জামায়াতে ইসলামীর আমীর মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী সুপ্রিমকোর্টে বিভিউ আবেদন দায়ের করেছেন। ফাঁসির দন্ড পুন:বিবেচনার জন্য গতকাল ২৯ মার্চ আবেদনটি দায়ের করা হয়। রিভিউ-এর রায় কি হয় সেটা অতীতের মামলা গুলো কিছুটা আভাস দেয়। রিভিউ-এর রায় অতীতের মত হলে কত গুলো প্রশ্ন অমিমাংশিত থেকে যাবে। কোন প্রশ্নের চুড়ান্ত মিমাংশা ছাড়া কি সন্দেহের উর্ধ্বে উঠা যায়! আর সন্দেহের উর্ধ্বে না উঠে কাউকে কি চুড়ান্ত দন্ড ফাঁসি দেয়া যায়! সন্দেহের উর্ধ্বে উঠতে হলে মাওলনা মতিউর রহমান নিজামীর মামলা চলাকালীন সাক্ষী সামসুল হক নান্নুকে নিয়ে উঠা বিতর্কের চুড়ান্ত অবসান হওয়া দরকার। নতুবা প্রশ্নের মিমাংশা ছাড়াই একটা মানুষকে খুনের হুকুম দেয়া ছাড়া ন্যায় বিচার বলা যাবে না।
স্কাইপ স্ক্যান্ডালে উঠে এসেছিল কিভাবে সরকার, প্রসিকিউশন এবং ট্রাইব্যুনালের মধ্যে গোপন ষড়যন্ত্র এবং যোগসাজ রয়েছে। এতে পরিস্কার হয়ে যায়, কতিপয় নেতাকে ফাঁসির দন্ড দিতেই সরকার, প্রসিকিউশন এবং ট্রাইব্যুনালের যৌথ ষড়যন্ত্র। স্কাইপ স্ক্যান্ডালে ট্রাইব্যুনালের প্রথম চেয়ারম্যান নিজামুল হক নাসিমের জবানীতে উঠে এসেছিল ষড়যন্ত্রের রোল মডেল। তিনি নিজেই বলেছিলেন, প্রসিকিউটর জিয়াদ আল মালুম তাঁকে বলেছেন-‘আমি খাড়াইয়া যামু, আপনি বসায়া দেবেন, লোকে বোঝবে আমাদের মাঝে কোন সম্পর্ক নাই।’ নাসিমের জবানীতে আরো উঠে এসেছিল আইনমন্ত্রী কিভাবে ডিকটেট করছে বিচার কাজ পরিচালনায় এবং তৎকালীন আইন প্রতিমন্ত্রী তাঁকে রায়ের জন্য কিভাবে তাগিদ দিয়েছেন। বিচারপতি এ কে এম জহিরুল হককে আইনমন্ত্রী ডেকে নিয়ে কিভাবে পদত্যাগ পত্র রেখে বিদায় দিলেন সেটাও উঠে এসেছিল নিজামুল হক নাসিমের জবানীতে।
মাওলনা নিজামীর মামলা ট্রাইব্যুনালে চলাকালীন আরেকটি স্ক্যান্ডাল প্রকাশিত হয় সাক্ষী অ্যাডভোকেট সামসুল হক নান্নুর জবান দিয়ে। সাক্ষী সামসুল হক নান্নু এক ভিডিও সাক্ষৎকারে জানিয়েছেন তিনি মাওলানা নিজামীকে ১৯৮৬ সালে জাতীয় ইলেকশনের আগে চিনতেন না। ১৯৮৬ সালে পাবনার সাথিয়া থেকে জামায়াতে ইসলামীর প্রার্থী হওয়ার পর তিনি মাওলানা মতিউর রহমান নিজামীকে ব্যক্তিগতভাবে চিনতে পারেন। এর আগে কোনদিন সরাসরি দেখেননি। কিভাবে তাঁকে এ মামলায় নিজামীর বিরুদ্ধে অন্যতম প্রধান সাক্ষী বানানো হয়েছে, এই বর্ণনাও দিয়েছেন তিনি সেই ভিডিও সাক্ষাৎকারে। ভিডিও সাক্ষাৎকারে উঠে এসেছে সামসুল হক নান্নুকে কিভাবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সাক্ষী হতে নির্দেশ দিয়েছেন। সাবেক স্বরাষ্ট্রপ্রতিমন্ত্রী কিভাবে তাঁকে সাক্ষী হওয়ার জন্য চাপ সৃস্টি করেছিলেন এবং সেনা সদর দফতরে নিয়ে তাঁকে কিভাবে আটকে রাখা হয়, সেই বর্ণনাও অকপটে দিয়েছেন তিনি। সামসুল হক নান্নুর ভিতিও সাক্ষাৎকারের বক্তব্য থেকেই স্পষ্ট তাঁকে সাক্ষ্য হিসাবে উপস্থাপনের পেছনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, সেনা বাহিনী এবং সাবেক স্বরাষ্ট্রপ্রতিমন্ত্রী শামসুল হক টুকু সরাসরি জড়িত। এই সাক্ষ্য তাঁকে দিতে বলা হয়েছে সরকারের সাজানো চক অনুযায়ী। সত্য সাক্ষ্য নয়। এমন নয় যে, তিনি ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী। সাক্ষী দিতে রাজি হচ্ছিলেন না। তাঁকে চাপ সৃস্টি করে রাজি করানো হয়েছে। তিনি ঘটনা সম্পর্কে কিছুই জানতেন না। সরকারি ষড়যন্ত্রে তৈরি করা সাজানো ঘটনা তাঁকে দিয়ে বলানো হয়েছে মাত্র। এই সাজানো ঘটনা বলতে তিনি কিভাবে রাজি হয়েছেন সেই বর্ণনাই দিয়েছেন ভিডিও সাক্ষাৎকারে। ইউটিউভে প্রচারিত হওয়া ভিডিও সাক্ষাৎকারটি এখানে লিঙ্ক দেয়া হল। ——-
https://www.youtube.com/
এই ভিডিও সাক্ষাৎকার সোস্যাল মিডিয়ায় প্রচারিত হলে তোলপাড় শুরু হয়। তখন প্রসিকিউশন সামসুল হক নান্নুকে ট্রাইব্যুনাল ভবনে একটি সংবাদ সম্মেলনে হাজির করে। এ সংবাদ সম্মেলনে নান্নু এসে দাবী করেন ভিডিও চিত্রে ধারন করা ব্যক্তিটি তিনি। এখানে তাঁর নাম ব্যবহার করা হয়েছে। ভিডিও চিত্রে ধারন করা ব্যক্তি তিনি নন। তাঁর বক্তব্য অনুযায়ী পার্থক্য কিছুটা রয়েছে। সংবাদ সম্মেলনে হাজির হওয়া নান্নুর গোফ রয়েছে। ভিডিও সাক্ষাৎকারে প্রচারিত নান্নুর গোফ নেই। বলা হয়, সোস্যাল মিডিয়া প্রচারিত নান্নুর ভিতিও বক্তব্য হচ্ছে মামলা ভিন্নখাতে প্রবাহিত করতে একটি ষড়যন্ত্র।
কিন্তু পরবর্তিতে অনুসন্ধানে দেখা যায়, সংবাদ একমাত্র সম্মেলনেই নান্নুর গোফ রয়েছে। অন্য সব জায়গায় উপস্থিত নান্নুর কোন গোফ নেই। সাক্ষ্য দেয়ার জন্য একটি ঘটনাস্থলে উপস্থিত সামসুল হক নান্নুর একটি ভিডিও চিত্র রয়েছে। সেখানে তদন্ত সংস্থার কর্তকর্তা, প্রসিকিউশনের সদস্যসহ অনেক লোকজন রয়েছেন। সবার সামনে ভিডিও চিত্রে নিজের পরিচয় দিচ্ছেন তিনি সুপ্রিমকোর্টের আইনজীবী। পাবনা বার-এ তিনি প্র্যাকটিস করেন। পাবনা জেলা আওয়ামী লীগের আইন বিষয়ক সম্পাদক।
নান্নুর সাক্ষ্য মাওলানা মতিউর রহমান নিজামীকে ফাঁসি দিতে সহায়তা করেছে। সাক্ষী হিসাবে তাঁর বক্তব্য আমলে নিয়েই নিজামীর দন্ড দেয়া হয়। অথচ নান্নু ভিডিও সাক্ষাৎকারে বলেছেন, তিনি মাওলানা মতিউর রহমান নিজামীকে ১৯৮৬ সালের জাতীয় নির্বাচনের আগে কোন দিন সরাসরি দেখেননি। তাকে সরকারি সাজানো চকে সাক্ষ্য দিতে রাজি করানো হয়েছে। রাজি করাতে তাঁর উপর চাপ সৃস্টির একটা বর্ণনাও তিনি দিয়েছেন। এই নান্নুর সাক্ষীতেই আবার মাওলনা নিজামীর ফাঁসিও দেয় আদালত।
সরকার পক্ষের দাবী হচ্ছে ভিডিও সাক্ষাৎকারে প্রচারিত বক্তব্য নান্নুর সংবাদ সম্মেলনের দাবী অনুযায়ী তিনি দেননি। একটি বিচারকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে এই ভিডিও সাক্ষাৎকার হচ্ছে ষড়যন্ত্র। কিন্তু আসামী পক্ষের দাবী হচ্ছে ভিডিওসাক্ষাৎকার এবং প্রসিকিউশনের সাক্ষী নান্নু একই ব্যক্তি। ট্রাইব্যুনাল এবং আপিল বিভাগ আসামী পক্ষের দাবীকে কোন পাত্তাই দেয়নি। ভিডিও সাক্ষাৎকারে প্রচারিত বক্তব্য যিনি দিয়েছেন তিনি এবং প্রসিকিউশনের সাক্ষী হিসাবে হাজির হওয়া নান্নু একই ব্যক্তি কি না এটা পরীক্ষার দায়িত্ব হচ্ছে আদালতের। পরীক্ষা নীরিক্ষা ছাড়া সন্দেহের উর্ধ্বে উঠে সম্ভব নয়। সন্দেহের উর্ধ্বে না উঠে কাউকে মৃত্যুদন্ড দেয়াও আইনের দৃষ্টিতে অপরাধ। প্রশ্ন হচ্ছে আমাদের সুপ্রিমকোর্ট কি আইনের উর্ধ্বে উঠে সরকারি চক অনুযায়ী সাজানো ঘটনায় একটি রাজনৈতিক দলের প্রধান এবং একধিকবার জনগরে রায়ে নির্বাচিত সাবেক সংসদ সদস্যকে মৃত্যুদন্ড দেবেন?
ভিডিও সাক্ষাৎকারে প্রচারিত নান্নু আর সাক্ষ্য হিসাবে হাজির হওয়া নান্নু একই ব্যক্তি কিনা সেটা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা কি খুব কঠিন বিষয়! দুনিয়াতে এখন প্রযুক্তির শেষ নেই। মানুষের ভয়েস, ফটো পরীক্ষা করার অনেক কৌশল আবিস্কার হয়েছে। হাত বাড়ালেই এসব প্রযুক্তি এবং সংশ্লিস্ট বিষয়ে এক্সপার্ট পাওয়া যায়। অতি সম্প্রতি গত ২৩ মার্চ লন্ডনের ইমেগ্রেশন আপার ট্রাইব্যুনালে একটি রায় হয়েছে। এই মামলা চলাকালীন ভয়েস এক্সপার্ট ডাকা হয়। এক ছাত্রের ভয়েস এবং সংশ্লিষ্ট দফতরের মৌখিক ইংলিশ টেষ্ট পরীক্ষায় ধারন করা ভিডিও’র ভয়েস একই ব্যক্তির কিনা, সেটা পরীক্ষা করা হয়। মামলাটি ছিল হোম অফিস ওই ছাত্রের ভিসা বাতিল করে দেয়। অভিযোগ হচ্ছে, মৌখিক ইংলিশ টেষ্ট নিজে না দিয়ে অন্যের মাধ্যমে দেয়ানো হয়েছে। পরীক্ষায় জালিয়াতি করা হয়েছে। ছাত্রটি তা চ্যালেঞ্জ করে আদালতে যায়। ইমিগ্রেশন আপার ট্রাইব্যুনাল ভয়েস এক্সপার্ট ডেকে টেপরেকর্ডে ধারন করা পরীক্ষার বক্তব্য এবং ছাত্রের সরাসরি বক্তব্য গ্রহন নেয়। দুই বক্তব্যে গলার স্বর পরীক্ষা করে ভয়েস এক্সপার্ট। এতে বের হয়ে আসে ওই ছাত্রের ভিসা বাতিল সঠিক হয়নি। কারন টেপ রেকর্ডে ধারন করা ভয়েস এবং ছাত্রের সরাসরি ভয়েসে কোন অমিল পাওয়া যায়নি। ভয়েস এক্সপার্টের রিপোর্টে ভিত্তি করে আদালত রায় দেয়।
অথচ মাওলানা মতিউর রহমান নিজামীর মামলায় সাক্ষী অ্যাডভোকেট সামসুল হক নান্নু এবং ইউটিউভে প্রচারিত ইন্টারভিউতে সামসুল হক নান্নুর ভিডিও চিত্র রয়েছে। শুধু ভয়েস নয়। ভিডিও চিত্র আর ভয়েস একসঙ্গে থাকায় এক্সপার্টের জন্য পরীক্ষার কাজটি আরো সহজ হওয়ার কথা। আরো কিছু ভিডিও চিত্র রয়েছে যা তদন্ত সংস্থা ধারন করেছে। এসব মিলিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে নিশ্চিত হওয়া কোন কঠিন ব্যাপার নয়। আর এই পরীক্ষা-নিরীক্ষা ছাড়া আদালত নিজের এখতিয়ারে ফাঁসির জন্য ফাঁসি দিলে অনেক প্রশ্ন এবং রহস্য থেকেই যাবে। প্রশ্ন আর রহস্য জিয়ে রেখে কাউকে ফাঁসির দন্ডের মত খুনের আদেশ দেয়া কতটা ন্যায়বিচার সাপেক্ষ হবে সেটা ভবিষ্যৎ অনুসন্ধানের রায় বলে দেবে।
ভিডিও চিত্রে ধারন করা নান্নু, সাক্ষী হিসাবে উপস্থিত হওয়া নান্নু এবং সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত নান্নুর ভিডিও চিত্রের লিঙ্ক এখানে পাঠকের বিচারের জন্য দেয়া হল। চাইলে কেউ ক্লিক করে দেখে নিতে পারেন। যাছাই করতে পারেন নিজে-----
https://www.youtube.com/লেখক: অলিউল্লাহ নোমান, দৈনিক আমার দেশ-এর বিশেষ প্রতিনিধি, বর্তমানে যুক্তরাজ্যে নির্বাসিত।