সামছুল আরেফীন, তোফাজ্জল হোসেন কামাল, ইব্রাহিম খলিল, রেজাউল বারী বাবুল : বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদ সদস্য মীর কাসেম আলীর মৃত্যুদ- কার্যকর করা হয়েছে। ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন। গতকাল শনিবার দিবাগত রাত ১০টা ৩০ মিনিটে গাজীপুরের কাশিমপুর কেন্দ্রীয় কারাগার পার্ট-২ এ ফাঁসিতে ঝুলিয়ে তার মৃত্যুদ- কার্যকর করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) এ কে এম শহীদুল হক। পরে ঢাকা রেঞ্জের ডিআইজি মাহফুজুল হক নুরুজ্জামানও কারাগার থেকে বের হয়ে সাংবাদিকদের বলেন, রাত সাড়ে দশটার পর ফাঁসি কার্যকর করা হয়। ২০ মিনিট তাকে ফাঁসির মঞ্চে ঝুলিয়ে রাখা হয়। কাশিমপুর কারাগার-২ সূত্র জানায়, শনিবার দুপুরের পর কারাগারের ভেতরে মঞ্চে চূড়ান্ত মহড়ায় চার জল্লাদ অংশ নেন। তারা হলেন শাহজাহান, দ্বীন ইসলাম, রিপন ও শাহীন। রাতে জল্লাদ শাহজাহানের নেতৃত্বে ফাঁসি কার্যকর করে তারা।
কারা কর্তৃপক্ষ জানায়, মীর কাসেম আলীর মৃত্যুদ- কার্যকরের পর লাশের সুরতহাল রিপোর্ট সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের উপস্থিতিতে সম্পন্ন করা হয়। এরপর ময়নাতদন্ত শেষে পুলিশ-র্যাবের কড়া নিরাপত্তায় রাত সাড়ে ১২টার দিকে এ্যাম্বুলেন্সে করে মীর কাসেম আলীর লাশ গ্রামের বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা হয়। অসিয়ত অনুযায়ী মানিকগঞ্জের হরিরামপুর উপজেলার চালা জামে মসজিদের পাশে তাকে দাফন করার কথা রয়েছে।
মানিকগঞ্জের স্থানীয় সূত্রগুলো জানায়, চালাগ্রামের মীরবাড়ি জামে মসজিদের পশ্চিম পাশে তার দাফনের ব্যবস্থা করা হয়েছে। এখানে কবর খননে সহায়তা করেন মীর কাসেম আলী প্রতিষ্ঠিত এতিমখানার এতিমরা। তদারক করেন স্থানীয় প্রশাসনের উর্ধ্বতন কর্মকর্তাবৃন্দ। এর আগে স্থানীয় প্রশাসন গোটা এলাকায় নিরাপত্তা জোরদার করে। এর মধ্যেই রাত সাড়ে ১০টার দিকে পরিবারের সদস্যরা ৫টি গাড়িতে করে এলাকায় যান। তাদেরকে দেড় মাইল দূরে কলতাবাজার বেইলী ব্রীজের কাছে আইনশৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা পথরোধ করে। পরে তারা ৩টি গাড়িতে করে বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দেন। পথে কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থা গড়ে তোলে আইন শৃংখলা বাহিনী। কাউকেই মীর কাসেম আলীর বাড়ির দিকে যেতে দেয়া হচ্ছে না বলে স্থানীয়রা জানিয়েছেন।
গাজীপুরের কাশিমপুর কেন্দ্রীয় কারাগার-২-এর ৪০ নম্বর ফাঁসির সেলে ছিলেন মীর কাসেম আলী। গতকাল তাঁর ফাঁসি কার্যকরের নির্বাহী আদেশ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রনালয় থেকে বিশেষ বাহক মারফতে কড়া নিরাপত্তায় কাশিমপুর কেন্দ্রীয় কারাগার কর্তৃপক্ষের কাছে পাঠানোর পরই ফাঁসি কার্যকরের সব প্রস্তুতি নেয় কারা কর্তৃপক্ষ। সরকারের নির্বাহী আদেশ দুপুরে কারাগারে প্রবেশের পরপরই দৃশ্যপট দ্রুত বদলাতে শুরু করে। সময় গড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে রাতেই ফাঁসি কার্যকরের লক্ষণ স্পষ্ট হতে থাকে। ওই সময় কারাগার এলাকার নিরাপত্তা কয়েকগুণ বাড়ানো হয়। পুলিশের পাশাপাশি কারাগারের ফটকে সারিবেঁধে অবস্থান নেন বিপুলসংখ্যক র্যাব সদস্য। কারাগারের আরপি চেকপোস্ট সংলগ্ন দোকানপাট দুপুরেই বন্ধ করে দেয়া হয়। গতকাল সকাল থেকে কাশিমপুর কারাগারের চারপাশে বাড়তি নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়। পোশাকে ও সাদাপোশাকে কাজ করেছেন পুলিশ, র্যাবসহ একাধিক গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যরা। কোনো প্রকার অপ্রীতিকর ঘটনা এড়াতে নিরাপত্তার স্বার্থে রাজধানী ঢাকা ও গাজীপুরে ১০ প্লাটুন বিজিবি সদস্য মোতায়েন করা হয়। সন্ধ্যার পরই তাদের টহল জোরদার করা হয় সংশ্লিষ্ট এলাকাগুলোতে।
বিকাল সোয়া ৪টার দিকে কারাগারে ঢোকে ফায়ার সার্ভিসের একটা গাড়ি। পুলিশের একটি জলকামান আগের রাতেই কারাগারের ভেতরে নিয়ে রাখা হয়েছিল। অতিরিক্ত আইজি (প্রিজন্স) কর্নেল ইকবাল হাসানকে দুপুর দেড়টার দিকে কাশিমপুর কারাগারে ঢুকতে দেখা যায়। এরপর বিকাল ৪টায় কারাগারে যান ডিআইজি (প্রিজন্স) গোলাম হায়দার। বিকাল চারটা ১৫ মিনিটে মীর কাসেমের সঙ্গে শেষ দেখা করতে কাশিমপুর কারাগারে যান তার পরিবারের সদস্যরা। এ সময়েই কারাগারে মৃত্যুদ- কার্যকরের নির্বাহী আদেশ পাঠানো হয়েছে বলে জানান স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন মিয়া।
মীর কাসেমের স্বজনরা বেরিয়ে যাওয়ার পর ভেতরে যান কারা মহাপরিদর্শক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল সৈয়দ ইফতেখার উদ্দীন। পরে গাজীপুরের জেলা প্রশাসক (জেলা ম্যাজিস্ট্রেট) এসএম আলাম, সিভিল সার্জন আলী হায়দার খান, অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট রাহেনুল ইসলামসহ সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা কারাগারের ভেতরে ঢোকেন রাত সাড়ে ৯টার দিকে।
এর আগেই নিয়ম অনুযায়ী মীর কাসেম আলীর স্বাস্থ্য পরীক্ষা সম্পন্ন হয়। এরপর তাকে ফাঁসির সেল থেকে নেয়া হয় ফাঁসির মঞ্চে।
সন্ধ্যা সাড়ে ৬টায় কারাগার থেকে বেরিয়ে যাওয়ার সময় মীর কাসেমের স্ত্রী খন্দকার আয়েশা খাতুন সাংবাদিকদের বলেন, “যারা ফাঁসি দিচ্ছে তারা জয়ী হবে না। এই মৃত্যু শহীদের সামিল।” তিনি বলেন, ‘তিনি (মীর কাসেম আলী) আমাকে বলেছেন, তাঁকে ফাঁসির কথা জানানো হয়েছে। মানিকগঞ্জে তাঁকে দাফন করা হবে।’ মীর কাসেম আলীর শেষ ইচ্ছার কথা জানিয়েছেন কি না, জানতে চাইলে আয়েশা খাতুন বলেন, শেষ মুহূর্তেও ছেলের সঙ্গে দেখা না হওয়ায় আক্ষেপ করেছেন তিনি।
মীর কাসেম আলীর মৃত্যুদ-ের রায় পুনর্বিবেচনার (রিভিউ) আবেদন গত মঙ্গলবার খারিজ করে দেন দেশের সর্বোচ্চ আদালত। ওইদিন সকালে এই রায় ঘোষণার পর বিকেলেই পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশিত হয়।
প্রাণভিক্ষা চাইবেন না বলে জানালো কারা কর্তৃপক্ষ : মীর কাসেম আলী রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণভিক্ষা চাইবেন না বলে গত শুক্রবার জানায় কারা কর্তৃপক্ষ। বিকাল সোয়া ৪টায় সাংবাদিকদের কাশিমপুর কারাগার-২ এর জেল সুপার প্রশান্ত কুমার বণিক বলেন, আমরা দুপুরের পর আবারও তার সিদ্ধান্ত জানতে চেয়েছিলাম। উনি জানিয়েছেন, রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণভিক্ষা চাইবেন না।
রিভিউ খারিজের পর পরিবারের সাক্ষাৎ : ৩১ আগষ্ট রিভিউ খারিজের রায় পর বিকেলে পরিবারের সদস্যরা মীর কাসেম আলীর সাথে কারাগারে সাক্ষাত করেন। মীর কাসেম আলীর স্ত্রী খন্দকার আয়েশা খাতুন এবং দুই মেয়ে সুমাইয়া রাবেয়া ও তাহেরা তাসনিম, পুত্রবধূ শাহেদা তাহমিদা ও তাহমিনা আক্তার এবং ভাতিজা হাছান জামাল খান এবং ছেলে ও মেয়ের ঘরের ৩জন নাতি নাতনি বুধবার বেলা ২টার দিকে কাশিমপুর কারাগারে পৌঁছান। স্বাক্ষাৎ শেষে বিকাল পৌনে চারটায় দিকে কারাগার ত্যাগ করেন তারা।
এ সময় মীর কাসেম আলী তার ছেলেকে কাছে পেতে চান এবং ছেলের সাথে কথা বলেই রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণ ভিক্ষার আবেদন সংক্রান্ত বিষয়ে মতামত জানানো হবে বলে জানান তার স্ত্রী খোন্দকার আয়েশা খাতুন। তিনি সাংবাদিকদের মাধ্যমে সরকারের কাছে তাদের ছেলেকে ফেরত চেয়েছেন।
কারাগারে রায়ের কপি : ৩১ আগষ্ট রিভিউ খারিজের রায় প্রকাশিত হওয়ার পর অনুলিপি সন্ধ্যা সোয়া ৬টার দিকে ট্রাইব্যুনালে পৌঁছায়। ৭ টা ১০ মিনিটের দিকে ট্রাইব্যুনালের কর্মকর্তারা রায়ের অনুলিপি নিয়ে কারাগারের উদ্দেশে যাত্রা শুরু করেন। সেখান থেকে রায়ের অনুলিপি কেন্দ্রীয় কারাগারে পৌঁছে।
কারা কর্তৃপক্ষ জানান, পরদিন সকালে সকাল সাড়ে ৭টার দিকে মীর কাসেম আলীকে তার রিভিউ আবেদন খারিজ হওয়ার রায় পড়ে শোনানো হয়।
মামলার ধারাক্রম : মীর কাসেম আলীর মৃত্যুদন্ডের রায় পুনর্বিবেচনার আবেদন (রিভিউ) গত মঙ্গলবার খারিজ করে দেয় সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ। ডিসমিসড’ এক শব্দে আদালত রিভিউ আবেদনটি খারিজ করেন। পরে বিকাল ৫ টা ১৫ মিনিটের দিকে রিভিউ খারিজের রায় সুপ্রিম কোর্টের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত হয়।
গত ২৫ জুলাই রিভিউ শুনানির জন্য প্রস্তুতিতে দু’ মাস সময় চাইলে সর্বোচ্চ আদালত এক মাস শুনানি পিছিয়ে দেন। ওইদিন মীর কাসেম আলীর প্রধান আইনজীবী ও সুপ্রিম কোর্ট বার এসোসিয়েশনের সাবেক সভাপতি খন্দকার মাহবুব হোসেন রিভিউ শুনানির দুই মাসের সময় আবেদন করেন। এর প্রেক্ষিতে আদালত এক মাসের সময় মঞ্জুর করেন। ওই দিনই ২৪ আগস্ট রিভিউ শুনানির পরবর্তী দিন নির্ধারণ করেন আদালত। এর ধারাবাহিকতায় ২৩ আগস্ট শুনানির জন্য কার্যতালিকায় আসে। পরদিন বুধবার শুনানি শুরু হয়ে আবার ২৮ আগস্ট দিন ধার্য করা হয়। সে অনুযায়ী শুনানি শেষে ৩১ আগষ্ট রায়ের দিন ধার্য করা হয়।
গত ১৯ জুন আপিল বিভাগের মৃত্যুদন্ডের রায় পুনর্বিবেচনা চেয়ে আবেদন করেন মীর কাসেম আলী। রিভিউ দাখিলের একদিন পরেই সরকার পক্ষ দিন ধার্যের জন্য আবেদন করে। পরে ২১ জুন আপিল বিভাগের চেম্বার জজ বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী রিভিউ শুনানির জন্য ২৫ জুলাই দিন ধার্য করেন। এরই ধারাবাহিকতায় বিষয়টি আপিল বিভাগের ২৫ জুলাইর কার্যতালিকায় আসে।
এর আগে গত ৬ জুন মীর কাসেম আলীর মৃত্যুদন্ড বহাল রেখে পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ করে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ।
গত ৮ মার্চ মীর কাসেম আলীর আপিল আংশিক মঞ্জুর করে তিনটি অভিযোগ থেকে তাকে অব্যাহতি এবং সাতটি অভিযোগে সাজা বহাল রাখেন সুপ্রিম কোটের্র আপিল বিভাগ। এরমধ্যে ১১ নম্বর অভিযোগে কিশোর মুক্তিযোদ্ধা জসিম উদ্দিন হত্যার অভিযোগে ট্রাইব্যুনালের দেয়া মৃত্যুদন্ডের রায় বহাল রাখেন আপিল বিভাগ।
২০১৪ সালের ২ নবেম্বর আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২ এর চেয়ারম্যান বিচারপতি ওবায়দুল হাসানের নেতৃত্বে দু’ সদস্য মীর কাসেম আলীর বিরুদ্ধে মৃত্যুদন্ডের রায় প্রদান করেন। ওইদিন মোট ৩৫১ পৃষ্ঠার রায়ের মধ্যে ১১ পৃষ্ঠার সংক্ষিপ্ত রায় পড়ে শোনায় ট্রাইব্যুনাল।
একই বছরের ৩০ নবেম্বর ট্রাইব্যুনালের দেয়া মৃত্যুদন্ডের রায় থেকে খালাস চেয়ে আপিল করেন মীর কাসেম আলী। তার পক্ষে আইনজীবীরা আপিলটি দাখিল করেন। আপিলটি পাঁচটি ভলিউমে ১৭৫০ পৃষ্ঠার। ১৫০ পৃষ্ঠার আপিলে ১৮১টি যুক্তিতে খালাস চাওয়া হয়েছিল।
২০১২ সালের ১৭ জুন মীর কাসেম আলীর বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করলে ওই দিনই তাকে গ্রেফতার করে বিকেল সোয়া চারটার দিকে ট্রাইব্যুনালে নিয়ে আসে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।
কারা কর্তৃপক্ষ জানায়, মীর কাসেম আলীর মৃত্যুদ- কার্যকরের পর লাশের সুরতহাল রিপোর্ট সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের উপস্থিতিতে সম্পন্ন করা হয়। এরপর ময়নাতদন্ত শেষে পুলিশ-র্যাবের কড়া নিরাপত্তায় রাত সাড়ে ১২টার দিকে এ্যাম্বুলেন্সে করে মীর কাসেম আলীর লাশ গ্রামের বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা হয়। অসিয়ত অনুযায়ী মানিকগঞ্জের হরিরামপুর উপজেলার চালা জামে মসজিদের পাশে তাকে দাফন করার কথা রয়েছে।
মানিকগঞ্জের স্থানীয় সূত্রগুলো জানায়, চালাগ্রামের মীরবাড়ি জামে মসজিদের পশ্চিম পাশে তার দাফনের ব্যবস্থা করা হয়েছে। এখানে কবর খননে সহায়তা করেন মীর কাসেম আলী প্রতিষ্ঠিত এতিমখানার এতিমরা। তদারক করেন স্থানীয় প্রশাসনের উর্ধ্বতন কর্মকর্তাবৃন্দ। এর আগে স্থানীয় প্রশাসন গোটা এলাকায় নিরাপত্তা জোরদার করে। এর মধ্যেই রাত সাড়ে ১০টার দিকে পরিবারের সদস্যরা ৫টি গাড়িতে করে এলাকায় যান। তাদেরকে দেড় মাইল দূরে কলতাবাজার বেইলী ব্রীজের কাছে আইনশৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা পথরোধ করে। পরে তারা ৩টি গাড়িতে করে বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দেন। পথে কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থা গড়ে তোলে আইন শৃংখলা বাহিনী। কাউকেই মীর কাসেম আলীর বাড়ির দিকে যেতে দেয়া হচ্ছে না বলে স্থানীয়রা জানিয়েছেন।
গাজীপুরের কাশিমপুর কেন্দ্রীয় কারাগার-২-এর ৪০ নম্বর ফাঁসির সেলে ছিলেন মীর কাসেম আলী। গতকাল তাঁর ফাঁসি কার্যকরের নির্বাহী আদেশ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রনালয় থেকে বিশেষ বাহক মারফতে কড়া নিরাপত্তায় কাশিমপুর কেন্দ্রীয় কারাগার কর্তৃপক্ষের কাছে পাঠানোর পরই ফাঁসি কার্যকরের সব প্রস্তুতি নেয় কারা কর্তৃপক্ষ। সরকারের নির্বাহী আদেশ দুপুরে কারাগারে প্রবেশের পরপরই দৃশ্যপট দ্রুত বদলাতে শুরু করে। সময় গড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে রাতেই ফাঁসি কার্যকরের লক্ষণ স্পষ্ট হতে থাকে। ওই সময় কারাগার এলাকার নিরাপত্তা কয়েকগুণ বাড়ানো হয়। পুলিশের পাশাপাশি কারাগারের ফটকে সারিবেঁধে অবস্থান নেন বিপুলসংখ্যক র্যাব সদস্য। কারাগারের আরপি চেকপোস্ট সংলগ্ন দোকানপাট দুপুরেই বন্ধ করে দেয়া হয়। গতকাল সকাল থেকে কাশিমপুর কারাগারের চারপাশে বাড়তি নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়। পোশাকে ও সাদাপোশাকে কাজ করেছেন পুলিশ, র্যাবসহ একাধিক গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যরা। কোনো প্রকার অপ্রীতিকর ঘটনা এড়াতে নিরাপত্তার স্বার্থে রাজধানী ঢাকা ও গাজীপুরে ১০ প্লাটুন বিজিবি সদস্য মোতায়েন করা হয়। সন্ধ্যার পরই তাদের টহল জোরদার করা হয় সংশ্লিষ্ট এলাকাগুলোতে।
বিকাল সোয়া ৪টার দিকে কারাগারে ঢোকে ফায়ার সার্ভিসের একটা গাড়ি। পুলিশের একটি জলকামান আগের রাতেই কারাগারের ভেতরে নিয়ে রাখা হয়েছিল। অতিরিক্ত আইজি (প্রিজন্স) কর্নেল ইকবাল হাসানকে দুপুর দেড়টার দিকে কাশিমপুর কারাগারে ঢুকতে দেখা যায়। এরপর বিকাল ৪টায় কারাগারে যান ডিআইজি (প্রিজন্স) গোলাম হায়দার। বিকাল চারটা ১৫ মিনিটে মীর কাসেমের সঙ্গে শেষ দেখা করতে কাশিমপুর কারাগারে যান তার পরিবারের সদস্যরা। এ সময়েই কারাগারে মৃত্যুদ- কার্যকরের নির্বাহী আদেশ পাঠানো হয়েছে বলে জানান স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন মিয়া।
মীর কাসেমের স্বজনরা বেরিয়ে যাওয়ার পর ভেতরে যান কারা মহাপরিদর্শক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল সৈয়দ ইফতেখার উদ্দীন। পরে গাজীপুরের জেলা প্রশাসক (জেলা ম্যাজিস্ট্রেট) এসএম আলাম, সিভিল সার্জন আলী হায়দার খান, অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট রাহেনুল ইসলামসহ সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা কারাগারের ভেতরে ঢোকেন রাত সাড়ে ৯টার দিকে।
এর আগেই নিয়ম অনুযায়ী মীর কাসেম আলীর স্বাস্থ্য পরীক্ষা সম্পন্ন হয়। এরপর তাকে ফাঁসির সেল থেকে নেয়া হয় ফাঁসির মঞ্চে।
সন্ধ্যা সাড়ে ৬টায় কারাগার থেকে বেরিয়ে যাওয়ার সময় মীর কাসেমের স্ত্রী খন্দকার আয়েশা খাতুন সাংবাদিকদের বলেন, “যারা ফাঁসি দিচ্ছে তারা জয়ী হবে না। এই মৃত্যু শহীদের সামিল।” তিনি বলেন, ‘তিনি (মীর কাসেম আলী) আমাকে বলেছেন, তাঁকে ফাঁসির কথা জানানো হয়েছে। মানিকগঞ্জে তাঁকে দাফন করা হবে।’ মীর কাসেম আলীর শেষ ইচ্ছার কথা জানিয়েছেন কি না, জানতে চাইলে আয়েশা খাতুন বলেন, শেষ মুহূর্তেও ছেলের সঙ্গে দেখা না হওয়ায় আক্ষেপ করেছেন তিনি।
মীর কাসেম আলীর মৃত্যুদ-ের রায় পুনর্বিবেচনার (রিভিউ) আবেদন গত মঙ্গলবার খারিজ করে দেন দেশের সর্বোচ্চ আদালত। ওইদিন সকালে এই রায় ঘোষণার পর বিকেলেই পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশিত হয়।
প্রাণভিক্ষা চাইবেন না বলে জানালো কারা কর্তৃপক্ষ : মীর কাসেম আলী রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণভিক্ষা চাইবেন না বলে গত শুক্রবার জানায় কারা কর্তৃপক্ষ। বিকাল সোয়া ৪টায় সাংবাদিকদের কাশিমপুর কারাগার-২ এর জেল সুপার প্রশান্ত কুমার বণিক বলেন, আমরা দুপুরের পর আবারও তার সিদ্ধান্ত জানতে চেয়েছিলাম। উনি জানিয়েছেন, রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণভিক্ষা চাইবেন না।
রিভিউ খারিজের পর পরিবারের সাক্ষাৎ : ৩১ আগষ্ট রিভিউ খারিজের রায় পর বিকেলে পরিবারের সদস্যরা মীর কাসেম আলীর সাথে কারাগারে সাক্ষাত করেন। মীর কাসেম আলীর স্ত্রী খন্দকার আয়েশা খাতুন এবং দুই মেয়ে সুমাইয়া রাবেয়া ও তাহেরা তাসনিম, পুত্রবধূ শাহেদা তাহমিদা ও তাহমিনা আক্তার এবং ভাতিজা হাছান জামাল খান এবং ছেলে ও মেয়ের ঘরের ৩জন নাতি নাতনি বুধবার বেলা ২টার দিকে কাশিমপুর কারাগারে পৌঁছান। স্বাক্ষাৎ শেষে বিকাল পৌনে চারটায় দিকে কারাগার ত্যাগ করেন তারা।
এ সময় মীর কাসেম আলী তার ছেলেকে কাছে পেতে চান এবং ছেলের সাথে কথা বলেই রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণ ভিক্ষার আবেদন সংক্রান্ত বিষয়ে মতামত জানানো হবে বলে জানান তার স্ত্রী খোন্দকার আয়েশা খাতুন। তিনি সাংবাদিকদের মাধ্যমে সরকারের কাছে তাদের ছেলেকে ফেরত চেয়েছেন।
কারাগারে রায়ের কপি : ৩১ আগষ্ট রিভিউ খারিজের রায় প্রকাশিত হওয়ার পর অনুলিপি সন্ধ্যা সোয়া ৬টার দিকে ট্রাইব্যুনালে পৌঁছায়। ৭ টা ১০ মিনিটের দিকে ট্রাইব্যুনালের কর্মকর্তারা রায়ের অনুলিপি নিয়ে কারাগারের উদ্দেশে যাত্রা শুরু করেন। সেখান থেকে রায়ের অনুলিপি কেন্দ্রীয় কারাগারে পৌঁছে।
কারা কর্তৃপক্ষ জানান, পরদিন সকালে সকাল সাড়ে ৭টার দিকে মীর কাসেম আলীকে তার রিভিউ আবেদন খারিজ হওয়ার রায় পড়ে শোনানো হয়।
মামলার ধারাক্রম : মীর কাসেম আলীর মৃত্যুদন্ডের রায় পুনর্বিবেচনার আবেদন (রিভিউ) গত মঙ্গলবার খারিজ করে দেয় সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ। ডিসমিসড’ এক শব্দে আদালত রিভিউ আবেদনটি খারিজ করেন। পরে বিকাল ৫ টা ১৫ মিনিটের দিকে রিভিউ খারিজের রায় সুপ্রিম কোর্টের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত হয়।
গত ২৫ জুলাই রিভিউ শুনানির জন্য প্রস্তুতিতে দু’ মাস সময় চাইলে সর্বোচ্চ আদালত এক মাস শুনানি পিছিয়ে দেন। ওইদিন মীর কাসেম আলীর প্রধান আইনজীবী ও সুপ্রিম কোর্ট বার এসোসিয়েশনের সাবেক সভাপতি খন্দকার মাহবুব হোসেন রিভিউ শুনানির দুই মাসের সময় আবেদন করেন। এর প্রেক্ষিতে আদালত এক মাসের সময় মঞ্জুর করেন। ওই দিনই ২৪ আগস্ট রিভিউ শুনানির পরবর্তী দিন নির্ধারণ করেন আদালত। এর ধারাবাহিকতায় ২৩ আগস্ট শুনানির জন্য কার্যতালিকায় আসে। পরদিন বুধবার শুনানি শুরু হয়ে আবার ২৮ আগস্ট দিন ধার্য করা হয়। সে অনুযায়ী শুনানি শেষে ৩১ আগষ্ট রায়ের দিন ধার্য করা হয়।
গত ১৯ জুন আপিল বিভাগের মৃত্যুদন্ডের রায় পুনর্বিবেচনা চেয়ে আবেদন করেন মীর কাসেম আলী। রিভিউ দাখিলের একদিন পরেই সরকার পক্ষ দিন ধার্যের জন্য আবেদন করে। পরে ২১ জুন আপিল বিভাগের চেম্বার জজ বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী রিভিউ শুনানির জন্য ২৫ জুলাই দিন ধার্য করেন। এরই ধারাবাহিকতায় বিষয়টি আপিল বিভাগের ২৫ জুলাইর কার্যতালিকায় আসে।
এর আগে গত ৬ জুন মীর কাসেম আলীর মৃত্যুদন্ড বহাল রেখে পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ করে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ।
গত ৮ মার্চ মীর কাসেম আলীর আপিল আংশিক মঞ্জুর করে তিনটি অভিযোগ থেকে তাকে অব্যাহতি এবং সাতটি অভিযোগে সাজা বহাল রাখেন সুপ্রিম কোটের্র আপিল বিভাগ। এরমধ্যে ১১ নম্বর অভিযোগে কিশোর মুক্তিযোদ্ধা জসিম উদ্দিন হত্যার অভিযোগে ট্রাইব্যুনালের দেয়া মৃত্যুদন্ডের রায় বহাল রাখেন আপিল বিভাগ।
২০১৪ সালের ২ নবেম্বর আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২ এর চেয়ারম্যান বিচারপতি ওবায়দুল হাসানের নেতৃত্বে দু’ সদস্য মীর কাসেম আলীর বিরুদ্ধে মৃত্যুদন্ডের রায় প্রদান করেন। ওইদিন মোট ৩৫১ পৃষ্ঠার রায়ের মধ্যে ১১ পৃষ্ঠার সংক্ষিপ্ত রায় পড়ে শোনায় ট্রাইব্যুনাল।
একই বছরের ৩০ নবেম্বর ট্রাইব্যুনালের দেয়া মৃত্যুদন্ডের রায় থেকে খালাস চেয়ে আপিল করেন মীর কাসেম আলী। তার পক্ষে আইনজীবীরা আপিলটি দাখিল করেন। আপিলটি পাঁচটি ভলিউমে ১৭৫০ পৃষ্ঠার। ১৫০ পৃষ্ঠার আপিলে ১৮১টি যুক্তিতে খালাস চাওয়া হয়েছিল।
২০১২ সালের ১৭ জুন মীর কাসেম আলীর বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করলে ওই দিনই তাকে গ্রেফতার করে বিকেল সোয়া চারটার দিকে ট্রাইব্যুনালে নিয়ে আসে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।