগ্রিক জীবন স্বার্থক হয় বলে অনুমান করা যেতে পারে। শান্তি যদিও আপেক্ষিক তবুও এর উপস্থিতি সকল মানুষ কামনা করে। শান্তিময় পরিবেশের ফলে জীবন যাপন স্বস্তিময়, স্বাভাবিক ও সহজতর হয়ে উঠে। সকল কার্যক্রম নির্বিঘ্নে সম্পন্ন করা যায়।ব্যবসা-বাণিজ্য, উৎপাদন-বন্টন, উন্নয়ন এর চাকা ঘুর্ণায়মান থাকে।শান্তিপূর্ণ জীবনে এক বেলা না খেলেও কষ্ট হয়না।
বর্তমান পৃথিবীতে শান্তি নামক অতি কাম্য অবস্থা এখন নেই বললেই চলে। দেশ, জাতি, গোষ্ঠী, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে ক্ষুদ্র থেকে বৃহদাকারে অশান্তির দাবানল ছড়িয়ে পড়েছে। চারিদিকে এক ভীতিকর পরিস্থিতি বিরাজ করছে। নিরাপত্তাহীনতায় মানুষ উদ্বিগ্ন-উদ্বেলিত। শক্তিমান দ্বারা দুর্বলরা প্রতিনিয়তই নির্যাতিত-নিষ্পেষিত হচ্ছে। ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক, রাষ্ট্রীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে শান্তি-স্বস্তির ব্যাপক অভাব প্রকাশিত হচ্ছে। মানুষ সৃষ্টির সেরা জীব হওয়া স্বত্ত্বেও মানুষের দ্বারাই সুজলা-সুফলা এ ধরণী আজ অশান্ত।যুদ্ধ, মারামারি, খুন-জখম, হামলা, অবিচার, পাপাচার এর ফলে পৃথিবী আজ বসবাসের অনুপযোগী হয়ে যাচ্ছে।সামান্য অজুহাতেই এক দেশ আরেক দেশের উপর হামলা করছে, দখল করে নিচ্ছে। স্বাধীন সার্বভৌম দেশ হয়ে যাচ্ছে পরাধীন দেশের কাতারে। একদেশ আরেক দেশকে অর্থ-অস্ত্র-বুদ্ধি দিয়ে সাহায্য করছে অন্যদেশকে ঘায়েল করার জন্য। মুক্তিকামী মানুষের উপর বাহিনী লেলিয়ে দেয়া হচ্ছে দমন নিপীড়নের জন্য। হাজার বছর ধরে বসবাসরত জনগোষ্ঠীকে তাদের ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্ছিত করা হচ্ছে, তাদের ভিটেমাটি কেড়ে নিয়ে দেশ ত্যাগে বাধ্য করা হচ্ছে।বসত-বাড়ি থেকে জোরপূর্বক উচ্ছেদ করে সেখানে নিজেদের বসতি গড়ে তোলা হচ্ছে। সরকার কর্তৃক সেদেশের ভিন্ন মতাবলম্বী নাগরিকদেরকে তাদের প্রাপ্য অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হচ্ছে, দমন করা হচ্ছে। দলপ্রীতি-স্বজনপ্রীতি এত প্রসারিত হয়েছে যে সেখানে অন্যদের সুযোগ-সুবিধার কথা, অধিকারের কথা ভাবাই দুরূহ।দুর্নীতি, অপরাধ, অবক্ষয় এর ব্যাপকতা বেড়েই চলছে। পারিবারিক রীতিনীতি ও আচার ব্যবস্থা ভেংগে পড়ছে।দীর্ঘদিনের ঐতিহ্য ধুলিস্যাত হতে চলেছে আজকের পরিবার গুলোতে। পিতা-মাতা, সন্তান-সন্ততি, স্বামী-স্ত্রী সহ পরিবারের সদস্যদের মধ্যে ব্যাপক দুরত্ব, অবিশ্বাস আর অমিল পারিবারিক সুখ-শান্তিকে বিনষ্ট করে চলেছে। সদস্যদের মধ্যে দায়িত্বশীলতা, সততা ও নৈতিকতার মাত্রা ব্যাপকভাবে হ্রাস পেয়েছে। ফলে লেগে আছে নিত্য নতুন সমস্যা আর অস্থিরতা। ভেংগে চুরমার হয়ে যাচ্ছে সুখের পারিবারিক সংগঠনগুলো। এর প্রভাব পড়ছে জাতীয় পর্যায়ে। এক কথায় শান্তি অনুপস্থিত।
অশান্ত পরিস্থিতির ফল স্বরুপ সমাজে, রাষ্ট্রে এমনকি পুরো বিশ্বে অস্থিতিশীলতা, সহিংসতা, উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়েছে। সন্ত্রাসবাদের জন্ম নিয়েছে। মানুষ নিজ হাতে আইন তুলে নিয়ে সুখ খোজার চেষ্টা করছে।বিশ্বব্যাপী যে অস্থিরতা তা মূলতঃ সামগ্রিক অশান্তিরই বহিঃপ্রকাশ।
অশান্ত পরিস্থিতির পরিণতি শুধুমাত্র রাজনৈতিক আর সামাজিক ক্ষেত্রে নয়, অর্থনৈতিক ক্ষেত্রেও এর প্রভাব মারাত্মক। অশান্ত দেশে স্থানীয় ও বৈদেশিক বিনিয়োগ ব্যাপকহারে কমে যায়। মুদ্রাস্ফীতি কিংবা মন্দাজনিত পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। যুদ্ধ কিংবা অস্থিশীলতার কারণে সিরিয়ার জিডিপি ২০১১ থেকে ২০১৪ সালের মধ্যে ৫৩% কমে গেছে। (রিপোর্টঃ ইন্সটিটিউট ফর ইকোনোমিক্স অ্যান্ড পীচঃ ২০১৭)। মানুষের ক্রয় ক্ষমতা কমে যায়। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি হ্রাস পায়।অশান্ত পরিস্থিতির ফলে বিশ্বব্যাপী অস্থিতিশীলতা বৃদ্ধি পায়। দেশে ছেড়ে অন্যত্র স্থানান্তরের প্রবণতা বেড়ে যায়।বৈষম্য ব্যাপক হারে বেড়ে যায়, সামাজিক ভারসাম্য নষ্ট হয়ে যায়।
বিশ্ব শান্তি প্রতিষ্ঠায় মুহাম্মদ স. এর অবদান শীর্ষক সেমিনারে উপস্থিতির একাংশ
২) মানবজীবনে অশান্তির সভাব্য কারণঃ
ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক, রাষ্ট্রীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে অশান্তির পেছনে যেসকল কারণ দায়ী বলে ধারণা করা হয় তার উল্লেখযোগ্য কয়েকটি হচ্ছেঃ
২(১)অর্থনৈতিক বৈষম্যঃ
প্রায় সমগ্র পৃথিবীতে চলছে অর্থনৈতিক বৈষম্য। এখানে মুনাফার্জনকে প্রাধান্য দিতে গিয়ে এক প্রকার অসম প্রতিযোগিতার সৃষ্টি হয়েছে। যার আছে তাকে আরো দিয়ে আর যার নাই তাকে বঞ্চিত করে অর্থনৈতিক নীতিসমূহ গ্রহণ করা হয়ে থাকে। ফলে উৎপাদন, বন্টন, উন্নয়নে স্বাভাবিক ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে। দারিদ্রতা, বেকারত্ব, মুদ্রাস্ফীতি, দুর্নীতি বর্তমান বিশ্বে মহামারী আকার ধারণ করেছে। শান্তিতে নোবেলজয়ী মানবাধিকার কর্মী কৈলাস সত্যার্থী বলেছেন, বিশ্বব্যাপী আয়বৈষম্য রীতিমত অর্থনৈতিক সহিংসতার রূপ পেয়েছে।এই সহিংসতা মানব জাতির নিরাপত্তা ও শান্তির জন্য হয়ে উঠেছে বড় ধরনের হুমকি। বিশ্বে প্রতিনিয়ত অর্থনৈতিক বৈষম্য বাড়ছে। কয়েক যুগ আগে যেখানে মালিক-শ্রমিক বেতন অনুপাত ছিল ২০-১ এখন তা হয়েছে ২০০- ১। বর্তমানে বিশ্বের ৫০ ভাগ মানুষের সমপরিমাণ সম্পদ মাত্র ৮ ধনীর কাছে রয়েছে। বিশ্বের এক শ’ কোটি মানুষ এখনও দিনে দুই ডলার আয় করতে পারে না। এই বৈষম্যের কারণেই সহিংসতা বাড়ছে।অর্থনৈতিক বৈষম্যের কারণে সৃষ্ট এই সহিংসতা মানব জাতির নিরাপত্তা ও শান্তির জন্য বড় ধরনের হুমকি (দৈনিক জনকন্ঠ, এপ্রিল ৩, ২০১৭)। অর্থনৈতিক ভারসাম্যহীনতার পেছনে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য কারণ হচ্ছে অনিয়ন্ত্রিত উদারভিত্তিক কিংবা অতিনিয়ন্ত্রিত অর্থব্যবস্থা। সুদ-জুয়া ও অনৈতিক ব্যবসা-বাণিজ্যের ব্যাপক প্রচলন এসব অর্থব্যবস্থাকে আরো দুর্বল করে দিয়েছে ও সর্বক্ষেত্রে অশান্তির বীজ বপন করে দিয়েছে।
২(২) রাজনৈতিক সহিংসতাঃ
দেশে-বিদেশে, গ্রামে-শহরে প্রায় সর্বত্রই রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা, সহিংসতা বিরাজমান। ক্ষমতা ধরে রাখা কিংবা ক্ষমতায় আরোহনের চেষ্টা চালাতে গিয়ে এক পক্ষ অন্য পক্ষকে শায়েস্তা করতে নামে। এক পক্ষ অন্য পক্ষকে ঘায়েল করার চেষ্টা করে। ক্ষমতাকে চিরস্থায়ী করতে গিয়ে আইন-কানুন পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে বিপক্ষকে দমন করা বিশ্ব রাজনীতির বৈশিষ্ট্য হিসেবে পরিলক্ষিত হচ্ছে। গণতন্ত্রের নামে স্বৈরতন্ত্র কিংবা একনায়কতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করে শাসকগোষ্ঠী। ক্ষমতার স্বাদ পেয়ে ক্ষমতাশালীদের অনুসারীরা নিজেদের প্রভাব বিস্তার করার অপপ্রয়াস চালায়। ক্ষমতাসীনদের মসনদ হতে নামিয়ে নিজে ক্ষমতায় আরোহনের উদ্দেশ্যে ক্ষমতাহীনরা যেকোন অন্যায় কাজের আশ্রয়-প্রশ্রয় নিতে পরোয়া করেনা। ক্ষমতার দাপটে প্রশাসনকে নিজেদের ইচ্ছেমতো চালানো একটা ফ্যাশনে পরিণত হয়েছে। অযোগ্য ব্যক্তির দায়িত্ব গ্রহণের ফলে সাধারণ মানুষের অধিকার ও স্বার্থ ক্ষুণ্ণ হয় ফলে সংঘাত অনিবার্য হয়ে উঠে। সংঘাত স্বল্প সময় হতে বেশ দীর্ঘ সময় পর্যন্ত ব্যাপ্তি লাভ করে। ফলে মানুষের জীবনে অশান্তি নেমে আসে। শুরু হয় নানা কর্মসূচী ও পালটা কর্মসূচী। এতে অনেক মানুষের জীবন-অংগ হানি ঘটে।
২(৩)মূল্যবোধের অবক্ষয়ঃ
নৈতিকতা কোন ব্যক্তির মধ্যে এমন আচরণ, যা অপরের প্রতি ক্ষমা ও মার্জনা, উদারতা ও দানশীলতা, ধৈর্য, বিনয় ও নম্রতা ইত্যাদি গুণে গুণান্বিত হওয়াকে বুঝায়। এটি সামাজিক শান্তি ও নিরাপত্তার রক্ষাকবচ। যে সমাজের মানুষের মাঝে নৈতিকতাবোধ যতটা বেশী হবে সে সমাজের মানুষ ততটাই শান্তি ও নিরাপত্তা উপভোগ করবে। সমাজ জীবনে বসবাসরত প্রত্যেক মানুষের মাঝে দেখা দেয় প্রেমপ্রীতি,-ভালবাসা, সহমর্মিতা, সহানুভূতি, নিয়মানুবর্তিতা, অধ্যবসায়, নান্দনিক সৃজনশীলতা, দেশপ্রেম, কল্যাণবোধ, আর স্নেহমমতা। এ সবের উন্মেষ ঘটে তখনই যখন মানুষের মাঝে নৈতিকতাবোধ থাকে। কিন্তু দুঃখজনক হ’লেও সত্য যে, অশিক্ষা-কুশিক্ষা, মাদকতার ব্যাপকতা, অশ্লীলতা, দুর্নীতি, সাংস্কৃতিক আগ্রাসণ এর ফলেআজ আমাদের মাঝে নৈতিকতা লোপ পেয়েছে। এখন আর পারস্পরিক ভালবাসা, আদর-মমতা নেই। খুন-খারাবি, চুরি ডাকাতি, ছিনতাই, ইভটিজিং, ধর্ষণ, চাঁদাবাজি, দখলবাজি, মজুতদারিতা, ভেজাল মিশানোসহ নানা অপরাধ এতই বেড়ে গিয়েছে যে মানুষ আর স্বস্তি পাচ্ছেনা।
২(৪) সন্ত্রাসঃ
সন্ত্রাস বর্তমান বিশ্বের একটি বার্ণিং ইস্যু।পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে নানা নামে, নানা পহ্নায়, নানা কারণে সন্ত্রাস চলছে।প্রাচ্য-পাশ্চাত্যের কোন দেশই সত্রাসের কবল থেকে মুক্ত নয়। মুসলিম বিশ্বের কয়েকটি দেশে বিশেষ করে ইরাক, সিরিয়া, পাকিস্তান, ইয়েমেন, আফগানিস্তান, মিশর, নাইজেরিয়ায় এ সন্ত্রাস প্রকট আকার ধারন করেছে। দুর্ভাগ্যবশত: এসব দেশে প্রধানত: ইসলামের নামে এসব সন্ত্রাস চালানো হচ্ছে। আবার কোথাও চলছে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস বিশেষত: সিরিয়া, মিশর ও ফিলিস্তিনে । ব্যক্তি সন্ত্রাস, সামাজিক সন্ত্রাস, রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস, আন্তর্জাতিক সন্ত্রাস, তথ্য সন্ত্রাস, রাজনৈতিক সন্ত্রাস, সাংস্কৃতিক সন্ত্রাস ইত্যাদি হরেক রকম সন্ত্রাসে ছেঁয়ে গেছে আজকের পৃথিবী। সন্ত্রাসের ভয়াবহ অভিশাপে দেশ-জাতি আজ ভীত, সন্ত্রস্ত, বিপর্যস্ত। ইসলামের নামে সন্ত্রাসের পিছনে আছে ইসলামের ভুল ব্যাখ্যা ও চরমপন্থী-হটকারী মনোভাব, নির্বিচারে মুসলমানদের উপর নির্যাতন নিপীড়ন এবং তজ্জনিত ক্ষোভ, বিশ্বজুড়ে ইসলামের বিরুদ্ধে যড়যন্ত্র-চক্রান্ত এবং মুসলিম বিশ্বে স্বৈরাচারী সরকারসমুহের দমন নীতি ও এর প্রতি পশ্চিমা দেশগুলোর অব্যাহত সমর্থন। বিশ্বব্যাপী সাম্রাজ্যবাদী শক্তির আচরণও সন্ত্রাস সৃষ্টির অন্যতম কারণ। শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানে একক দখলদারিত্ব, প্রভাব-খাটানো, পদ-পদবীর লোভ, চাঁদার টাকার ভাগ-ভাটয়ারা প্রভৃতি কারণে নিত্যদিনে লেগে আছে সন্ত্রাসের রাজত্ব। প্রতিপক্ষ বা নিজ দলের অন্য গ্রুপের সদস্যকে খুন-জখম করতে দ্বিধা করেনা এখানে।
২(৫) ধর্মীয় বিদ্বেষ ও অসহিষ্ণুতাঃ
বিশ্বে এখন অশান্তি ও অস্থিরতার প্রধান কারণ ক্ষুধা বা দারিদ্র্য নয়, ধর্মের নামে সহিংসতা। ধর্মীয় উন্মাদনার শিকার হয়ে পৃথিবীর নানা প্রান্তে প্রাণ হারাচ্ছে মানুষ। এশিয়া, ইউরোপ, আফ্রিকা- সর্বত্র একই চিত্র। ধর্মের নামে ইন্দোনেশিয়া, পাকিস্তান, নাইজেরিয়ায় বোমা হামলা চালিয়ে মানুষ হত্যা করা হচ্ছে। মধ্যপ্রাচ্যে এমনকি অভিন্ন ধর্মাবলম্বীদেরও মেরে ফেলা হচ্ছে সম্প্রদায়গত (শিয়া-সুন্নি) বিভেদের কারণে। কেউ কি কখনও কল্পনা করেছেন, বহুত্ববাদ ও ধর্মনিরপেক্ষতার নীতির ওপর যে রাষ্ট্রটি প্রতিষ্ঠিত, সেই ভারতে গরুর মাংস খাওয়ার অপরাধে কাউকে পিটিয়ে ও পাথর ছুড়ে হত্যা করা সম্ভব!
মার্কিন গবেষণা সংস্থা পিউ রিসার্চ সেন্টারের ধর্ম ও জনজীবনবিষয়ক সর্বশেষ বার্ষিক জরিপ রিপোর্টে বলা হয়েছে, বিশ্বে ধর্মসংক্রান্ত সামাজিক বৈরিতা উদ্বেগজনক হারে বাড়ছে। আর এর ফলে সৃষ্টি হচ্ছে সামাজিক অস্থিরতা। ২০১৪ সালে প্রকাশিত মার্কিন পররাষ্ট্র বিভাগের আন্তর্জাতিক ধর্মীয় স্বাধীনতাবিষয়ক রিপোর্টেও বিশ্বব্যাপী ধর্মীয় অসহিষ্ণুতা বৃদ্ধির কথা বলা হয়েছে। এতে বলা হয়, বিশ্বের প্রায় প্রতিটি প্রান্তে লাখ লাখ খ্রিস্টান, মুসলমান, হিন্দু ও অন্যান্য ধর্মাবলম্বী তাদের ধর্মীয় বিশ্বাসের কারণে নিজেদের বাসস্থান ছাড়তে বাধ্য হয়েছে। বিশেষভাবে উদ্বেগজনক প্রবণতাটি হল, সারা বিশ্বে ইহুদি ও মুসলমানরা ক্রমবর্ধমান হারে বৈষম্যের শিকার হচ্ছে। যেসব দেশে উদ্বেগজনক হারে ধর্মীয় বৈষম্য বাড়ছে, যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যও রয়েছে তাদের মধ্যে। প্রতিবেদনে ইউরোপ ও এশিয়ায় মুসলিমবিরোধী এবং বিশ্বের অন্যান্য অংশে ইহুদিবিরোধী মনোভাব বৃদ্ধির কথা উল্লেখ করা হয়েছে। মধ্য আফ্রিকান প্রজাতন্ত্রে ধর্মীয় সম্প্রদায়গত সহিংসতা, মিয়ানমারে মুসলিমবিরোধী সহিংসতা এবং উত্তর কোরিয়া, সৌদি আরব, ইরান ও সুদানে সরকার-আরোপিত ধর্মীয় বিধিনিষেধের কারণে অশান্তি বেড়েই চলছে। (আসিফ রশীদ, যুগান্তর- অক্টোবর ২০, ২০১৫)।ধর্মকে পুঁজি করে নানা সংগঠনের ব্যানারে দেশে বিদেশে কোন একটি ভূখণ্ড দখল করে সাধারণ মানুষের উপর হামলা করে ভীতিকর পরিস্থিতি সৃষ্টির আরেক নতুন প্রবণতা দেখা দিচ্ছে। এটিও অশান্তির উল্লেখযোগ্য কারণ।
২(৬)উগ্র জাতীয়তাবাদঃ
একদা জাতীয়তাবাদী চেতনায় ও আদর্শে উজ্জীবিত হয়ে পৃথিবীর বহু শোষিত ও নিপীড়িত জাতি বা গোষ্ঠী ঔপনিবেশবাদ-বিরোধী কিংবা নিজেদের জুলুমবাজ সরকারের নিষ্পেষণের বিরুদ্ধে লড়াই-সংগ্রাম করেছে, নিজেদের সরকার গঠনের পক্ষে এবং রাষ্ট্রীয় তথা রাজনৈতিক সত্তায় পরিণত হওয়ার প্রচেষ্টায় আন্দোলন পরিচালনাও করেছে। জাতীয়তাবাদে উদ্বুদ্ধ হয়ে অনেক পরাধীন ও অবদমিত জাতি বিভিন্ন সময়কালে সাম্রাজ্যবাদী ও বিদেশি শাসন-শোষণ-পীড়ন, দাসত্বের নিগড় থেকে মুক্তির জন্য এবং সকল প্রকার স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে আন্দোলন-সংগ্রামে ব্রতী হয়েছে। তাছাড়া জাতীয় জনসমাজকে ঐক্যবদ্ধ হতে, কোনো জাতির নিজস্বতা ও স্বকীয় বৈশিষ্ট্যের পূর্ণ আত্মপ্রকাশ ও প্রতিষ্ঠাকরণে এবং তার আত্মোপলব্ধির দিক-নির্দেশনা ও অনুপ্রেরণার উজ্জ্বল আদর্শ ও শক্তিরূপে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে জাতীয়তাবাদবিংশ শতাব্দীতে যার উজ্জ্বলতম প্রমাণ : এশিয়া, আফ্রিকা, লাতিন আমেরিকা, সুদূর প্রাচ্য এবং মধ্যপ্রাচ্যের জাতিসমূহ ঔপনিবেশিক ও সাম্রাজ্যবাদী শাসনের বিপক্ষে লড়াই করে জাতীয় স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব অর্জন করেছিল। সেই বিংশ শতকেই উগ্র, অন্ধ ও বিকৃত জাতীয়তাবাদ দুটি বিভীষণ মানবঘাতী বিশ্বযুদ্ধ উপহার দেয় এ বিশ্বকে। যার ফলে নাৎসিবাদ, ফ্যাসিবাদ, সামরিকতাবাদ ইত্যাদির মাধ্যমে বিশ্বজুড়ে জাতীয়তাবাদের নামে সৃষ্টি হয় যুদ্ধ, ধ্বংস, নৈরাজ্য, বর্ণবাদ, জাত্যাভিমান, জাতিবিদ্বেষ, জাতিবৈষম্য, জাতিগত অহমিকা ও জাতি বিস্তারের প্রাধান্য। তৈরি হয় রেসিজম। আগ্রাসী জাতীয়তাবাদ অবশেষে হয়ে ওঠে সামরিকতাবাদ ও সাম্রাজ্যবাদের পথপ্রদর্শক। অশান্তির আর এক উৎস এই জাতীয়তাবাদ। বিশ্বায়নের যুগে এই জাতীয়তাবাদ সংকীর্ণতার উর্ধে উঠতে পারেনি। নিজেদের শ্রেষ্ঠ প্রমাণ করতে গিয়েই অন্যদের হেয় করা সহ নানা প্রকার দমন নিপীড়নে মেতে উঠেছে জাতীতাবাদী চেতনায় গড়ে উঠা আজকের বিশ্ব।
২(৭) অবিচার, জুলুম ও দুঃশাসনঃ
সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় সর্বক্ষেত্রে শান্তি ও স্বস্তি প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হলেও বর্তমান সময়ে প্রায় সর্বক্ষেত্রে অবিচার, জুলুম ও দুঃশাসনের মাত্রা বেড়ে যাচ্ছে। শ্রমজীবি মানুষেরা তাদের ন্যায্য পাওনা ও সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। শোষিত হচ্ছে কিছু মালিক নামের দুর্বৃত্তদের হাতে। বিচারকার্যে প্রভাবশালীদের দৌরাত্মের কারণে মানুষ ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।নিরপরাধীকে অপরাধী সাব্যস্ত করে শাস্তি দেয়া হচ্ছে। শক্তিধরদের দ্বারা দুর্বলরা প্রায়শ নির্যাতিত হবার ঘটনা ঘটছে। দলবাজি, দলপ্রীতি ও পক্ষপাতিত্বের প্রভাবে মানুষ তার নাগরিক অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। যোগ্য মানুষকে যথাযথ পদে পদাসীন না করার ফল ভোগ করতে হচ্ছে রাষ্ট্রকে। স্বাধীন মত প্রকাশের অধিকার, নিরাপদে বেঁচে থাকার ও চলাচলের অধিকার হতে বঞ্চিত হচ্ছে।চিহ্নিত অপরাধী, প্রমাণিত খুনী, ধর্ষক, চোর-ডাকাত-হাইজ্যাকার, সম্পদ লুন্ঠনকারী, নারীর ইজ্জত হরণকারী, মাদকসেবী ওমাদক ব্যবসায়ী এবং সমাজ-রাষ্ট্রের দুর্বৃত্তরা যখন প্রকাশ্যে বুক ফুলিয়ে রাস্তায় নামে তখন মানুষ শত প্রাচুর্যের মাঝেও অস্বস্তিতে থাকে।অশান্তিতে থাকে।
২(৮) প্রতিশোধ স্পৃহাঃ
অপর পক্ষ দ্বারা আক্রমণের শিকার হওয়া কোন ব্যক্তি, গোষ্ঠী, দল বা রাষ্ট্রের মধ্যে মারাত্মক রকমের প্রতিশোধ স্পৃহা ও জিঘাংসার সৃষ্টি হয়।পালটা হামলা কিংবা প্রতিশোধ না নেয়া পর্যন্ত কেউ থেমে যেতে পারেনা। বছরের পর বছর, যুগের পর যুগ ধরেই চলতে থাকে এসব দুরত্ব। পাল্টাপাল্টি হুমকী প্রদান, হামলা, অস্ত্র-গোলাবারুদের তীব্র প্রতিযোগিতা সকল মানুষের জীবনে অশনি সংকেত দেয়। অশান্তির বীজ বপন করে।
২(৯) আদর্শনেতৃত্ব সংকটঃ
যে কোন দেশের অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নের জন্য দরকার সঠিক নেতৃত্বের। সঠিক নেতৃত্ব বিহীন কোন দেশই উন্নয়নের দিকে অগ্রসর হতে পারে না। এ জন্য সব দেশে, সকল ক্ষেত্রে দরকার সঠিক নেতৃত্ব।আমাদের সমাজে আজ নেতার অভাব না থাকলেও সঠিক, যোগ্য ও আদর্শ নেতার খুবই অভাব। এমন নেতার উপস্থিতি দেখা যায় না যিনি মানুষকে লক্ষ্য অর্জনের দিকে সততা, বিশ্বস্ততা ও দক্ষতার সাথে অগ্রভাগেই নেতৃত্ব দিবেন। দুর্নীতি, দলপ্রীতি, স্বজনপ্রীতি, অনৈতিকতার চরিত্রে গড়ে উঠা নেতৃত্বের ফলেই আজ পরিবার, সমাজ রাষ্ট্র কিংবা বিশ্ব হতে শান্তি হারিয়ে গেছে। আদর্শ নেতৃত্বের অভাবে হানাহানি, মারামারি, সহিংসতারব্যাপকতা লাভ করছে।
২(১০) শান্তি স্থাপনে গৃহীত ব্যবস্থার অসারতাঃ
পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র ও বিশ্ব ব্যবস্থায় শান্তি আনার জন্য নানা ব্যবস্থা ও পদক্ষেপ নেয়া হয়। দারিদ্র বিমোচনের নানা কর্মসূচী সম্পর্কে দুনিয়াবাসী অবগত। সন্ত্রাস দমনে নানা আইন বিভিন্ন দেশে প্রণীত আছে। রাজনৈতিক অবস্থার উন্নয়নে কত সংলাপ, টকশো, কত তর্ক-বিতর্ক-পরামর্শ হয় তার কোন ইয়ত্তা নেই। সুবিচার-সুশাসন প্রতিষ্ঠার দাবী করা হলেওঅনৈতিক হস্তক্ষেপ আর নির্লজ্জ দলবাজির কারণে তা নিশ্চিত করা যাচ্ছেনা। শিক্ষার হার বাড়িয়েও সুশিক্ষার অভাবে নৈতিক মূল্যবোধসম্পন্ন সুনাগরিক গঠন করতে ব্যর্থ হচ্ছে অধিকাংশ দেশ। দেশে-দেশে, জাতিতে-জাতিতে, দলে-দলে যে বিভক্তি ও হানাহানি চলছে তা নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হচ্ছে দেশের সরকার আর জাতিসংঘের মত বিশ্বসংস্থা। ব্যর্থতার মূল কারণ হচ্ছেঃ তাদের গৃহীত পদক্ষেপগুলো পক্ষপাতদুষ্ট, বিশেষ শক্তিধর রাষ্ট্র কর্তৃক নিয়ন্ত্রিত, এবং পদক্ষেপ/কর্মসূচী বাস্তবায়নে অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে অনৈক্য ও অসহযোগিতা। এসব পদক্ষেপের বেশীরভাগ স্বল্পমেয়াদী যা দীর্ঘ মেয়াদে অকার্যকর। শান্তি প্রতিষ্ঠার পদক্ষেপে সিদ্ধান্ত গ্রহণকারীদের কথা ও কাজে অমিল, নিজ মত ও স্বার্থের উর্ধে উঠতে না পারা এবং তাদের চারিত্রিক ত্রুটি শান্তির বদলে অশান্তি আনয়নে বেশি উস্কানী দেয়।এসব কারণে আমাদের সমাজে স্থায়ী ও টেকসই শান্তি প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে না। শান্ত পরিবেশ নিমিষেই অশান্ত হয়ে যাচ্ছে। শান্তিতে থাকা একটি পরিবার, একটি সমাজ ও একটি রাষ্ট্র ক্রমশঃ অশান্তির দিকে ধাবিত হচ্ছে।
৩) বিশ্বব্যাপী টেকসই শান্তি প্রতিষ্ঠায়মুহাম্মদ সাঃ এর নীতি ও কর্মসূচীঃ
এ কথা সবারই জানা যে, আইয়ামে জাহেলিয়াতের আরব সমাজ চরম অবস্থায় লিপ্ত ছিল। হত্যা, সন্ত্রাস, নৈরাজ্য, রাহাজানি, নারী নির্যাতন, অশস্নীলতা-বেহায়াপনা, মানবাধিকার লঙ্ঘন, দ্বন্দ-সংঘাত ও হানাহানি-রেশারেশিতে পঙ্গু হয়ে পড়েছিল পুরো সমাজ ব্যবস্থা। শুধুমাত্র মেয়ে সন্তান হিসেবে জন্মগ্রহণ করায় পিতা অপমান বোধ করে জীবিতাবস্থায় মাটিতে পুঁতে রাখত। শির্ক ও পৌত্তিলকতার অভিশাপে সর্বনাশ হচ্ছিল সভ্য জীবনের। মিসর, ভারত, ব্যাবিলন, গ্রীস ও চীনে সভ্যতা সম্পূর্ণরূপে বিধ্বস্ত ও বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছিল। একমাত্র রোম ও পারস্য সভ্যতার উড্ডয়মান পতাকার ঝাঁকজমকে চোখ ঝলসে দিত। অথচ সে সব নয়নাভিরাম প্রাসাদের অভ্যন্তরে চলত লোমহর্ষক যুলুম ও নির্যাতন। জীবনের ক্ষতস্থান থেকে বের হতো উৎকট দুর্গন্ধ। রাজা ও সম্রা্টগণ খোদা হয়ে জেঁকে বসেছিল। তাদের সাথে আঁতাত করে জনগণের উপর প্রভুত্ব চালাত ভূমি মালিক ও ধর্মযাজক শ্রেণী। জনগণের নিকট থেকে মোটা অংকের কর, খাজনা, ঘুষ ও নজরানা আদায় করত। উপরন্তু পশুর মতো খাটনি খাটতে বাধ্য করা হতো। মক্কা ও তায়েফের মহাজনরা সুদী ব্যবসার জাল পেতে রেখেছিল। দাস ব্যবসার অভিশপ্ত প্রতিষ্ঠানগুলো মহা ধুমধামের সাথে চলছিল। মোটকথা মানুষ প্রবৃত্তির গোলামির সর্বনিম্ন স্তরে পৌঁছে গিয়ে হিংস্র হায়েনা ও চতুস্পদ জন্তু-জানোয়ারের মত জীবন-যাপন করছিল। শক্তিধররা দুর্বলদেরকে ছাগল ও ভেড়ার পালের মত নাকে রশি দিয়ে ঘুরাত, আর দুর্বলেরা শক্তিমানদের পদতলে লুটিয়ে থাকত। এহেন পরিস্থিতিতে ৫৭০ খ্রিঃ ১২ রবিউল আউয়ালে মানবজাতির ত্রাণকর্তা হিসেবে বিশ্বনবী মুহাম্মদ (সা.) এর আগমন ঘটেছিল।জীবন ব্যবস্থার মহান শিক্ষক ও মডেল হিসেবে আগমন ঘটেছে মুহাম্মদ (সাঃ) এর। তিনি এ জীবন ব্যবস্থা প্রচার করেছেন, শিক্ষাদান করেছেন, নিজে এর অনুসরণ ও প্রয়োগ করে নমুনা স্থাপন করেছেন। সমগ্র মানবজাতির জন্য শান্তি, কল্যাণ, নিরাপত্তা ও ইনসাফ প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে একমাত্র অনুসরণীয় ও অনুকরণীয় আদর্শ রেখে গেছেন যা কেয়ামত পর্যন্ত চিরভাস্বর ও অমলিন থাকবে। এক্ষেত্রে আল্লাহ রাববুল আলামীন কুরআনে ঘোষণা করেছেন- ‘‘ওয়া ইন্নাকা লা-আলা খুলুকিন আযিম’’ অর্থাৎ ‘‘হে নবী আপনি নীতি-নৈতিকতা ও উত্তম চরিত্রের সর্বোচ্চ শিখরে অধিষ্ঠিত’’। আর মানবজাতিকে উদ্দেশ্য করে আল্লাহ রাববুল আলামীন বলেছেন- ‘‘লাক্বাদ কানা লাকুম ফি রাসূলিল্লাহি উস্ওয়াতুন হাসানা’’ অর্থাৎ ‘‘আল্লাহর রাসূলের মধ্যে রয়েছে তোমাদের জন্য সর্বোৎকৃষ্ট আদর্শ’’।রাসূল (সাঃ) তাঁর উপর অর্পিত দায়িত্ব পালনের মাধ্যমে সর্বযুগের সর্বকালের শ্রেষ্ঠ একটি মানবকল্যাণমূলক রাষ্ট্র ও সমাজ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করে গেছেন।নিম্নে শান্তি ও সমৃদ্ধি আনয়নে মহানবী সাঃ কর্তৃক গৃহীত কিছু ভূমিকার উল্লেখ করার প্রয়াস পাচ্ছিঃ
৩(১)আদর্শ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠাঃ
রাষ্ট্র সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ সংস্থা। এটি এমন একটি রাজনৈতিক কাঠামোর নাম যার মাধ্যমে নির্দিষ্ট কোন ভূখন্ডের অধিবাসীরা তাদের সামাজিক জীবনের আইন-শৃঙ্খলা, নিরাপত্তা ও উন্নয়ন সাধনের জন্য একটি নিয়মতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করেন। পাশাপাশি ভূখন্ডকে স্থিতিশীল ও শীক্তশালী করা, এর ব্যবস্থাপনা, শিক্ষা-সংস্কৃতির বিকাশ সাধন, আইন ও নিরাপত্তা ইত্যাদির অগ্রগতি যখন নিয়মতান্ত্রিকতার সাথে চলতে থাকে তখনই সৃষ্টি হয় রাষ্ট্রের। রাষ্ট্র ও প্রশাসনিক ব্যবস্থা মানব ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হিসেবে যুগ পরিক্রমায় রাষ্ট্র ও প্রশাসনিক ব্যবস্থার এর প্রয়োজনীয়তা প্রবলভাবে অনুভূত হয়ে আসছে। সৃষ্টির আদিকাল থেকে নবী ও রাসূলগণ রাষ্ট্র পরিচালনার মহান দায়িত্ব পালন করেন। এরই ধারাবাহিকতায় সর্বশেষ নবী মুহাম্মাদ (সা.) আল্লাহর নির্দেশে মোতাবেক মদীনায় একটি কল্যাণকামী ইসলামী রাষ্ট্রের গোড়াপত্তন করেন। হয়। এ মর্মে আল-কুরআনে তাঁকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। আল্লাহ বলেন,
‘‘(হে নবী) আমি সত্য ও সঠিকভাবে তোমার প্রতি ও কিতাব নাযিল করেছি, তা পূর্ববর্তী গ্রন্থসমূহের সত্যতা প্রতিপন্ন করে এবং তার সংরক্ষণ করে। সুতরাং আল্লাহ যা কিছু নাযিল করেছেন, তদানুযায়ী লোকদের মধ্যে তুমি ফায়সালা করো। আর মানুষের প্রবৃত্তির অনুবর্তন করতে গিয়ে তোমার নিকট আগত সত্য থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবে না।’’ (সূরাহ আল-মায়িদাহ্: ৪৮)
রাসূল (সা.) আল-কুরআনের নির্দেশ অনুযায়ী মদীনায় হিজরতের পর সেখানে স্বাধীন ও উন্মুক্ত পরিবেশে যে ইসলামী সমাজ ও রাষ্ট্র ব্যবস্থার ভিত্তি স্থাপন করেন তা-ই পৃথিবীর ইতিহাসে প্রথম ইসলামী রাষ্ট্র হিসেবে পরিচিত। এ স্বৈরাচারী শাসন অথবা শেখতন্ত্রের পরিবর্তে আল্লাহর সার্বভৌমত্ব নব প্রতিষ্ঠিত ও ইসলামী প্রজাতন্ত্রে স্বৈরাচারী শাসন অথবা শেখতন্ত্রের পরিবর্তে আল্লাহর সার্বভৌমত্ব স্বীকৃতি লাভ করে। ধর্ম ও রাষ্ট্রের সহাবস্থানে ইসলাম একটি সর্বজনীন ধর্ম ও রাষ্ট্র ব্যবস্থায় পরিণত হয়। এক দশকের কম সময়ের মধ্যেই মদীনার এ রাষ্ট্র জাতীয় ও জনকল্যাণ রাষ্ট্রের রূপ পরিগ্রহ করে। অহীর মাধ্যমে রাসূল (সা.) এ রাষ্ট্রের যাবতীয় কার্যক্রম দক্ষতার সাথে পরিচালনা করেন। ১৪০০ বছর পূর্বেকার সমাজ ও এবং রাষ্ট্র ব্যবস্থা আজও একবিংশ শতাব্দীর ঊষালগ্নে বিশ্ববাসীর কাছে এক অনুসরণযোগ্য রাষ্ট্র ব্যবস্থার মডেল হয়ে আছে হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করেছে।
আল্লাহর সার্বভৌমত্ব স্বীকার করে কল্যাণমূলক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠাঃ
সার্বভৌমত্ব একমাত্র আল্লাহর। তিনি সর্বময় কর্তৃত্বের অধিকারী। তিনি ছাড়া অন্য কোন মানবীয় ও অমানবীয় শক্তির পক্ষ থেকে নির্দেশ বা ফয়সালা দান করার কারোর অধিকার নেই। পৃথিবীতে তাঁর এ সার্বভৌমত্ব প্রয়োগের জন্য তিনি নিজেই মানুষকে খলীফা হিসেবে নিযুক্ত করেছেন। রাসূলুল্লাহ (সা.) এই সার্বভৌমত্বের উপর ভিত্তি করে মদীনায় একটি কল্যাণমূলক ইসলামী রাষ্ট্রের গোড়াপত্তন করেন ।তিনি এ রাষ্ট্রে আইন, শাসন, সমাজ, ব্যক্তি, রাজনীতি, অর্থনীতি, সামরিক ও বেসামরিক প্রভৃতি সেক্টরে আল্লাহর সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠা করে দশ বছর শাসনকার্য পরিচালনা করেন। এ সার্বভৌমত্বের বাইরে কোন নাগরিক অবস্থান করতে পারেনি। তিনি রাষ্ট্রের জনগণকে বুঝাতে সক্ষম হয়েছিলেন যে, আল্লাহ রিয্কদাতা, সকল ক্ষমতার মূল উৎস। কেবলমাত্র তাঁর সার্বভৌমত্বেই নিহিত রয়েছে মানুষের মুক্তি, শান্তি ও প্রগতি। মানুষ মানুষের দাস হতে পারে না, কারো গোলামীও করতে পারে না। কেবল দাসত্ব ও গোলামী আল্লাহর জন্য নির্দিষ্ট। আল্লাহ তাঁর সার্বভৌমত্ব প্রয়োগকারী হিসেবে তাঁর প্রতিনিধি বা খলীফা নিযুক্ত করেছেন। আর আল্লাহই হলেন এই প্রতিনিধির নিয়ামক শক্তি। তাই কোন ব্যক্তি বা রাষ্ট্রনায়ক নিজেদের খেয়াল-খুশিমত আইন প্রণয়ন করার অধিকার রাখে না। রাসূল (সা.) আল্লাহর এ সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে বিশ্ব মানবতাকে গোলামীর শৃঙ্খল থেকে মুক্ত করে মানব জীবনে আইনের শাসন, জীবন ও সম্পদের নিরাপত্তা এবং বিশ্বজনীন ভ্রাতৃত্ববোধ পৃথিবীকে উপহার দিতে সক্ষম হয়েছিলেন। ঐশীর ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত এ রাষ্ট্রে জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সকল মানুষ আইনের চোখে সমান বলে বিবেচিত হয়েছিল। পৃথিবীতে আল্লাহর প্রতিনিধি হিসেবে ইসলামী রাষ্ট্রের প্রকৃত পরিচালক রাসূল (সা.) ছিলেন রাজনৈতিক ও ধর্মীয় কর্তৃত্বের একমাত্র উৎস;। আইন, প্রশাসনিক, সামরিক ও বিচার বিভাগীয় সকল ক্ষমতা তাঁর হাতে কেন্দ্রিভূত ছিল। একটি সরকার ও প্রশাসন প্রতিষ্ঠার জন্য তিনি বেশ কিছু সংখ্যক সাহাবীকে রাষ্ট্রের বিভিন্ন পদে নিয়োগ করে তাদের নিকট স্বীয় ক্ষমতা হস্তান্তর করেছিলেন। তাঁর এ বেসামরিক প্রশাসন যন্ত্রের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন কেন্দ্রীয়, প্রাদেশিক এবং স্থানীয় প্রশাসকগণ। কেন্দ্রীয় প্রশাসকদের মধ্যে ছিলেন স্বয়ং রাসূল (সা.) এবং তাঁর সব প্রতিনিধি, উপদেষ্টা, সচিব, দূত, কমিশনারগণ, বা বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা, কবি, বক্তা এবং আরো নানা ধরনের কর্মকর্তাগণ। অপরপক্ষে প্রাদেশিক কর্মকর্তাগণ ছিলেন বিভিন্ন গভর্নর, স্থানীয় প্রশাসকবৃন্দ, প্রতিনিধিবর্গ, ও বিচারকবৃন্দ ও বাজার কর্মকর্তাগণ। তাঁদের সকলকে নিয়ে রাসূল (সা.) এক দশকের শাসনামলে বেসামরিক প্রশাসনের বিভিন্ন শাখা ও কর্মকর্তাদের কার্যপ্রণালীর ঐতিহাসিক বিবর্তন আনয়ন করেন।
পরামর্শ ভিত্তিক রাষ্ট্র পরিচালনাঃ
আল-কুরআনে রাসূলে কারীমকে (সা.) পরামর্শের ভিত্তিতে কার্যনির্বাহ করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। কুরআনের এ নির্দেশের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে রাসূলে কারীম (সা.) রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে মজলিসুস শূরা বা পরামর্শ সভা গঠন করেন। মজলিসুস শূরা গঠনে রাসূল (সা.) একটি কৌশল অবলম্বন করেন। তাহলো এ পরামর্শ সভাকে গতিশীল ও সার্বজনীন করার জন্য মদীনার বাইরে এমন কি আরবীয় গন্ডির বাইরের কয়েকজনকে এর সদস্যভুক্ত করেন। মুহাজির ও আনসারী বিজ্ঞ সাহাবী ছিলেন এ সভার অন্যতম সদস্য। রাষ্ট্রনীতি নির্ধারণ, প্রশাসনিক কাঠামোর রূপরেখা দান, শাসন প্রণালী প্রভৃতি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় এ শূরা নির্ণয় করত। তিনি মজলিসসে শূরার সদস্যদের সাহাবীগণের সঙ্গে বিভিন্ন বিষয়ে পরামর্শ করতেন এবং তাদের পরামর্শ গ্রহণ করেছেন। তবে কুরআন তাকে যে অলঙ্ঘনীয় ব্যাপক ক্ষমতা দিয়েছে তার প্রেক্ষিতে তিনি সে সব পরামর্শ গ্রহণ বা বর্জন করার এখতিয়ার রাখতেন। তিনি সাহাবীদের সঙ্গে পরামর্শ করার পর যে মতটি অধিক সঠিক ও কল্যাণকর মনে করেছেন সেটিই গ্রহণ করেছেন। সম্প্রদায়গত স্বার্থ, ধর্মীয়, সামাজিক ও রাজনৈতিক বিষয়ক প্রশ্নে প্রতিনিয়ত পরামর্শ সভা চলত। সে পরামর্শের ভিত্তিতে তিনি রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছেন। উদাহরণস্বরূপ উল্লেখ করা যেতে পারে যে, হযরত সালমান ফারিসীর পরামর্শক্রমে খন্দকের যুদ্ধে পরিখা খনন এবং তায়িফে অভিযান চলাকালে অবরুদ্ধ শত্রুদের বিরুদ্ধে মিনজানিক ব্যবহার করা সংক্রান্ত পরামর্শ রাসূল (সা.) তিনি বিনা বাক্যে গ্রহণ করেন। রীতি পরামর্শনীতি অনুসরণ করেই মদীনায় মসজিদে নববীর স্থান নির্বাচন এবং মুয়াখাতের (ভ্রাতৃত্ববোধ) রীতি প্রচলিত হয়। রাসূল কারীম (সা.) কোন কোন সময় পরামর্শের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নেয়ার পর সার্বিক কল্যাণের কথা চিন্তা করে কৌশলগত কারণে তা পরিবর্তন করতেন। যেমন ঐতিহাসিক তথ্যাবলী থেকে জানা যায় যে, খায়বার অভিযানকালে কয়েকটি নির্দিষ্ট ধরনের গাছ কেটে ফেলা সম্পর্কে আল-হুবাব ইবনুল মুনযিরের (রা.) পরামর্শ তিনি রাসূলে কারীম (সা.) মেনে নিলেও পরবর্তী পর্যায়ে হযরত আবু বকরের (রা.) ভিন্নতর পরামর্শে তিনি উক্ত সিদ্ধান্ত প্রত্যাখ্যান করেন। ঘটনাক্রমে কুরআন উভয় মতের যথার্থতা ও উপযোগিতার পক্ষে সাক্ষ্য প্রদান করে। রাসূলে কারীম (সা.) কোন কোন ক্ষেত্রে পরামর্শদাতাদের পরামর্শ শুনেছেন কিন্তু সুদূর প্রসারী চিন্তা-ভাবনা ও সময়োপযোগী কৌশল অবলম্বন করে তাদের পরামর্শ গ্রহণ করেননি। এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করা যেতে পারে যে, হৃদাইবিয়ার সন্ধির ব্যাপারে সমস্ত সাহাবী মক্কার কাফিরদের সাথে সন্ধি করার সম্পূর্ণ বিরোধী ছিলেন। কিন্তু এতদসত্ত্বেও তিনি সন্ধি করলেন এবং তা কার্যকর করলেন। শেষে সন্ধি করার এ কৌশল গ্রহণ করার ফলশ্রুতিতে পরবর্তীকালে এটি মুসলমানদের জন্য প্রকাশ্য বিজয়ের রূপ পরিগ্রহ করে। অনুরূপভাবে উসামা ইবন যায়েদকে সেনাপতি বানানোর বিরুদ্ধে বড় বড় সাহাবী মতামত দেন। কিন্তু রাসূলে কারীম (সা.) এ বিষয়ে তাদের বিরোধিতা পরোয়া না করে হযরত উসামাকে (রা.) নিজ হাতে পতাকা দিয়ে বললেন, ‘‘তুমি রওয়ানা হয়ে যাবে সেখানে, যেখানে তোমার পিতা শহীদ হয়েছেন এবং সেই স্থানের লোকদের অশ্ব ক্ষুরে নিষ্পেষিত করবে। আমি তোমাকে এই বাহিনীর সেনাধ্যক্ষ নিযুক্ত করলাম।’’ এ সব ঘটনা থেকে পরামর্শ গ্রহণের ব্যাপারে নবী কারীম (সা.) এর এ নীতির সন্ধান মিলে যে, নেতা পরামর্শ চাইবেন সংশ্লিষ্ট লোকেরাও পরামর্শ দিবে; কিন্তু তার নিকট যে পরামর্শ অধিক সঠিক ও কল্যাণকর মনে হবে তা তিনি গ্রহণ করবেন।
নেতা নির্বাচনঃ
গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সুষ্ঠু, সুচিন্তিত সিদ্ধান্ত গ্রহণের উপরই জনগণের সৌভাগ্য ও দুর্ভাগ্য একান্তভাবে নির্ভর করে। এ কারণে নেতৃত্ব ও কর্তৃত্বের বিষয়টি সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। তাই রাসূলে কারীম (সা.) রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে নেতৃত্ব নির্বাচনে যোগ্য প্রার্থীকে নিয়োগ করেন। তিনি নেতৃত্ব নির্বাচনে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে কেবলমাত্র যিনি যোগ্য ও বিশেষজ্ঞ নিরপেক্ষভাবে তাকেই কেবলমাত্র তিনি মনোনীত করতেন। এ ক্ষেত্রে পক্ষপাতদুষ্ট কিংবা ক্ষমতা বা পদের জন্য লালায়িত ব্যক্তিকে নেতা নির্বাচন করতেন না। তিনি যোগ্য নেতৃত্ব নির্বাচনের ক্ষেত্রে যে অনুপম আদর্শ স্থাপন করেছেন তা স্থান-কাল-পাত্রভেদে সকল যুগে সকল মানুষের জন্য এক অনুসরণীয় দৃষ্টান্ত। এ মর্মে তিনি সকলের উদ্দেশ্যে ঘোষণা করেন, ‘‘আল্লাহর নামে শপথ করে বলছি, আমি এই দায়িত্বপূর্ণ কাজে এমন কোন ব্যক্তিকে নিয়োগ করব না, যে তা পাওয়ার জন্য প্রার্থী হবে, অথবা এমন কাউকেও নয়, যে তা পাওয়ার জন্য লালায়িত হবে।’’
ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠাঃ
প্রশাসনিক কর্মদক্ষতার মূর্ত প্রতীক ছিলেন মহানবীরাসূল (সা.)। তিনি আল্লাহর আইন অনুযায়ী ইনসাফের সাথে বিচারকার্য সম্পাদন করতেন। খোদায়ী বিধানের প্রধান ব্যাখ্যাদাতা হিসেবে তিনিই ছিলেন সর্বোচ্চ বিচারপতি। ইমাম আল-কুরতবী, ইবন হিশামসহ খ্যাতনামা পতিগণের পরিবেশিত ঐতিহাসিক তথ্যাবলী থেকে জানা যায় যে, সর্বোচ্চ বিচারক হিসোবে রাসূল (সা.) অসংখ্য মামলার সিদ্ধান্ত দিয়েছেন। অথচ পশ্চিমা পন্ডিতরা যারা ইসলামী বিচার ব্যবস্থাকে আধুনিক বিচার ব্যবস্থার মানদন্ডে বিচার করেন তারা অপপ্রচার করে থাকেন যে, ইসলামের স্বর্ণালী যুগে বিচার বিভাগের তেমন প্রাতিষ্ঠানিক বিকাশ ঘটেনি। এরূপ ধরনের মিথ্যা ধারণাপোষণের জন্য তাদের ইসলাম সম্পর্কে অজ্ঞতাই দায়ী। বিচারের ক্ষেত্রে রাসূল (সা.) আল্লাহর আইন কার্যকর যেমন কোনরূপ দুর্বলতা দেখাননি তেমনি সে ক্ষেত্রে তিনি কোন সুপারিশও গ্রহণ করেননি। বিচারের কাঠগড়ায় মুসলিম, অ-মুসলিম ছিল সমান। শরী‘য়তের দন্ডাদেশ কার্যকর করার ক্ষেত্রে আল্লাহর আইন জারি করার ব্যাপারে সুপারিশের কথা শুনে তিনি রাগান্বিত হয়েছেন এবং তীব্র ভাষায় তার প্রতিবাদ করেছেন। বর্ণিত আছে যে, মাখযুমী বংশের একজন মহিলা চুরির অভিযোগে অভিযুক্ত হলে সে হয়। সে মহিলা রাসূলের (সা.) অত্যন্ত প্রিয় ব্যক্তি উসামা ইবন যায়েদের মাধ্যমে তার দন্ডাদেশ মওকুফ করার ব্যাপারে রাসূলের (সা.) এর নিকট সুপারিশের জন্য অনুরোধ করেন। রাসূল (সা.) তার এ সুপারিশের কথা শুনে উসামাকে ধমক দিয়ে বলেন, আল্লাহ ঘোষিত দন্ড বিধি কার্যকরণের ক্ষেত্রে তুমি কি সুপারিশ করছ? জেনে রাখ!‘‘আল্লাহর কসম! যদি মুহাম্মদের মেয়ে ফাতেমাও চুরি করত, অবশ্যই আমি তার হাত কেটে দিতাম।’’
আইন প্রণয়ন ও তার যথাযথ প্রয়োগঃ
রাসূল (সা.) আল্লাহ প্রদত্ত বিধি-বিধান ও মজলিসে-ই-শূরায় চিন্তা গবেষণা করে পারস্পরিক আলোচনার-পর্যালোচনার মাধ্যমে আইনসমুহ প্রণয়ন করতেন। তিনি (সাঃ) আল্লাহর আইন বাস্তবায়নের সময়োপযোগী পদক্ষেপ গ্রহণ করেছেন এবং সর্বক্ষেত্রে সফলভাবে দায়িত্ব পালন করেছেন। তিনি মনে করতেন, শুধু রাষ্ট্র শক্তির সাহায্যে আইন কার্যকর করলে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠিত হবে তা নয়; করা একমাত্র কাজ নয়। বরং সে আইনের ভিত্তিতে ব্যক্তি, সমাজ এবং পরিবার গঠন ও লালনের মাধ্যমে আইন বাস্তবায়ন করাই হল আসল উদ্দেশ্য। এ জন্য তিনি আইন কার্যকর কারার পূর্বেই আইন মানার জন্য যে পরিবেশ ও চরিত্র গঠনের প্রয়োজন তা সুনিশ্চিত করার পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। ফলে রাষ্ট্রীয়ভাবে আইন মানার প্রবণতার সাথে সাথে ব্যক্তি ও সমাজ জীবনে তা গ্রহণ ও মান্য করার স্পৃহা সৃষ্টি হয়। প্রতিষ্ঠিত হয় আইনের শাসন, মূলোৎপাটিত হয় স্বেচ্ছাচারিতা, দুর্নীতি ও দাম্ভিকতা। ঐতিহাসিক তথ্য বিশেষণ করলে দেখা যায় যে, আইনের শাসন বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে রাসূল (সা.) যে কৌশল অবলম্বন করেন তা ছিল অনুকরণীয়। নবুওয়তের পর মক্কায় ইসলামের দাওয়াত দান, এবং মদীনায় হিজরত, এবং তথায় ইসলামী প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করার পর মক্কা বিজয়ের পূর্ব পর্যন্ত এইসুষম পরিবেশ বিরাজিত না থাকায় তিনি কোন মূর্তি ভাঙ্গার উদ্যোগ নেননি। অন্তর্বর্তীকালীন সময়ে মূর্তি পূজার বিরুদ্ধে কথা বলেছেন এবং মূর্তির অর্চনা থেকে মানুষকে এক আল্লাহর ইবাদতের দিকে ফিরিয়েছেন।
জবাবদিহিতা শাসকের দায়িত্ব ও জবাবদিহিতাঃ
রাসূলুল্লাহর (সা.) রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি ছিল, শাসন, কর্তৃত্ব এবং তার ক্ষমতা ইখতিয়ার ও এবং অর্থ-সম্পদ আল্লাহ এবং মুসলমানদের আমানত। আল্লাহর ভীরু, ঈমানদার এবং ন্যায় পরায়ন লোকদের হাতে তা ন্যস্ত থাকবে। কেউ ইচ্ছামত বা স্বার্থবুদ্ধি প্রণোদিত হয়ে এ আমানতের খিয়ানত করার অধিকার রাখে না। এ আমানত যাদের হাতে সোপর্দ করা হবে তারা এর দায়িত্ব পালন সম্পর্কে জবাবদিহি করতে বাধ্য। রাসূলুল্লাহর (সা.) সরকার কাঠামোতে ও প্রশাসনিক পরিমন্ডলে সরকারি যাবতীয় কার্যক্রমের জবাবদিহির প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়। তিনি আল্লাহর বাণী উচ্চারণের মাধ্যমে তার জবাবদিহিতার বহিঃপ্রকাশ ঘটান এভাবে, ‘‘আমানত বহনের যোগ্য ব্যক্তিদের হাতে আমানত সোপর্দ করার জন্য আল্লাহ তোমাদেরকে নির্দেশ দিয়েছেন। আর যখন মানুষের মধ্যে ফায়সালা করবে, ন্যায়নীতির সাথে ফায়সালা করবে, আল্লাহ তোমাদেরকে ভাল উপদেশ দিচ্ছেন। নিশ্চয় আল্লাহ সবকিছু শোনেন ও জানেন।’’ (সূরাহ নিসা: ৫৮)
তিনি দায়িত্বশীলদেরকে জবাবদিহিতার কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে তিনি বলেন, ‘‘সাবধান তোমাদের প্রত্যেকেই দায়িত্বশীল এবং প্রত্যেককেই তার দায়িত্ব সম্পর্কে জবাবদিহি করতে হবে। মুসলমানদের সবচেয়ে বড় নেতা – যিনি সকলের উপর শাসক হন তিনিও দায়িত্বশীল। তাঁকেও তাঁর দায়িত্ব সম্পর্কে জবাবদিহি করতে হবে।’’ (বুখারী)
অমুসলিমদের সাথে সম্পর্ক ও সহাবস্থান
রাসূলুল্লাহর (সা.) রাষ্ট্র ব্যবস্থায় অমুসলিম সংখ্যালঘুদের সঙ্গে সম্পর্ক ও সহাবস্থানের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিলেন। মদীনায় হিজরতের পর তিনি বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে ভ্রাতৃত্ববোধ ও সম্প্রীতি স্থাপন করে এক তুলনাবিহীন রাজনৈতিক ঐক্য প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি রাজনৈতিক ধর্মীয়, সামাজিক, রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক ক্ষেত্রে এবং মুসলিম ও অমুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে ধর্মীয় সহিষ্ণুতার ভিত্তিতে সহনশীলতার মনোভাব গড়ে তোলার জন্য একটি সনদ প্রণয়ন করেন। এ প্রণীত এ সনদ পৃথিবীর ইতিহাসে প্রথম লিখিত সনদ হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করে। তিনি এর মাধ্যমে তৎকালীন বিশ্বে ধর্ম ও রাজনীতির সমন্বয়ে যে ইসলামী উম্মাহ প্রতিষ্ঠা করেন, উত্তরকালে তা বিশাল ইসলামী সাম্রাজ্যের মহীরুহে পরিণত হয়। তিনি এ সনদ প্রণয়নে যে কৌশল অবলম্বন করেন তাহলোঃ মদীনার বিভিন্ন অমুসলিম সম্প্রদায়কে প্রাথমিকভাবে ইসলামী প্রজাতন্ত্রের সহায়ক শক্তিতে পরিণত করা এবং তাদের ও মুসলামানদের সহঅবস্থানের বিষয়টি নিশ্চিত করা। তিনি এ সনদের মাধ্যমে যে মহানুভবতা ও ধর্মীয় সহিষ্ণুতার পরিচয় দেন তা বিশ্বের ইতিহাসে সত্যিই বিরল। রাসূল (সা.) মুসলমানদের সাথে অমুসলিমদের সহাবস্থান এবং জান-মাল, ইজ্জত-আব্রুর নিরাপত্তা এবং নিজ নিজ ধর্ম পালনে স্বাধীনতা দান করেন। তিনি ঘোষণা দেন, কারো ধর্ম মতে কোনরূপ অসম্মান করা যাবে না এবং সকলেই পরস্পর ভাই ভাই হিসেবে সহাবস্থান করবে। সংখ্যা লঘু অমুসলিমদের অধিকারের দিকে দৃষ্টি দিয়ে তিনি উদাত্ত কণ্ঠে ঘোষণা দেন যে, ‘‘যে লোক কোন যিম্মিকে কষ্ট দিবে আমি তার প্রতিবাদকারী হব।, আর আমি যার প্রতিবাদকারী হব, কিয়ামতের দিন তার বিরুদ্ধে প্রতিপক্ষ হয়ে দাঁড়াব।’’
ইতিবাচক উদ্দেশ্যে যুদ্ধ পরিচালনাঃ
মদীনায় মাত্র দশ বছরের জীবনে রাসুল সাঃ ছোট বড় তিরাশিটি অভিযান পরিচালনা করতে হয়। এর মধ্যে সাতাশটিতে তিনি নিজেই সেনাপতির ভূমিকা পালন করেন। অবশ্য এর মধ্যে মাত্র নয়টি যুদ্ধে সশস্ত্র সংঘাত ঘটে। এসব যুদ্ধে বিজয় অর্জন রাসূলের (সা.) অপূর্ব যুদ্ধকৌশলের বারতা বহন করে। রাসূলের জীবনে সংঘটিত এই যুদ্ধগুলো ছিল প্রতিরক্ষামূলক। কেননা তিনি যুদ্ধবাজ ছিলেন না। ছিলেন না সাম্রাজ্যবাদী। উদ্দেশ্য প্রণোদিত হয়ে হামলাও করেননি তিনি; বরং শত্রুপক্ষের আক্রমণ থেকে বাঁচার জন্য আত্মরক্ষামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। বাতিল শক্তির বহুবিধ হুমকি ও বিপদের মুখে মদীনার শিশু ইসলামী রাষ্ট্রকে রক্ষা করার জন্যইরাসূল (সা.) সামরিক অভিযানে অংশ নিতেন।
নৈতিক ও কল্যাণমূখী শিক্ষার বিস্তারঃ
শিক্ষা জাতির মেরুদন্ড। যে জাতি যত বেশি শিক্ষিত সে জাতি তত বেশি উন্নত। রাসূলুল্লাহ (সা.) যে যুগে আবির্ভূত হয়েছিলেন সে যুগ ছিল অন্ধকারাচ্ছন্ন। ইসলামের ইতিহাসের পরিভাষায় এ যুগকে অজ্ঞতার যুগ বলা হয়ে থাকে। রাসূল (সা.) শিক্ষাদানের মাধ্যমে অজ্ঞতার এই ঘোর অমানিশাকে দূরীভূত করেন। তিনি জ্ঞানার্জন করাকে বাধ্যতামূলক করেন। কারণ বিদ্বান বা জ্ঞানীরাই সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক, এমনকি রাষ্ট্রীয় ও আন্তর্জাতিক জীবনে সুখ-শান্তি প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে পারে। আর প্রতিটি মুসলমান এ সকল বিষয়ে পরিপূর্ণ জ্ঞান অর্জন করতে না পারলে আল্লাহর পূর্ণাঙ্গ ইবাদতও সম্ভব নয়। তাই তিনি সাধারণভাবে সকল শ্রেণীর লোকদেরকে জ্ঞানার্জনের প্রতি অনুপ্রাণিত করেন। নৈতিক ও কল্যাণমূখী শিক্ষার মাধ্যমে একটি চরিত্রবান জাতি উপহার দিয়েছিলেন বিশ্বনবী মুহাম্মদ সাঃ।
আন্তর্জাতিক সম্পর্ক ও নীতির অনুসরণঃ
রাসূল (সা.) ছিলেন অবিসংবাদিত বিশ্বনেতা ও সফল রাষ্ট্র নায়ক। তাই নির্দিষ্ট কোন ভৌগোলিক সীমারেখার মধ্যে ইসলামী নেতৃত্ব ও কর্তৃত্ব সীমাবদ্ধ থাকবে তা তিনি চাননি। এর সম্প্রসারণের কৌশল হিসেবে রাষ্ট্রীয়ভাবে আরব উপদ্বীপের বাইরের অঞ্চলগুলোতে একদিকে যেমন তিনি লোক প্রেরণ করে ইসলামী দাওয়াতের সর্বজনীনতা নিশ্চিত করেছেন। অপরদিকে তেমনি বিভিন্ন রাষ্ট্র প্রধানদের সাথে যোগাযোগ স্থাপনের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক ও বৈদেশিক নীতির ভিত্তিকে সুদৃঢ় করেন। পাশ্চাত্য সভ্যতা উদয়ের বহু বছর পূর্বে একমাত্র রাসূলই (সা.) রাষ্ট্র পরিচালনা ব্যবস্থা বৈদেশিক বা পররাষ্ট্রনীতি উদ্ভাবন করেন।রাসূল (সা.) সমকালীন রাজা বাদশাহদেরকে চিঠি লিখতে গিয়ে প্রচলিত রীতিনীতি মেনে চলতেন। যেমনঃ সিল মারার জন্য আংটি তৈরি করান এবং তাতে মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ শব্দটা খোদাই করান।
৩(২) সুষম অর্থনৈতিক ব্যবস্থার প্রতিষ্ঠাঃ
হযরত মুহাম্মদ (সা.) বিশ্বের একজন যোগ্য অর্থনীতিবিদ হিসেবে একটি সুন্দর ভারসাম্য অর্থনীতির রূপরেখা প্রণয়ন করে গেছেন। তিনি রাষ্ট্রের আর্থ-সামাজিক প্রশাসনিক উন্নয়ন তথা ধনী দরিদ্র বৈষম্য দূর করার লক্ষ্যে একটি উৎপাদনমুখী অর্থনৈতিক ব্যবস্থা কায়েম করে গেছেন।তাঁর গৃহীত উল্লেখযোগ্য কিছু নীতিমালা হলোঃ
সম্পদের মালিক আল্লাহ:
অর্থনৈতিক সমস্যার সমাধানে ইসলামের সবচেয়েবড় অবদান হচ্ছে অর্থ-সম্পদ সম্পর্কিত প্রাচীন ও গতানুগতিক ধারার আমূল পরিবর্তন সাধন। আবহমান কাল ধরে ধন-সম্পদকেই মানুষ সবচেয়ে অধিক মূল্যবান এবং একমাত্র কাম্য বস্ত্ত মনে করে আসছে। আর রাসুল সাঃ নিশ্চিত করলেন যে, এ সম্পদের একমাত্র মালিক হলেন মহান আল্লাহ রাববুল আলামীন।
সুদ প্রথার বিলোপ সাধন:
সুদের নেতিবাচক প্রতিক্রিয়ায় আজকের বিশ্বে বিরাজ করছে অস্থিরতা, ধনী-নির্ধনের মধ্য আকাশ-পাতাল বৈষম্য, হানাহানি, যুদ্ধ-বিগ্রহ ইত্যাদি। কারণ সুদভিত্তিক সমাজে দুনিয়ার সকল সম্পদ সমাজের গুটিকতক লোকের হাতে কুক্ষিগত থাকে এবং সমাজের অপরপ্রান্তে নেমে আসে ইরিত্রিয়া ও ইথ্রিপিয়ার মত দুর্ভিক্ষ। ক্ষমতা ও অবৈধ সম্পদের নেশায় মানুষ থাকে মত্ত। রাসুল সাঃ সুদ দেয়া, নেয়া এমনকি সুদের দলিল লেখক ও সাক্ষীকে অভিশপ্ত বলে ঘোষণা দিলেন। আরো বললেনঃ সুদের ৭০ টিরও বেশি গুণাহ আছে। তার মধ্যে নিম্নেরটি হল নিজের মায়ের সাথে জিনা করা। ফলে মানুষ ফিরে আসল। শান্তির বারতা প্রবাহিত হতে লাগল।
যাকাতভিত্তিক অর্থব্যবস্থা:
অর্থনৈতিক সমস্যার সমাধানে সমাজে যাকাতের ভূমিকা অনস্বীকার্য। আজকের সমাজের অর্থনৈতিক মেকানিজম হল যাকাত ব্যবস্থা চালু করা। রাসূল (সা.) বলেছেন- নিশ্চয় আল্লাহ সাদাকাহ ফরজ করেছেন, যা ধনীদের কাছ থেকে আদায় করে দারিদ্র্যদের মধ্যে বণ্টন করা হবে।যাকাত আদায় ও বটনের মাধ্যমে আয় বৈষম্য দূর হয়ে একটি ভারসাম্যপূর্ণ অভাব-দারিদ্র মুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠা হয়েছিল।
শ্রমিকের অধিকার প্রতিষ্ঠা:
রাসুল সাঃ এর নীতি ছিল মনিব ও শ্রমিকের সম্পর্ক হবে ভাইয়ের সম্পর্ক। এখানে শ্রেণী সংঘাত, শ্রেণী সংগ্রাম কিংবা শ্রেণী বিদ্বেষের কোন সুযোগ নেই।শ্রমিকদের অধিকারকে মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে বিবেচনা করে তাদের গায়ের ঘাম শুকানোর পূর্বেই ন্যায্য পাওনা আদায় করে দেয়ার নির্দেশ দিয়ে রাসূল (সা.) শ্রমজীবিদের অধিকারকে নিশ্চিত করেছেন। শ্রমিকের মজুরির ক্ষেত্রে মহানবী (সা.) এমন পরিমাণ ভাতা দেয়ার নির্দেশ দিয়েছেন যদ্বারা সে নিজে ও তার পরিবারের ভরণ-পোষণ করা চলে। মহানবী (সা.) বলেন: মজুর ও শ্রমিকের খাদ্য ও বস্ত্র দিতে হবে মালিকের তথা রাষ্ট্রের।
স্বহস্তেসম্পদ উপার্জনকে উতসাহদান ও ভিক্ষাবৃত্তি নিষিদ্ধকরণঃ
মহানবী (সা.) তার অর্থ ব্যবস্থার তথা সম্পদ বণ্টন এর মাধ্যমে জীবিকা অর্জন ও ব্যবসা বাণিজ্যে বেকারদেরকে প্রেরণা দিয়ে অর্থনৈতিক উন্নয়ন ত্বরান্বিত করেছিলেন। তিনি স্বহস্তে জীবিকার্জনকে এবং সম্পদ অর্জনকে শরিয়তের অংশ হিসেবে ঘোষণা দিয়ে বলেন: স্বহস্তে উপার্জিত সম্পদই হচ্ছে সর্বোত্তম সম্পদ।তিনি আরো বলেন- রশি নিয়ে বনে গিয়ে এক বোঝা কাষ্ঠ আহরণ করা এবং তা বিক্রি করে অর্থোপার্জন করা লোকের কাছে ভিক্ষা করা থেকে উত্তম। যেখানে দেওয়া ও না দেওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
কল্যাণকর ও সুষম ব্যবসায় নীতিঃ
ব্যবসায়ের নীতি কেমন হবে সে সম্পর্কে রাসুল সাঃ বলেন : সত্যবাদী, ন্যায়পন্থী ও বিশ্বস্ত ব্যবসায়ী নবী ও সিদ্দিকের মর্যাদায় অভিষিক্ত হবেন।’’মহানবী (সা.) আরো ঘোষণা করেছেন- ব্যবসায়ী মাত্রেই কেয়ামতের দিন অপরাধী হিসেবে পুনরুত্থিত হবে, তবে তারা নয়, যাদের কার্যে খোদাভীতি ছিল, ন্যায় ও সত্যবাদিতার গুণ ছিল।মূল্যবৃদ্ধির আশায় প্রয়োজনীয় দ্রব্য আটকিয়ে রাখাকে তিনি নিষিদ্ধ করেছেন। ইহার বিরুদ্ধে রাসূল (সা.) ঘোষণা করেছিলেন- যে ব্যক্তি মূল্যবৃদ্ধি কল্পে খাদ্যবস্ত্ত জমা করে রাখে সে পাপী বা অন্যায়কারী (মুসলিম আবু দাউদ)।পণ্যের ত্রুটি প্রকাশ করার গুরুত্ব দিয়ে রাসুল সাঃ বলেছেনঃ‘‘যে ব্যক্তি দোষযুক্ত পণ্য বিক্রির সময় দোষ প্রকাশ করে না ফেরেস্তারা তার উপর অভিশাপ দিতে থাকে।ব্যবসা-বাণিজ্যে প্রতারণা না করার জন্য সতর্ক করে দিয়ে রাসুল সাঃ বলেছেনঃযে ব্যক্তি (বেচা-কেনায়) ধোঁকা দিবে সে আমাদের দলভুক্ত নয়!
৩(৩) সুষম সমাজ প্রতিষ্ঠাঃ
দুর্নীতি প্রতিরোধ:
সমাজ থেকে দুর্নীতি উচ্ছেদে জবাবদিহিতা ও নিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি এ জঘণ্য অপরাধ থেকে মানুষকে মুক্ত রাখার ব্যাপারে রাসুল সাঃ এর নীতি ছিল অতুলণীয়। তিনি পরকালিন শাস্তির ভয় দেখিয়ে মানুষদের দুর্নীতি থেকে মুক্ত রাখার চেষ্টা করেছেন।ঘুষের লেনদেন করে কাজ করিয়ে নেয়া বা দেয়ার ব্যাপারে কঠোর সতর্কবাণী্তে রাসূল (সা.) বলেছেন- ‘‘ঘুষ দাতা এবং ঘুষ গ্রহীতা উভয়ই জাহান্নামের অধিবাসী”।
মদ-জুয়া প্রতিরোধ:
মদ ও জুয়া সমাজের স্বাভাবিক ভারসাম্য নষ্ট করে দেয়। এটা পরীক্ষিত যে, মদ-জুয়া স্ত্রী-সন্তান, আত্মীয়স্বজন, পাড়া-পড়শীর মধ্যে সম্পর্কের ভীত নষ্ট করে দেয়।। মদ ও জুয়া সম্পর্কিত আল্লাহ পাকের দেয়া বিধানকে কঠোরভাবে প্রয়োগের মাধ্যমে রাসুল সাঃ তৎকালীন সময়ে ভারসাম্যপূর্ণ সমাজ বিনির্মাণে সহায়ক হন।
সন্ত্রাস দমন ও প্রতিরোধঃ
চারিত্রিক সংশোধনের মাধ্যমে সন্ত্রাস নামক সামাজিক ব্যধি থেকে মুক্ত করার জন্য রাসুল সাঃ এর নীতি ছিল অসাধারণ।সন্তানদের চরিত্র গঠনে মাতাপিতাকেই বেশি দায়িত্ব দিয়েছেন।মহানবী (সা.) বলেছেন, ‘তোমাদের সন্তানদের সাথে সম্মানবোধের মাধ্যমে আচরণ কর এবং তাদেরকে আদব ও মূল্যবোধ শেখাও।’ মানবিক শিক্ষার মাধ্যমে মানুষ যেন কোন ক্ষতিকর কাজে জড়িয়ে না যায় সেদিকে দৃষ্টি রেখে রাসুল সাঃ বলেছেনঃ নিজের ক্ষতি করতে পারবে না, অপরের ক্ষতিও না। তিনি আরো বলেন, অপরের জন্য তাই পছন্দ করবে, যা নিজের জন্য কর।
যুব সমাজকে ঐক্যবদ্ধভাবে সুপথে রাখা ও কল্যাণমূলক কাজে নিয়োজিত রাখার অংশ হিসেবে তাঁর নিজ হাতে গড়ে তোলা হিলফুল ফুযুল নামক সংগঠনটি বিশ্ববাসীর জন্য অনন্য শিক্ষা হিসেবে গণ্য হতে পারে।
অপরাধমুক্ত জীবন গঠনে মন-মানসিকতার উন্নয়নঃ
মানুষের মাঝে অপরাধ প্রবণতা থাকেই। সেই প্রবণতা থেকে মুক্ত করার জন্য নির্ধারিত শাস্তির পাশাপাশি তার মন-মানসিকতার উন্নয়ন ঘটাতে পারলেই সবচেয়ে বেশি ইতিবাচক ও দীর্ঘমেয়াদে ফল পাওয়া যায়। রাসুল সাঃ তেমনই করেছেন। একদা তিনি মসজিদে নববীতে বসে আছেন। এমন সময় এক যুবক এসে বলল, ‘ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমি ইসলামের সবকিছুই মানতে প্রস্তুত আছি, তবে ব্যাভিচার ছাড়তে পারব না।’ উপস্থিত সাহাবীগণ স্তম্ভিত হয়ে গেলেন। কিন্তু মহানবী (সা.) তাকে মানসিকভাবে প্রস্তুত করার জন্য খুবই দরদভরা অথচ দৃঢ় কণ্ঠে বললেন, ‘শোন, তুমি যার সাথে যিনা-ব্যাভিচার করবে সে নিশ্চয়ই কারো বোন, কারো না কারোর মা, খালা, ফুফু হবে তাই না?’ সে উত্তরে বললো, হ্যাঁ। তিনি বললেন, ’তাহলে এবার বল, তুমি কি রাজি যে তোমার বোনের সাথে কেউ এই কাজটি করুক?’ সে বলল, অবশ্যই আমি তা সহ্য করব না। এভাবে রাসূলুল্লাহ্ (সা.) তাকে তার কয়েক ধরনের মহিলা আত্মীয়ের কথা বললেন। সে প্রতিবারই বললো— তা আমি অবশ্যই সহ্য করব না। এক পর্যায়ে সে বলে উঠল, ‘ইয়া রাসূলাল্লাহ! এখন আমার মন থেকে এই জঘন্য অপরাধের প্রবণতা দূর হয়ে গেছে।’
নারীর অধিকারআদায় ও মর্যাদা দান:
মহানবী (সা.)একমাত্র নেতা যিনি সমগ্র বিশ্বের নারীদের উচ্চ আসনে সমাসীন করেছেন। তিনি ঘোষণা করেছেন- ‘‘মায়ের পদতলে সন্তানের বেহেশত। রাসূলুল্লাহ (সা.) আরো বলেন: ‘‘তোমাদের মাঝে তারাই শ্রেষ্ঠ ব্যক্তি যারা আপন স্ত্রীদের কাছে শ্রেষ্ঠ”।
৪) বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠায় হুদায়বিয়ার সন্ধি, মক্কা বিজয় ও বিদায় হজ্বের ভাষণ
বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠায় মহানবী সাঃ এর অনবদ্য ভূমিকার অনন্য স্মারক হচ্ছে হুদায়বিয়ার সন্ধি। বিশ্বনেতার আদর্শ ও অনুপম গুণাবলীর জ্বলন্ত স্বাক্ষর এই সন্ধি। সেসময় যথেষ্ট শক্তি-সামর্থ্য ও প্রস্তুতি থাকা স্বত্তেও দীর্ঘমেয়াদী শান্তি ও কল্যাণের স্বার্থে বিরোধিদের সকল দাবী মেনে নিয়ে সন্ধিতে স্বাক্ষর করে বিশ্ববাসীকে এক চমৎকার শিক্ষা দিয়েছিলেন। ধৈর্য, বিচক্ষণতা, সাহস ও নমনীয়তা যে একজন আদর্শ নেতার মৌলিক গুণ তা তিনি পৃথিবীবাসীকে দেখিয়ে দিয়েছেন।
শান্তি প্রতিষ্ঠায় মহানবী সাঃ এর আরেক ঐতিহাসিক ভূমিকার অন্যতম ঘটনা ছিল মক্কা বিজয়ের সময় সকল শত্রুপক্ষকে নিঃশর্ত ক্ষমা ঘোষণা করে দেয়া। অথচ সেই মক্কাবাসী তাঁকে জন্মভূমি ত্যাগে বাধ্য করা সহ অমার্জনীয় শত কষ্ট দিয়েছিল। সব ভুলে গিয়ে তিনি সকল বিজিত মক্কার কাফেরদেরকে এক কাতারে এসে কাজ করার ঘোষণা দিয়ে শান্তির অনন্য নজীর স্থাপন করেছিলেন যা পৃথিবীর কোন যুদ্ধজেতা দেশের নেতার পক্ষে অসম্ভব। জিঘাংসা ও প্রতিহিংসা থেকে কিভাবে নিজেকে সরিয়ে ফেলতে হয় তার অনন্য দৃষ্টান্ত তিনি স্থাপন করেছিলেন।
বিদায় হজ্বের ভাষণে মহানবী সাঃ শান্তির চূড়ান্ত বার্তা পৌঁছে দেয়ার নির্দেশ দেন উপস্থিত সকলকে।তাঁর ভাষণের প্রতিটি শব্দই ছিল শান্তি-সম্প্রীতির পক্ষে। যেমন তিনি বলেছিলেনঃ
তোমরা অন্যের ওপর অত্যাচার করবে না, নিজেরাও অত্যাচারিত হবে না।
সব মুমিন পরস্পর ভাই ভাই। কারো জন্য অন্যের সম্পদ বৈধ নয়। তবে যদি কেউ স্বেচ্ছায় কাউকে কিছু দেয়, তাহলে সেটা স্বতন্ত্র ব্যাপার।
তোমরা সবাই আদম থেকে আর আদম মাটি থেকে সৃষ্টি। তোমাদের মাঝে যারা সর্বাধিক মুত্তাকি, খোদাভীরু তারাই আল্লাহর কাছে সর্বাধিক মর্যাদাবান। তাকওয়া ছাড়া কোনো অনারবের ওপর কোনো আরবের শ্রেষ্ঠত্ব নেই।
সাবধান! তোমাদের গোলাম ও অধীনস্তদের বিষয়ে আল্লাহ তা’আলাকে ভয় কর। তোমরা যা খাবে তাদেরকে তা খেতে দেবে। তোমরা যা পরবে তাদেরকেও সেভাবে পরতে দেবে।
৫) উপসংহারঃ
মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা ও মানবতার সুন্দরতম আদর্শ প্রতিষ্ঠায় মহানবী (সাঃ) সর্বোত্তম দৃষ্টান্ত স্থাপন করে গেছেন। এ সম্পর্কে জেনেভা বিশ্ববিদ্যালয়ের খ্যাতনামা অধ্যাপক এডওয়ার্ড মুনন্ট বলেন, “ চরিত্র গঠন ও সমাজ সংস্কারের ক্ষেত্রে মুহাম্মদ (সাঃ) যে সাফল্য অর্জন করেছেন সেদিক থেকে তাঁকে বিশ্বমানবতার মহান দরদী নেতা বলে প্রতীয়মান হয়।”
প্রিয়নবীর (সাঃ) মহানুভবতার কথা বলতে যেয়ে মক্কা বিজয়কালীন ইতিহাস তুলে ধরে ঐতিহাসিক গীবন বলেন, “হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) তাঁর পদতলে দুশমনদের পেয়েও একে একে সব দুশমনকে মাফ করে দিয়ে যে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন অনুরূপ দৃষ্টান্ত পৃথিবীর সুদীর্ঘকালের ইতিহাসে দ্বিতীয়টি আর নেই। সেই ঔদার্য ও ক্ষমাশীলতার দ্বিতীয় কোন দৃষ্টান্ত আর দেখা যায় না।”
জর্জ বার্নাড শ বলেছেনঃ“আমি ভবিষ্যৎ বাণী করছি যে, আগামীতে মুহাম্মদ (সাঃ) এর বিশ্বাস (ধর্ম) ইউরোপের কাছে গ্রহণীয় হবে যেমনটা তা ইতিমধ্যেই ইউরোপের কাছে গ্রহণীয় হতে শুরু করেছে।”
ইংরেজ কবি জন কীটস্ বলেন, ‘‘পৃথিবীর যা কিছু মঙ্গলময়, যা কিছু মহৎ ও সুন্দর সবই নবী মুহাম্মদ (সাঃ)। তাঁর তুলনা তিনি নিজেই।’’
এভাবে আমরা দেখতে পাই জন ডেভেন পোর্ট, ডা. স্যামুয়েল জনসন, প্রফেসর স্টিফেন্স, জন উইলিয়াম ড্রেপার, ওয়াশিংটন আরভিং, এডওয়ার্ড মুনন্ট, রেভারেন্ড ডব্লিউ স্টিফেন, রেমন্ড এলিয়ন নিকলসন, পি.কে. হিট্টি, জেমস্ এ মিসেনার, আর্থার গিলমান, মরিস গড ফ্রে, টি ডব্লিউ আরনল্ড, ষ্টানলি লেনপুল, বসওয়ার্থ স্মিথ, মেজর আর্থার লিউনার্ড, নেপোলিয়ন বোনাপার্ট, জর্জ বার্নার্ড শ, বার্ট্রেন্ড রাসেল, , টমাস কার্লাইল, ডঃ গুস্তাভ উইল, এ্যানি বেসান্ত, স্যার গোকুল চন্দ্র, জোসেফ হেল, ডঃ গেসটাউলি, আলফ্রেড মার্টিন, রর্বাট বিফ্রো, এডমন্ড বার্ক, লা মার্টিন, ক্যাডফ্রে হেগেল, মানবেন্দ্রনাথ রায়, স্বামী বিবেকানন্দ, বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, মহাত্মা গান্ধী, পন্ডিত হরপ্রসাদ শাস্ত্রী, ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী পন্ডিত জওহরলাল নেহেরুসহ পৃথিবীর অসংখ্য খ্যাতনামা ব্যক্তিগণ মহানবী (সাঃ) সম্পর্কে প্রশংসার বাণী উচ্চারণ করেছেন। এসব বিশ্ববরেণ্য মনীষীগণ মহানবী (সাঃ) এর আদর্শ এবং জীবনের নানাবিধ কর্মকান্ডের ব্যাপক বিচার-বিশ্লেষণ করে বিস্ময়ে হতবাক হয়ে যান তাঁর বলিষ্ঠ নেতৃত্ব, সুন্দরতম চরিত্র, অনুপম আদর্শ, নির্ভীকতা ও সহনশীলতার মাধুর্য দেখে। তাঁর সততা, কতর্ব্যপরায়ণতা, ন্যায়নীতি, ক্ষমা, দয়া এবং নিষ্ঠা দেখে তাঁরা অভিভূত হয়ে পড়েন।। সর্বোপরি তাঁরা এটাও অকপটে স্বীকার করেছেন যে, মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) এর আদর্শই মানবতার মুক্তির একমাত্র পথ যা বিশ্বশান্তিকে নিশ্চিত করতে পারে।
তথ্যসূত্রঃ
১)bn.wikipedia.org
২)সীরাতগ্রন্থঃ আর-রাহীকুল মাখতুম/ সীরাতে সাইয়্যেদুল মুরসালিন/ বিশ্বনবী
৩) সীরাত সংকলন- ইসলামিক ফাউন্ডেশন, বাংলাদেশ।
৪) মাসিক মদীনা
৫) মাসিক পৃথিবী
৬) সাপ্তাহিক সোনারবাংলা
ড. মুহাম্মদ হাসমত আলী
সহযোগী অধ্যাপক
ফাইন্যান্স বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।
mdhasmat@gmail,com
নোট: প্রবন্ধটি ১১ জানুয়ারী-২০১৮ কক্সবাজার সাংস্কৃতিকেন্দ্রে অনুষ্ঠিত ‘বিশ্ব শান্তি প্রতিষ্ঠায় মুহাম্মদ স. এর অবদান’ শীর্ষক সেমিনারে উপস্থাপিত হয়।