বঙ্গবন্ধু হত্যায় জাসদ ইনু, জিয়া ও এরশাদ??
[১]
এদিকে অধ্যাপক আবু সাইয়িদ এর লিখা “ফ্যাক্টস এন্ড ডকুমেন্টস : বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ড” বইটিতে দেখা যায় ১৯৮১ সালের ২১শে মে সেনাবাহিনীর ৩ জন সাবেক সদস্য জাতীয় প্রেস ক্লাবে আয়োজিত এক সাংবাদিক সম্মেলনে বলেন, “১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্ট তারিখের সামরিক অভ্যুত্থান এবং সপরিবারে শেখ মুজিব হত্যার ব্যাপারে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ) এবং বর্তমান ডেমোক্রেটিক লীগে যোগদানকারী আওয়ামী লীগের তৎকালীন গ্রুপ দায়ী”।
২১শে মে ১৯৮১ জাতীয় প্রেস ক্লাবে আয়োজিত এই সাংবাদিক সম্মেলনে এই তথ্য প্রকাশকারী সেনাবাহিনীর ৩ জন সাবেক কর্মচারীদের মধ্যে ছিলেন সাবেক নায়েক সুবেদার মোহাম্মদ জালাল উদ্দিন (সহ-সভাপতি, বিপ্লবী সৈনিক সংস্থা - সাবেক গণবাহিনী, দফতর সম্পাদক ), সাবেক নায়েক মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান আসাদ (সদস্য - বিপ্লবী সৈনিক সংস্থা)।
তারা সংবাদ সম্মেলনে উল্লেখ করেন, “১৯৭৪ সালের জুন মাসে আনুষ্ঠানিকভাবে গঠন করা হয় বিপ্লবী গণবাহিনী ও বিপ্লবী সৈনিক সংস্থা। বীরোত্তম কর্নেল তাহের হলেন সৈনিক সংস্থার প্রধান। জাসদের তরফ থেকে যোগাযোগের দায়িত্বে থাকলেন হাসানুল হক ইনু। ক্যান্টনমেন্টে গোপনে গঠিত করা হতে লাগলো বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার ইউনিট।
১৯৭৪ সালের নভেম্বর মাসে জাসদ দেশব্যাপী এক হরতাল আহবান করে এবং সরকারের সঙ্গে সশস্ত্র সংঘর্ষে লিপ্ত হওয়ার কর্মসূচি দেয়। হরতালের পূর্বদিন জাসদের অন্যতম কর্মী প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক নিখিল চন্দ্র সাহা বোমা বানাতে গিয়ে মারা যান। তার নামানুসারে এই বোমার নাম রাখে নিখিল বোমা।
১৯৭৫ সনের জানুয়ারী মাসে শেখ মুজিব বাকশাল গঠন করেন এবং অন্যান্য সকল রাজনৈতিক দলকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়। এমতাবস্থায় হীনবল ও উপায়ন্তরহীন জাসদ নেতৃত্ব শেখ মুজিবের কাছে বাকশালে যোগদানের আনুষ্ঠানিক প্রস্তাব পেশ করেন। কিন্তু শেখ মুজিব তখন এই প্রস্তাবকে আমল দেননি।
ফলে ক্ষিপ্ত হয়ে জাসদ নেতৃত্ব সেনাবাহিনীর কিছু বিক্ষুদ্ধ তরুণ অফিসারের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করে। তাদের সঙ্গে মিলে গড়ে তোলা হয় বিপ্লবী ফোরাম। এই ফোরামের ঘন ঘন বৈঠক বসতে থাকে এখানে সেখানে। গুলশানের এক বাড়িতে বসে নির্ধারিত হয় অভ্যুত্থানের নীল নকশা। সেই বৈঠকেই জাসদের পক্ষ থেকে শেখ মুজিবকে সপরিবারে হত্যা করার প্রস্তাব প্রদান করা হয়।
এই নীল নকশা মোতাবেকই ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্ট শেখ মুজিবুর রহমান সপরিবারে নিহত হন। জাসদ নেতারা বিশেষত: গণবাহিনী ও বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার নেতারা প্রকাশ্যে সেনাবাহিনীর জিপে করে ঘুরে বেড়াতে থাকেন। বাংলাদেশের প্রতিটি অঞ্চলে কুরিয়ারদের পাঠিয়ে দেয়া হয়। নির্দেশ দেয়া হয়, এই অভ্যুত্থান জাসদের স্বপক্ষে অভ্যুত্থান এবং এখনকার বিপ্লবী দায়িত্ব হলো বিভিন্ন ফাঁড়ি ও ট্রেজারিসমূহ থেকে যতটা সম্ভব অস্ত্র ও গোলাবারুদ সংগ্রহ করা। এই নির্দেশ অনুযায়ী মোহাম্মদপুর ফাঁড়ি ও নারায়ণগঞ্জের একটি ফাঁড়ি প্রকাশ্য লুট করা হয় এবং লুন্ঠিত অস্ত্র শস্ত্র তোলা হয় পিটার কাস্টার্সের এলিফেন্ট রোডস্থ বাসভবনে। পরবর্তীকালে পিটার কাস্টার্স এই অস্ত্র শস্ত্রসহই গ্রেফতার হয়। ভারত থেকে ২৪ ঘন্টার নোটিশে বহিষ্কৃত পিটার কাস্টার্সের সঙ্গে জাসদের কি সম্পর্ক ছিল তা জাসদ নেতারা কখনোই পরিষ্কার করে বলেনি। তবে জেলখানায় পিটার কাস্টার্স প্রকাশ্যেই বলে বেড়াতো যে, সে জাসদকে চল্লিশ লক্ষ টাকা দিয়েছে। জাসদের কেউই এর কোন প্রতিবাদ করতো না। প্রসঙ্গত: উল্লেখ্যোগ্য যে, ১৫ই আগস্টের নির্দেশের পরিপ্রেক্ষিতে সারা দেশব্যাপী তিনটি ফাঁড়ি লুট করা সম্ভব হয়।
[২]
এছাড়াও আওয়ামীলীগের নিজেদের এই হত্যাযজ্ঞের সাথে সম্পৃক্ততার প্রমান পাওয়া যায় শহিদুল ইসলাম মিন্টুর সম্পাদনায় প্রকাশিত “শতাব্দীর মহানায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের অজানা অধ্যায়” বই তে -
"... শেখ মুজিব আওয়ামী লীগের 'প্রাসাদ ষড়যন্ত্রের' শিকার হয়ে নিহত হয়েছিলেন। এ যুক্তি যারা দেন তারা তাদের যুক্তির পক্ষে '৭৫-এর পরবর্তী ঘটনার উল্লেখ করেন। প্রকৃতপক্ষে ক্যু'দেতার পর যা ঘটলো তা হচ্ছে খন্দকার মোশতাক পুরোনো আওয়ামী লীগারদের নিয়ে সরকার গঠন করলেন। মুজিব বিরোধী অন্যান্য সংগঠনকে তিনি মন্ত্রিসভায় আমন্ত্রণ জানালেন না। মুজিবের ১৮ জন মন্ত্রীর মধ্যে তিনি ১০ জনকে বহাল রাখলেন। প্রতিমন্ত্রীদের মধ্যে মাত্র ১ জন মোশতাকের মন্ত্রিসভা থেকে বাদ পড়লো। পূর্ণ মন্ত্রীদের মধ্যে একমাত্র আবু সাঈদ চৌধুরী বাদে ৯ জনই বাকশালের নির্বাহী পরিষদ বা কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ছিলেন।
মোশতাকের মন্ত্রিসভায় আওয়ামী লীগ নেতাদের একক অন্তর্ভুক্তি 'প্রাসাদ ষড়যন্ত্রের' ফল। এরা শেখ মুজিবের বাকশাল গঠন মেনে নিতে পারেননি। একটি তথ্যে জানা যায়, আওয়ামী নেতাদের একটি অংশ (যাদের মধ্যে ছিলেন ওবায়দুর রহমান, নুরে আলম সিদ্দিকী, নুরুল ইসলাম মঞ্জু, তাহের উদ্দিন ঠাকুর, শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন) বাকশাল গঠনের পর এক গোপন বৈঠকে মিলিত হয়ে বাকশাল বিরোধিতার সিদ্ধান্ত নেন। এই সূত্রের মতে, অভ্যুত্থানকারীদের সাথে এইসব নেতাদের যোগাযোগ ছিল। আওয়ামী লীগের সংসদীয় আমলের শেষের দিকে যিনি প্রেসিডেন্ট ছিলেন, সেই মোহাম্মদ উল্লাহও স্বীকার করেছেন যে, মুজিবের মন্ত্রিসভায় অনেকে বাকশাল বিরোধী ছিলেন।
শেখ মুজিবের মন্ত্রীদের অন্যতম সদস্য ও বাকশাল কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য অধ্যাপক ইউসুফ আলী এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, 'অভ্যুত্থানকারী মেজরদের অন্যতম মেজর ডালিম তৎকালীন ভাইস-প্রেসিডেন্ট সৈয়দ নজরুল ও কামরুজ্জামানকে ক্ষমতা গ্রহণ করার আহবান জানিয়েছিলেন।' ব্যাপারটি যদি সত্যি হয়, তবে ভাবতে অবাক লাগে যে, সৈয়দ নজরুল ও কামরুজ্জামানের মতো ঘনিষ্ঠ ব্যক্তিরা কেন শেখ মুজিবকে কথাটা খুলে বলেননি। এর সঠিক ব্যাখ্যা এখন আর পাওয়া সম্ভব নয়। কেননা এদের অধিকাংশ এখন বেঁচে নেই। অধ্যাপক ইউসুফ আলী মিথ্যা পরিবেশন করবেন এটা ভাবা না গেলেও ঘটনাটি অধিকাংশ মানুষকে অস্বস্তিতে ফেলে দেয়। '৯১ জুলাই মাসে কর্নেল ফারুক বলেছেন, 'প্রয়োজনে তিনি হাটে হাঁড়ি ভেঙ্গে দেবেন।' কর্নেল ফারুক কি আওযামী লীগ নেতাদের একটা অংশের সাথে তার পূর্ব যোগাযোগের ইঙ্গিত দিয়েছিলেন?"
[৩]
কর্নেল (অব:) শাফায়াত জামিল এর লিখা “একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ, রক্তাক্ত মধ্য-আগস্ট ও ষড়যন্ত্রময় নভেম্বর” বইতে পনেরো আগস্টের অভ্যুত্থানকারীদের সঙ্গে এরশাদের ঘনিষ্ঠতা ও তাদের প্রতি সহমর্মীতা লক্ষণীয়। পরবর্তী সময়ের দুটো ঘটনা এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করা যেতে পারে, কর্নেল শাফায়াত জামিলের বর্ননায় – “প্রথমটি, খুব সম্ভবত:, মেজর জেনারেল জিয়ার সেনাপ্রধানের দায়িত্ব নেয়ার পরবর্তী দ্বিতীয় দিনের ঘটনা। আমি সেনাপ্রধানের অফিসে তার উল্টোদিকে বসে আছি। হঠাৎ করেই রুমে ঢুকলেন সদ্য পদন্নোতি প্রাপ্ত ডেপুটি চিফ মেজর জেনারেল এরশাদ। এরশাদের তখন প্রশিক্ষণের জন্য দিল্লিতে থাকার কথা।
তাকে দেখামাত্রই সেনাপ্রধান জিয়া বেশ রুঢ়ভাবে জিজ্ঞেস করলেন, তিনি বিনা অনুমতিতে কেন দেশে ফিরে এসেছেন। জবাবে এরশাদ বললেন, তিনি দিল্লিতে অবস্থানরত তার স্ত্রীর জন্য একজন গৃহভৃত্য নিতে এসেছেন। এই জবাব শুনে জিয়া অত্যন্ত রেগে গিয়ে বললেন, আপনার মতো সিনিয়র অফিসারদের এই ধরণের লাগামছাড়া আচরণের জন্যই জুনিয়র অফিসাররা রাষ্ট্রপ্রধানকে হত্যা করে দেশের ক্ষমতা দখলের মতো কাজ করতে পেরেছে। জিয়া তার ডেপুটি এরশাদকে পরবর্তী ফ্লাইটেই দিল্লি ফিরে যাওয়ার নির্দেশ দিলেন। তাকে বঙ্গভবনে যেতেও নিষেধ করলেন। এরশাদকে বসার কোন সুযোগ না দিয়ে জিয়া তাকে একরকম তাড়িয়েই দিলেন।
পরদিন ভোরে এরশাদ তার প্রশিক্ষণস্থল দিল্লিতে চলে গেলেন ঠিকই, কিন্তু সেনাপ্রধান জিয়ার নির্দেশ অমান্য করে রাতে তিনি বঙ্গভবনে যান। অনেক রাত পর্যন্ত তিনি সেখানে অবস্থানরত অভ্যুত্থানকারীদের সঙ্গে বৈঠক করেন। এর থেকেই মনে হয় এরশাদ আসলে তাদের সঙ্গে শলাপরামর্শ করার জন্যই ঢাকা এসেছিলেন”।
দ্বিতীয় ঘটনাটি আরো পরের। জিয়ার শাসনামলের শেষদিকের কথা। ঐ সময় বিদেশে অবস্থিত বাংলাদেশের বিভিন্ন দূতাবাসে কর্মরত ১৫ আগস্টের অভ্যুত্থানকারী অফিসাররা গোপনে মিলিত হয়ে জিয়া সরকারকে উৎখাত করার ষড়যন্ত্র করে। এক পর্যায়ে ওই ষড়যন্ত্র ফাঁস হয়ে গেলে তাদের সবাইকে ঢাকায় তলব করা হয়। সম্ভাব্য বিপদ আঁচ করতে পেরে চক্রান্তকারী অফিসাররা যার যার দূতাবাস ত্যাগ করে লন্ডনসহ বিভিন্ন জায়গায় রাজনৈতিক আশ্রয় নেয়। এদিকে বাংলাদেশে সেনাবাহিনীতে কর্মরত কয়েকজন সদস্য একই অপরাধে অভিযুক্ত হয়ে বিচারের সম্মুখীন হন। আরো অনেকের সঙ্গে লে: কর্নেল দীদারের দশ বছর এবং লে: কর্নেল নুরুন্নবী খানের এক বছর মেয়াদের কারাদন্ড হয়। প্রধান আসামীরা বাংলাদেশের সরকার ও আইনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে বিদেশে নিরাপদেই অবস্থান করছিল। ঐ বিচার তাই একরকম প্রহসনেই পরিণত হয়।
পরবর্তীকালে, জেনারেল এরশাদ রাষ্ট্রক্ষমতায় আসার পর অভ্যুত্থানকারীদের মধ্যে যারা চাকরি করতে চেয়েছিলেন, এরশাদ তাদেরকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের চাকরিতে পুনর্বহাল করেন। দ্বিতীয়বারের মতো পুনর্বাসিত হল ১৫ আগস্টের অভ্যুত্থানকারীরা পোস্টিং নিয়ে তাদের অনেকে বিভিন্ন দূতাবাসে যোগ দেয়।
শুধু পুনর্বাসনই নয়। এরশাদ আগস্ট অভ্যুত্থানের সঙ্গে জড়িত উল্লেখিত অফিসারদের কর্মস্থলে বিনাঅনুমতিতে অনুপস্থিতকালের প্রায় তিন বছরের পুরো বেতন ও ভাতার ব্যবস্থাও করে দেন”।
বাংলাদেশের মানুষ আজ বিস্ময়ে তাকিয়ে দেখছে, যারা সেদিন বঙ্গবন্ধু হত্যার সাথে, ছোট্ট শিশু রাসেল হত্যার সাথে প্রত্যাক্ষ্য বা পরক্ষভাবে যুক্ত ছিল অথবা হত্যার পর যাদের ট্যাঙ্কের উপর দাঁড়িয়ে উল্লাস প্রকাশ্যে উল্লাস করতে দেখা গেছে তারাই আজ বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার কোলে আশ্রিত। অথচ যেই গুটিকয়েক লোক সেদিন এই হত্যার প্রতিবাদ করেছিল যেমন বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকি আজ নিগৃহীত।
তিনটি সেনা অভ্যুত্থান ও কিছু না বলা কথা ॥ লে: কর্নেল (অব:) এম এ হামিদ পিএসসি [ শিখা প্রকাশনী - ফেব্রুয়ারি, ২০০৩ । পৃ: ২৫-২৮ ]
জাসদের উত্থান পতন : অস্থির সময়ের রাজনীতি ॥ মহিউদ্দিন আহমদ [ প্রথমা প্রকাশন : জানুয়ারি, ২০১৫ (তৃতীয় সংস্করণ) । পৃ: ১৭৬-১৭৯ ]
ফ্যাক্টস এন্ড ডকুমেন্টস : বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ড ॥ অধ্যাপক আবু সাইয়িদ
[ চারুলিপি - ফেব্রুয়ারী, ১৯৮৬ । পৃ: ১৮৫-১৯০ ]
শতাব্দীর মহানায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের অজানা অধ্যায় / সম্পাদনা: শহিদুল ইসলাম মিন্টু ॥ [ শিখা প্রকাশনী - ফেব্রুয়ারী, ১৯৯৭ । পৃ: ৩৯-৪০ ]
একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ, রক্তাক্ত মধ্য-আগস্ট ও ষড়যন্ত্রময় নভেম্বর ॥ কর্নেল শাফায়াত জামিল (অব:) [ সাহিত্য প্রকাশ - ফেব্রুয়ারী, ১৯৯৮ । পৃ: ১২০-১২১ ]