আমাদের বাংলাদেশ অনলাইন নিউজ ডেস্কঃ সাদা পোশাকে ধরে নেয়ার পর নিখোঁজ ব্যক্তিদের স্বজনদের দিন কাটছে আতঙ্কে-উদ্বেগে। বাসা-বাড়ি বা ঘরের বাইরে স্বজনদের সামনে থেকে প্রকাশ্যে ধরে নেয়ার পর দীর্ঘদিনেও বহু মানুষের খোঁজ মিলছে না। এমনকি আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরাও তাদের ব্যাপারে তথ্য দিতে পারছে না। থানা পুলিশ, ডিবি, র্যাবসহ সংশ্লিষ্টদের দ্বারে দ্বারে ঘুরেও সন্ধান পেতে ব্যর্থ হয়েছেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। কোথাও সন্ধান না পেয়ে এসব ব্যক্তিদের পরিবারে অজানা আতঙ্ক বিরাজ করছে।
মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) এক প্রতিবদেন উল্লেখ করা হয়েছে, পরিবার ও প্রত্যক্ষদর্শীদের দাবি অনুযায়ী গত ৬ মাসে পুলিশ পরিচয়ে সাদা পোশাকে ৫০ জনকে আটক করার ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে পরবর্তীতে ৬জনের লাশ পাওয়া গেছে। ২জন ফেরত এসেছে, ৪ জনকে গ্রেফতার দেখানো হয়েছে বলেও উল্লেখ করে আসক।
আসকের তথ্য অনুযায়ী, গত তিন বছরে (২০১৩-১৫) সারা দেশে ১৮৮ জন অপহরণের পর নিখোঁজ হয়েছে, যাদের মধ্যে ৩২ জনের লাশ পাওয়া গেছে। বাকি ১৫৬ জনের হদিস নেই। সংস্থার বার্ষিক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত বছর আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পরিচয়ে ৫৫ জনকে আটক করা হয়েছে; যাদের কাউকে আটকের কথাই স্বীকার করেনি প্রশাসন।
এদিকে গত ১২ দিন ধরে নিখোঁজ রয়েছেন বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার মীর আহমেদ বিন কাসেম আলী। ১৭ দিন ধরে নিখোঁজ আছেন বিএনপি নেতা হুম্মাম কাদের চৌধুরী।
নিখোঁজ হয়ে যাওয়া ব্যক্তিদের পরিবার থেকে বলা হয়েছে, তারা চরম আতঙ্কের মধ্যে আছেন। তারা জানেন না তাদের স্বজনেরা কেমন আছেন। নিখোঁজ ব্যক্তিরা কোথায় আছেন, কী অবস্থায় আছেন তা কেউ জানতে পারছে না। ঢাকা মহানগর পুলিশের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে ওই দু’জন তাদের কাছে নেই। পুলিশ তাদেরকে আটক বা গ্রেফতার করেনি। এমনকি এ ব্যাপারে থানায় জিডিও নেয়নি বলে অভিযোগ করেছেন স্বজনেরা।
এই দুই জনের আটকের অবসানের বিষয়ে সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন এ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল ও হিউম্যান রাইট্স ওয়াচ-এইচআরডব্লিউ। গত ১৩ আগস্ট নিউ ইয়র্ক থেকে দেয়া এক যৌথ বিবৃতিতে এ দাবি জানানো হয়। মীর আহমেদকে ৯ আগস্ট ও হুম্মামকে ৪ আগস্ট আটক করা হয়। এই দুইজনকে কোন ধরনের পরওয়ানা বা চার্জ ছাড়াই আটক করা হয়েছে এবং তাদেরকে কোন ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে হাজির করা হয়নি, পরিবার কিংবা আইনজীবীদেরও তাদের সাথে দেখা করতে দেয়া হয়নি।
এ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের দক্ষিণ এশিয়ার পরিচালক চম্মা পাটেল বলেন, ‘এটা নিয়ে কোন প্রশ্ন নেই যে, মীর আহমেদ ও হুম্মামকে আইন শৃংখলা বাহিনীর হেফাজতে জোর পূর্বক আটকে রাখা হয়েছে। কিন্তু সরকার অব্যাহতভাবে তা অস্বীকার করে চলছে। দুই জনের সাথেই পরিবার বা আইনজীবীদের দেখা করতে দেয়া হচ্ছে না এবং ম্যাজিস্ট্রেটের সামনেও হাজির করা হয়নি। দুঃখজনকভাবে এটাই বাংলাদেশের বর্তমান প্র্যাকটিস এবং এর শেষ হচ্ছে না।’ বিবৃতিতে বলা হয়, বিএনপির সদস্য হুম্মামকে ৪ আগস্ট আদালতে হাজিরা দেয়ার জন্য তার মায়ের সাথে যাওয়ার সময় আটক করা হয়। তার মায়ের ভাষ্যমতে, সাদা পোষাকের মানুষ, যাদের কয়েকজনের কাছে অস্ত্র ছিল, তারা জোর করে হুম্মামকে গাড়ি থেকে নামিয়ে তাদের সাথে নিয়ে যায়। মীর আহমেদ সুপ্রীমকোর্টের একজন আইনজীবী। তাকে ৯ আগস্ট একইভাবে সাদা পোশাকের মানুষ আটক করে নিয়ে যায়। তাকে গ্রেফতারের সময় তার স্ত্রী ও কাজিন এ সময় উপস্থিত ছিলেন। বিবৃতিতে আরো বলা হয়, এই দুইজনকে গ্রেফতারের বিষয়ে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ বরাবরই অস্বীকার করে আসছে। যদিও বিভিন্ন নির্ভরযোগ্য সূত্র বলছে, তাদের দু’জনকেই ১২ আগস্ট সকালে ঢাকায় র্যাপিড এ্যাকশন ব্যাটালিয়ান-র্যাব হেড কোয়ার্টারে দেখা গেছে। মীর আহমেদ ও হুম্মাম, দুইজনই বিরোধী দলের দুই সিনিয়র নেতার সন্তান।
জানা গেছে, গত ১৮ মার্চ ঝিনাইদহের কালীগঞ্জ পৌরসভা শিবিরের সভাপতি আবুজার গিফারীকে (২২) জুমার নামাজ শেষে বাড়ি ফেরার পথে বাসার সামনে থেকে সাদা পোশাকে পুলিশ পরিচয়ে চার ব্যক্তি মোটরসাইকেলে তুলে নিয়ে যায়। একই দিনে দুপুরের পর শিবিরের নেতা কেসি কলেজের অনার্স দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র শামীমকে (২০) কালীগঞ্জ পৌরসভাধীন মাহাতাব উদ্দিন ডিগ্রি কলেজের পাশ থেকে মোটরসাইকেলে তুলে নিয়ে যায় সাদা পোশাক পরিহিত চার ব্যক্তি। ঘটনার প্রায় চার সপ্তাহ পর গত ১৪ এপ্রিল যশোরের বিরামপুর শ্মশান থেকে অজ্ঞাতপরিচয় হিসেবে যশোর কোতোয়ালি থানার পুলিশ তাদের গুলীবিদ্ধ দুটি লাশ উদ্ধার করে। খবর পেয়ে নিহত আবুজর গিফারীর চাচাতো ভাই পাননু মিয়া ও শামিমের ভাই তাজনিম হুসাইন ঘটনাস্থলে গিয়ে লাশ দুটি আবুজার ও শামিমের বলে শনাক্ত করেন।
১২ মে সাদা মাইক্রোবাসে গোয়েন্দা পুলিশ পরিচয়ে তুলে নিয়ে যায় খালিশপুরের বয়রা সিএসবি গোডাউনের নিরাপত্তা কর্মী মাকসুদুর রহমানের ছেলে মোঃ মনিরুল ইসলাম (২৮) এবং হরিণটানার থানা এলাকার বিসমিল্লাহ নগর মাদরাসার এতিমখানা ও লিল্লাহ বোর্ডিংয়ের শিক্ষক মোঃ আব্দুল্লাহ আল সায়েম তুর্য (২৫) ও একই মাদ্রাসার শিক্ষক সোয়াইবুর রহমানকে (২৬)। ডিবি পুলিশ পরিচয়ে আটক করে নিয়ে যাওয়ার এক সপ্তাহেও সন্ধান মেলেনি। ফলে গভীর উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায় নিখোঁজ ব্যক্তিদের পরিবার-পরিজন।
এর আগে ২০১৫ সালের ৩ মার্চ সোহানের হত্যার স্থানে ডিবি পুলিশ পরিচয়ে তুলে নিয়ে যাওয়া ঝিনাইদহের যুবদল নেতা মেরাজুল ইসলামের গুলীবিদ্ধ লাশ পড়ে ছিল। ঝিনাইদহ জেলার কালীগঞ্জ উপজেলার ঈশ্বরবা গ্রাম থেকে ডিবি পুলিশ পরিচয়ে তুলে নিয়ে যাওয়া কলেজ ছাত্র সোহানুর রহমান সোহানকে। সোহানের মা পারভিনা খাতুন জানান, গত ১০ এপ্রিল, বিকাল ৫টার দিকে কালীগঞ্জ নুর আলী কলেজের ছাত্র সোহান ঈশ্বরবা জামতলা নামক স্থানে অপেক্ষা করছিল। এ সময় নিজেদের ডিবি পুলিশ পরিচয়ে চারজন লোক ইজিবাইকে করে জোরপূর্বক তাকে তুলে নিয়ে যায়। তিনি আরো জানান, তার ছেলে কোনো রাজনীতি করে না।
র্যাবের সদর দফতর সূত্রে জানা গেছে, গত বছর ১৯৬টি অভিযান চালিয়ে ১৫৪ অপহৃতকে উদ্ধার করে র্যাব। এ সময় গ্রেফতার করা হয় ১১০ জনকে। অপহরণের ১৪০টি মামলা নিয়ে কাজ করেছে র্যাব। তবে মানবাধিকার সংস্থাগুলো বলছে, অপহরণ এবং নিখোঁজ হওয়ার ঘটনা প্রশাসন যে হিসাব দিচ্ছে তার চেয়েও অনেক বেশি। বছরে দুই হাজারেরও বেশি মানুষ অপহরণের শিকার হচ্ছে। বছরের পর বছর নিখোঁজ তারা। পুলিশ সদর দফতরের তথ্যমতে, গত পাঁচ বছরে চার হাজার ৩৯৭টি অপহরণের মামলা হয়েছে। এর মধ্যে ২০১৫ সালে ৮০৬, ২০১৪ সালে ৯২০, ২০১৩ সালে ৮৭৯ এবং ২০১২ সালে ৮০৬টি মামলা হয়েছে।
ইউনিফর্ম ছাড়া সাদা পোশাকে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী কর্তৃক গ্রেফতারকে ভয়াবহ অপরাধ বলে অভিহিত করেছেন সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ। ফৌজদারি কার্যবিধির ৫৪ ও ১৬৭ ধারা অনুযায়ী আটক ও রিমান্ডের ক্ষেত্রে হাইকোর্টের দেয়া নির্দেশনার বিরুদ্ধে সরকারের করা আপিল শুনানি চলাকালে গত ১৭ মে আপিল বিভাগের বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন এ মন্তব্য করেন। শুনানির এক পর্যায়ে প্রধান বিচরাপতি এস কে সিনহা অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলমের উদ্দেশে বলেন, বিনা পরোয়ানায় গ্রেফতার ও জিজ্ঞাসাবাদের ক্ষেত্রে হাইকোর্ট সুনির্দিষ্ট কিছু নির্দেশনা দিয়েছিল। ১৩ বছর পার হয়ে গেলেও আপনারা একটি নির্দেশনাও (সরকার) প্রতিপালন করেননি। প্রধান বিচারপতি বলেন, ফৌজদারি কার্যবিধি একটি কলোনিয়াল (ঔপনিবেশিক) আইন। ১৯৭০ সালে মালয়েশিয়া এই আইনের সংশোধনী এনেছে। মালয়েশিয়াকে অনুসরণ করে পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতও তাদের ফৌজদারি কার্যবিধি সংশোধন করেছে। কিন্তু আমরা এখনো এটি করতে পারছি না। প্রধান বিচারপতি আরো বলেন, যথাযথ চিন্তা-ভাবনা না করেই আইন প্রণয়ন না করার কারণেই বিচার বিভাগের ওপর মামলার চাপ আছে।
তিনি আরও বলেন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কাউকে গ্রেফতার করেই গণমাধ্যমের সামনে হাজির করছে, এটি গ্রহণযোগ্য নয়। হাইকোর্টের নির্দেশনায় বলা আছে, আটকাদেশ (ডিটেনশন) দেয়ার জন্য পুলিশ কাউকে ৫৪ ধারায় গ্রেফতার করতে পারবে না। কাউকে গ্রেফতার করার সময় পুলিশ তার পরিচয়পত্র দেখাতে বাধ্য থাকবে। গ্রেফতারের তিন ঘণ্টার মধ্যে গ্রেফতারকৃতকে এর কারণ জানাতে হবে। বাসা বা ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ছাড়া অন্য স্থান থেকে গ্রেফতারকৃতর নিকটাত্মীয়কে এক ঘণ্টার মধ্যে টেলিফোন বা বিশেষ বার্তাবাহক মারফত বিষয়টি জানাতে হবে। গ্রেফতারকৃতকে তার পছন্দসই আইনজীবী ও নিকটাত্মীয়ের সঙ্গে পরামর্শ করতে দিতে হবে। গ্রেফতারকৃত ব্যক্তিকে পুনরায় জিজ্ঞাসাবাদের (রিমান্ড) প্রয়োজন হলে ম্যাজিস্ট্রেটের আদেশক্রমে কারাগারের অভ্যন্তরে কাচ নির্মিত বিশেষ কক্ষে তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করতে হবে। কক্ষের বাইরে তার আইনজীবী ও নিকটাত্মীয় থাকতে পারবেন। জিজ্ঞাসাবাদের আগে ও পরে ওই ব্যক্তির ডাক্তারি পরীক্ষা করাতে হবে। বোর্ড যদি বলে ওই ব্যক্তির ওপর নির্যাতন করা হয়েছে, তাহলে পুলিশ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ম্যাজিস্ট্রেট ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন এবং তাকে দন্ড-বিধির ৩৩০ ধারায় অভিযুক্ত করা হবে। পুলিশ হেফাজতে নির্যাতনের অভিযোগ উঠলে ম্যাজিস্ট্রেট সঙ্গে সঙ্গে মেডিকেল বোর্ড গঠন করবেন।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন