১. সমগ্র বিশ্বজাহানের মালিক ও আইনদাতা:
যেহেতু আল্লাহ্ ব্যতীত নিখিল সৃষ্টির কোন ইলাহ নাই এবং নিখিল বিশ্বের সর্বত্র আল্লাহ্র প্রবর্তিত প্রাকৃতিক আইনসমূহ একমাত্র তাঁহারই বিচক্ষণতা, শ্রেষ্ঠত্ব ও সার্বভৌমত্বের সাক্ষ্য দান করিতেছে।
মহান আল্লাহর ঘোষনা:إِنَّ رَبَّكُمُ اللَّهُ الَّذِى خَلَقَ السَّمٰوٰتِ وَالْأَرْضَ فِى سِتَّةِ أَيَّامٍ ثُمَّ اسْتَوٰى عَلَى الْعَرْشِ يُغْشِى الَّيْلَ النَّهَارَ يَطْلُبُهُۥ حَثِيثًا وَالشَّمْسَ وَالْقَمَرَ وَالنُّجُومَ مُسَخَّرٰتٍۭ بِأَمْرِهِۦٓ ۗ أَلَا لَهُ الْخَلْقُ وَالْأَمْرُ ۗ تَبَارَكَ اللَّهُ رَبُّ الْعٰلَمِينَ
প্রকৃতপক্ষে আল্লাহই তোমাদের রব, যিনি আকাশ ও পৃথিবী ছয় দিনে সৃষ্টি করেছেন। তারপর তিনি নিজের কর্তৃত্বের আসনে সমাসীন হন। তিনি রাত দিয়ে দিনকে ঢেকে দেন তারপর রাতের পেছনে দিন দৌড়িয়ে চলে আসে। তিনি সূর্য, চন্দ্র ও তারকা রাজী সৃষ্টি করেন। সবাই তাঁর নির্দেশের আনুগত। জেনে রাখো, সৃষ্টি তারই এবং নির্দেশও তাঁরই। আল্লাহ বড়ই বরকতের অধিকারী। তিনি সমগ্র বিশ্বজাহানের মালিক ও প্রতিপালক। (সূরা আল-আরাফ ৫৪)
لَهُۥ مَا فِى السَّمٰوٰتِ وَمَا فِى الْأَرْضِ وَمَا بَيْنَهُمَا وَمَا تَحْتَ الثَّرٰى
যা কিছু পৃথিবীতে ও আকাশে আছে, যা কিছু পৃথিবী ও আকাশের মাঝখানে আছে এবং যা কিছু ভূগর্ভে আছে সবকিছুর মালিক তিনিই। ( সূরা ত্ব-হা ৬)
سَبَّحَ لِلَّهِ مَا فِى السَّمٰوٰتِ وَمَا فِى الْأَرْضِ ۖ وَهُوَ الْعَزِيزُ الْحَكِيمُ
আসমান ও যমীনে যা কিছু আছে তা সবই আল্লাহর তাসবীহ করেছে। তিনি মহা- পরাক্রমশালী ও মহাজ্ঞানী।(সূরা সফ ১)
তিনি এ দুনিয়াকে অস্তিত্বশীল করার পর এর সাথে সম্পর্কচ্ছেদ করে কোথাও বসে যাননি। বরং কার্যত তিনিই সারা বিশ্ব-জাহানের ছোট বড় প্রত্যেকটি বস্তুর ওপর কর্তৃত্ব করছেন। পরিচালনা ও শাসন কর্তৃত্বের যাবতীয় ক্ষমতা কার্যত তাঁরই হাতে নিবদ্ধ। প্রতিটি বস্তু তাঁর নির্দেশের অনুগত। ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বালুকণাও তাঁর নির্দেশ মেনে চলে। প্রতিটি বস্তু ও প্রাণীর ভাগ্যই চিরন্তনভাবে তাঁর নির্দেশের সাথে যুক্ত। যে মৌলিক বিভ্রান্তিটির কারণে মানুষ কখনো শিরকের গোমরাহীতে লিপ্ত হয়েছে, আবার কখনো নিজেকে স্বাধীন ক্ষমতা সম্পন্ন ঘোষণা করার মতো ভ্রান্ত পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে, কুরআন এভাবে তার মূলোৎপাটন করতে চায়। বিশ্ব-জাহানের পরিচালনা ও ব্যবস্থাপনা থেকে আল্লাহকে কার্যত সম্পর্কহীন মনে করার অনিবার্য ফল দাঁড়ায় দু’টি। মানুষ নিজের ভাগ্যকে অন্যের হাতে বন্দি মনে করবে এবং তার সামনে মাথা নত করে দেবে অথবা নিজেকেই নিজের ভাগ্যের নিয়ন্তা মনে করবে এবং নিজেকে সর্বময় কর্তৃত্বশালী স্বাধীন সত্তা মনে করে কাজ করে যেতে থাকবে।
আর বিশ্ব-জাহানের এ ব্যবস্থাপনা একটি পূর্ণাঙ্গ কেন্দ্রীয় ব্যবস্থা বিশেষ, যেখানে ঐ একক সত্তা, সমস্ত ক্ষমতা ও কর্তৃত্বের অধিকারী। কাজেই এ ব্যবস্থার মধ্যে যে ব্যক্তি বা দল নিজের বা অন্য কারুর আংশিক বা পূর্ণ কর্তৃত্বের দাবীদার হয়, সে নিজেকে নিছক প্রতারণার জালে আবদ্ধ করে রেখেছে। তাছাড়া এ ব্যবস্থার মধ্যে অবস্থান করে মানুষ পক্ষে ঐ একক সত্তাকে একই সাথে ধর্মীয় অর্থেও একমাত্র মাবুদ এবং রাজনৈতিক ও সামাজিক-সাংস্কৃতিক অর্থেও একমাত্র শাসক হিসেবে মেনে নেয়া ছাড়া দ্বিতীয় কোন সঠিক দৃষ্টিভংগী ও কর্মনীতি হতে পারে না।
২. মানুষ আল্লাহর প্রতিনিধি :
তাই আল্লাহ্ মানুষকে তাহার প্রতিনিধিত্বের বা খিলাফতের দায়িত্ব সহকারে পৃথিবীতে প্রেরণ করিয়াছেন এবং মানব রচিত মতবাদের অনুসরণ ও প্রবর্তন না করিয়া একমাত্র আল্লাহ্ প্রদত্ত জীবন বিধানের ও প্রবর্তন করাকেই মানুষের দায়িত্ব ও কর্তব্য নির্ধারণ করিয়া দিয়াছেন।
মহান আল্লাহর ঘোষনা:وَإِذْ قَالَ رَبُّكَ لِلْمَلٰٓئِكَةِ إِنِّى جَاعِلٌ فِى الْأَرْضِ خَلِيفَةً ۖ قَا
আবার সেই সময়ের কথা একটু স্মরণ কর যখন তোমাদের রব ফেরেশতাদের বলেছিলেন, “আমি পৃথিবীতে একজন খলীফা- প্রতিনিধি নিযুক্ত করতে চাই।” - (সূরা-বাক্বারাহ ৩০)
وَهُوَ الَّذِى جَعَلَكُمْ خَلٰٓئِفَ الْأَرْضِ وَرَفَعَ بَعْضَكُمْ فَوْقَ بَعْضٍ دَرَجٰتٍ لِّيَبْلُوَكُمْ فِى مَآ ءَاتٰىكُمْ ۗ إِنَّ رَبَّكَ سَرِيعُ الْعِقَابِ وَإِنَّهُۥ لَغَفُورٌ رَّحِيمٌۢ
তিনিই তোমাদের করেছেন দুনিয়ার প্রতিনিধি এবং যা কিছু তোমাদের দিয়েছেন তাতে তোমাদের পরীক্ষার উদ্দেশ্যে তোমাদের কাউকে অন্যের ওপর অধিক মর্যাদা দান করেছেন। নিঃসন্দেহে তোমার রব শাস্তি দেবার ব্যাপারে অতি তৎপর এবং তিনি অত্যন্ত ক্ষমাশীল ও করুণাময়। (সূরা আনয়াম ১৬৫)
وَعَدَ اللَّهُ الَّذِينَ ءَامَنُوا مِنكُمْ وَعَمِلُوا الصّٰلِحٰتِ لَيَسْتَخْلِفَنَّهُمْ فِى الْأَرْضِ كَمَا اسْتَخْلَفَ الَّذِينَ مِن قَبْلِهِمْ
আল্লাহ প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, তোমাদের মধ্য থেকে যারা ঈমান আনবে ও সৎকাজ করবে তাদেরকে তিনি পৃথিবীতে ঠিক তেমনিভাবে খিলাফত দান করবেন যেমন তাদের পূর্বে অতিক্রান্ত লোকদেরকে দান করেছিলেন,- (সূরা আন্-নূর ৫৫)
يٰدَاوُۥدُ إِنَّا جَعَلْنٰكَ خَلِيفَةً فِى الْأَرْضِ فَاحْكُم بَيْنَ النَّاسِ بِالْحَقِّ وَلَا تَتَّبِعِ الْهَوٰى فَيُضِلَّكَ عَن سَبِيلِ اللَّهِ ۚ
(আমি তাঁকে বললাম) “হে দাউদ! আমি তোমাকে পৃথিবীতে প্রতিনিধি করেছি, কাজেই তুমি জনগণের মধ্যে সত্য সহকারে শাসন কর্তৃত্ব পরিচালনা করো - -( সূরা সোয়াদ ২৬)
অথাৎ : সমস্ত মানুষ পৃথিবীতে আল্লাহর প্রতিনিধি। এ অর্থে আল্লাহ তাঁর সৃষ্টিলোকের বহু জিনিস মানুষের কাছে আমানত রেখেছেন এবং তা ব্যবহার করার স্বাধীন ক্ষমতা তাকে দান করেছেন।
দুই, আল্লাহ নিজেই এ প্রতিনিধিদের মধ্যে মর্যাদার পার্থক্য সৃষ্টি করেছেন। কারোর আমানতের গণ্ডী ব্যাপক আবার কারোর সীমাবদ্ধ। কাউকে বেশী জিনিস ব্যবহারের ক্ষমতা দিয়েছেন, কাউকে দিয়েছেন কম। কাউকে বেশী কর্মক্ষমতা দিয়েছেন, কাউকে কম। আবার কোন কোন মানুষকে কোন কোন মানুষের কাছে আমানত রেখেছেন।
তিন, এ সবকিছুই আসলে পরীক্ষার বিষয়বস্তু। সারা জীবনটাই একটি পরীক্ষা ক্ষেত্র। আল্লাহ যাকে যা কিছুই দিয়েছেন তার মধ্যেই তার পরীক্ষা। সে কিভাবে আল্লাহর আমানত ব্যবহার করলো? আমানতের দায়িত্ব কতটুকু অনুধাবন করলো এবং তার হক আদায় করলো? কতটুকু নিজের যোগ্যতা বা অযোগ্যতার স্বাক্ষর রাখলো? এ পরীক্ষার ফলাফলের ওপর নির্ভর করে জীবনের অন্যান্য পর্যায়ে মানুষের মর্যাদা নির্ধারণ।
৩. নবী-রাসূলগণকে পৃথিবীতে প্রেরণ:
আল্লাহ্ তাঁহার প্রদত্ত জীবন বিধানকে বাস্তব রূপদানের নির্ভুল পদ্ধতি শিক্ষাদান ও উহাকে বিজয়ী আদর্শ রূপে প্রতিষ্ঠিত করিবার উদ্দেশ্যে যুগে যুগে নবী- রাসূলগণকে পৃথিবীতে প্রেরণ করিয়াছেন।
পবিত্র কোরআনে আল্লাহ এরশাদ করেন:لَقَدْ مَنَّ اللَّهُ عَلَى الْمُؤْمِنِينَ إِذْ بَعَثَ فِيهِمْ رَسُولًا مِّنْ أَنفُسِهِمْ يَتْلُوا عَلَيْهِمْ ءَايٰتِهِۦ وَيُزَكِّيهِمْ وَيُعَلِّمُهُمُ الْكِتٰبَ وَالْحِكْمَةَ وَإِن كَانُوا مِن قَبْلُ لَفِى ضَلٰلٍ مُّبِينٍ
আসলে ঈমানদারদের মধ্যে তাদেরই মধ্য থেকে একজন নবী পাঠিয়ে আল্লাহ মুমিনদের প্রতি অনুগ্রহ করেছেন। সে তাঁর আয়াত তাদেরকে শোনায়, তাদের জীবনকে পরিশুদ্ধ ও সুবিন্যস্ত করে এবং তাদেরকে কিতাব ও জ্ঞান শিক্ষা দেয়। অথচ এর আগে এই লোকেরাই সুস্পষ্ট গোমরাহীতে লিপ্ত ছিল। (সূরা-ইমরান ১৬৪)
قُلْ يٰٓأَيُّهَا النَّاسُ إِنِّى رَسُولُ اللَّهِ إِلَيْكُمْ جَمِيعًا الَّذِى لَهُۥ مُلْكُ السَّمٰوٰتِ وَالْأَرْضِ ۖ لَآ إِلٰهَ إِلَّا هُوَ يُحْىِۦ وَيُمِيتُ ۖ فَـَٔامِنُوا بِاللَّهِ وَرَسُولِهِ النَّبِىِّ الْأُمِّىِّ الَّذِى يُؤْمِنُ بِاللَّهِ وَكَلِمٰتِهِۦ وَاتَّبِعُوهُ لَعَلَّكُمْ تَهْتَدُونَ
হে মুহাম্মাদ! বলে দাও, “হে মানব সম্প্রদায়, আমি তোমাদের জন্য সেই আল্লাহর রসূল হিসেবে এসেছি, যিনি পৃথিবী ও আকাশ মণ্ডলীর সার্বভৌম কর্তৃত্বের অধিকারী। তিনি ছাড়া আর কোন ইলাহ নেই। তিনিই জীবন দান করেন এবং তিনিই মৃত্যু ঘটান। কাজেই ঈমান আনো আল্লাহর প্রতি এবং তার প্রেরিত সেই নিরক্ষর নবীর প্রতি, যে আল্লাহ ও তাঁর বাণীর প্রতি ঈমান আনে এবং তার আনুগত্য করে। আশা করা যায়, এভাবে তোমরা সঠিক পথ পেয়ে যাবে।
(সূরা আরাফ ১৫৮)إِنَّآ أَوْحَيْنَآ إِلَيْكَ كَمَآ أَوْحَيْنَآ إِلٰى نُوحٍ وَالنَّبِيِّۦنَ مِنۢ بَعْدِهِۦ ۚ وَأَوْحَيْنَآ إِلٰىٓ إِبْرٰهِيمَ وَإِسْمٰعِيلَ وَإِسْحٰقَ وَيَعْقُوبَ وَالْأَسْبَاطِ وَعِيسٰى وَأَيُّوبَ وَيُونُسَ وَهٰرُونَ وَسُلَيْمٰنَ ۚ وَءَاتَيْنَا دَاوُۥدَ زَبُورًا
হে মুহাম্মাদ! আমি তোমার কাছে ঠিক তেমনিভাবে অহী পাঠিয়েছি, যেমন নূহ ও তার পরবর্তী নবীদের কাছে পাঠিয়ে ছিলাম। আমি ইবরাহীম, ইসমাঈল, ইসহাক, ইয়াকুব ও ইয়াকুব সন্তানদের কাছে এবং ঈসা, আইয়ুব, ইউনুস, হারুন ও সুলাইমানের কাছে অহী পাঠিয়েছি। আমি দাউদকে যবূর দিয়েছি।
(সূরা নিসা ১৬৩)অর্থাৎ এই সমস্ত পয়গম্বর পাঠাবার একটিই মাত্র উদ্দেশ্য ছিল। সে উদ্দেশ্যটি ছিল এই যে, আল্লাহ মানব জাতির কাছে নিজের দায়িত্ব পূর্ণ করার প্রমাণ পেশ করতে চাইছিলেন। এর ফলে শেষ বিচারের দিনে কোন পথভ্রষ্ট অপরাধী তাঁর কাছে এই ওজর পেশ করতে পারবে না যে, সে জানতো না এবং আল্লাহ যথার্থ অবস্থা সম্পর্কে তাকে অবহিত করার জন্য কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করেননি। এই উদ্দেশ্যে আল্লাহ দুনিয়ার বিভিন্ন স্থানে পয়গাম্বর পাঠিয়েছেন এবং কিতাব নাযিল করেছেন। এ পয়গাম্বরগণ অসংখ্য লোকের নিকট সত্যের জ্ঞান পৌঁছিয়ে দিয়েছেন। তাঁরা দুনিয়া থেকে বিদায় নিয়েছেন; কিন্তু এখানে রেখে গেছেন তাঁদের বিভিন্ন কিতাব। মানুষকে পথ দেখাবার জন্য অবশ্যি প্রতি যুগে এ কিতাবগুলোর মধ্য থেকে কোন না কোন কিতাব দুনিয়ায় মওজুদ থেকেছে। এরপর যদি কোন ব্যক্তি গোমরাহ হয়, তাহলে সেজন্য আল্লাহ ও তাঁর পয়গাম্বরকে অভিযুক্ত করা যেতে পারে না। বরং এজন্য ঐ ব্যক্তি নিজেই অভিযুক্ত হবে। কারণ তার কাছে পয়গাম পৌঁছে গিয়েছিল কিন্তু সে তা গ্রহণ করেনি। অথবা সেইসব লোক অভিযুক্ত হবে যারা সত্য-সঠিক পথ জানতোঃ কিন্তু আল্লাহর বান্দাদের গোমরাহীতে লিপ্ত দেখেও তাদেরকে সত্য পথের সন্ধান দেয়নি।
চলবে - - -
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন