শিশুদের পঙ্গু করতে একটি নিষ্ঠুর প্রক্রিয়া অবলম্বন করা হয়। আসলে শিশুর জন্মের আগেই এই প্রক্রিয়া শুরু হয়। সিন্ডিকেট প্রথমে সম্ভাব্য ‘মা’কে টার্গেট করে। প্রয়োজনে টাকা দেয়। জন্মের পর শিশুটিকে একটি হাঁড়িতে রাখা হয়। এভাবে চলে প্রায় ১৫ দিন। খেতে দেয়া হয়। এই খাবার খাওয়ার পর শিশুটি বেড়ে ওঠে। কিন্তু এই বেড়ে ওঠা স্বাভাবিক নয়। হাঁড়িতে থাকে বলে শিশুর কচি হাড় বেঁকে যায়। ঢাকার কয়েকটি জায়গায় এভাবে শিশুদের পঙ্গু করার ‘কারখানা’ চলছে।
রাজধানীর বিভিন্ন বস্তি ও রেললাইন সংলগ্ন ঝুপড়ি ঘরগুলোতে শিশু-পঙ্গুর কাজটি সম্পন্ন করা হয়। এক্ষেত্রে জন্মের পর ১০-১৫ দিনের জন্য নবজাতককে বড় পাতিল বা হাঁড়ির মধ্যে রেখে দেয়া হয়। সেখানে রেখেই নবজাতককে দেয়া হয় প্রয়োজনীয় খাবার। ফলে সেখানে থাকতে থাকতেই বেঁকে যায় নবজাতকের কচি হাড়, এই বাঁকা হাড় তার সারা জীবনের সঙ্গী হয়। এভাবেই একটি শিশু পরে চিরস্থায়ী ভিক্ষুকে পরিণত হয়। ইচ্ছা করলেও ভিক্ষাবৃত্তি ছেড়ে আর ফিরে আসতে পারেন না স্বাভাবিক জীবনে। যে সিন্ডিকেট এই ভিক্ষুক তৈরি করে তারা ভিক্ষুকদের নিয়ন্ত্রণ করে হাতিয়ে নিচ্ছে কোটি কোটি টাকা। অনুসন্ধানে জানা যায়, ভিক্ষুক সিন্ডিকেটের সঙ্গে হাইকোর্ট এলাকার কোরবান আলী, জহির, মাসুদ, ফার্মগেট-কারওয়ানবাজার এলাকার মহব্বত আলী, করিম শেখ, আব্দুল জব্বার, মহাখালী এলাকার রহমান ফকির, জাহাঙ্গীর, কমলাপুরের আব্বাস মিয়া, কাল্লু ফকির ও রশীদ মণ্ডল প্রমুখ জড়িত। এছাড়া বিভিন্ন এলাকাভেদে স্থানীয় রাজনীতিক ও সন্ত্রাসী বাহিনী ভিক্ষুকদের নিয়ন্ত্রণ করে বলে জানা যায়।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, নবজাতক শিশুকে স্থায়ী পঙ্গু ভিক্ষুক বানানোর প্রক্রিয়াটি কয়েকটি ধাপে সম্পন্ন করে ভিক্ষুক সিন্ডিকেট। প্রথমে তারা দরিদ্র বাবা-মাকে বিভিন্ন প্রলোভন দেখিয়ে হাত করে নেয়। এক্ষেত্রে ভিক্ষুক বাবা-মাকে লক্ষ্য হিসেবে ঠিক করে তারা। পরে বিভিন্ন লোভ দেখিয়ে গর্ভধারণে তাদের উদ্বুদ্ধ করা হয়।
গর্ভকালীন সময়টাতে ঐ দম্পতিকে কিছু টাকা-পয়সাও দেয় তারা। বাচ্চা প্রসব হওয়ার পর শুরু হয় সিন্ডিকেটের দ্বিতীয় ধাপ। এ পর্যায়ে তারা নবজাতক শিশুকে পঙ্গু বানানোর কাজটি করে থাকে। বয়স দুই সপ্তাহ অতিক্রম হওয়ার পর একটি বড় মাটির পাতিল বা হাঁড়ির মধ্যে রাখা হয় নবজাতককে। এক্ষত্রে বেছে নেওয়া হয় রেললাইনের পাশের বস্তির কোনো ঝুপড়ি ঘর। বাঁচিয়ে রাখার জন্য পাতিল বা হাঁড়ির মধ্যেই ফিডারের মাধ্যমে শিশুটিকে সরবরাহ করা হয় দুধ। এভাবে ১০-১৫ দিন রেখে দেওয়া হয়। এই সময়ের মধ্যে বেঁকে যায় শিশুটির কচি হাড়। এরপর নবজাতককে পাতিল/হাঁড়ি থেকে বের করা হয়। এরপর শিশুটির শরীরে যেভাবে বাঁক ধরে সেভাবেই শুইয়ে রাখা হয় বিছানায়। তৃতীয় ধাপে শুরু হয় পঙ্গু শিশুকে নিয়ে ভিক্ষাবৃত্তির প্রাথমিক কাজ। এ পর্যায়ে মা বাচ্চাকে নিয়ে বিভিন্ন স্থানে ভিক্ষা প্রার্থনা করেন। সময়ের সাথে সাথে বেড়ে ওঠে পঙ্গু শিশু। এরপর সে চলে যায় সিন্ডিকেটের খপ্পরে। চতুর্থ ধাপে নিজেদের স্বার্থে পঙ্গু শিশুকে পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নেয় সিন্ডিকেট। মাসিক ৫-৬ হাজার টাকা দেয়ার বিনিময়ে সিন্ডিকেটের নিয়ন্ত্রণে ভিক্ষাবৃত্তিতে বাধ্য করা হয় তাকে। পঙ্গু শিশুর বাবা-মাও মাসিক ৫/৬ হাজার টাকা পেয়ে সন্তুষ্ট থাকেন। আর এই পঙ্গু ভিক্ষুককে দিয়ে দৈনিক হাজার হাজার টাকা পকেটে পুরে ভিক্ষুক সিন্ডিকেটের নেতারা।
দেশবরেণ্য শিশু বিশেষজ্ঞ ও জাতীয় অধ্যাপক ডা. এম আর খান বলেন, জন্মের পর একজন নবজাতকের শরীরের হাড় (বোন) খুবই নমনীয় থাকে। এই সময়টাতে শিশুদের ‘বোন ডেভেলপমেন্ট’ হয়। ফলে নবজাতক শিশুকে যেভাবে রাখা হয় তার শরীরের প্রতিটি হাড় সেভাবেই গড়ে ওঠে। বিজয় সরণি সিগন্যালে কথা হয় পঙ্গু শিশু শরিফুল ইসলামের সঙ্গে। তার বয়স আনুমানিক ১০ বছর। মায়ের সঙ্গে সে ভিক্ষা করে হাইকোর্ট মাজার এলাকায়। দিনে আয় ৫০০-৬০০ টাকা। ঈদ, পূজা ও অন্যান্য উৎসব আর ছুটির দিনগুলোতে তার আয় বেড়ে যায়। প্রতিদিন পাওয়া ভিক্ষার টাকা কী করে, এমন প্রশ্নে মুহূর্তেই মলিন হয়ে যায় শরিফুলের মুখ। সে বলে, ‘পুরোটা পাইলে তো এতদিনে বহুত টাকার মালিক হইয়া যাইতাম। মানুষ অফিসে চাকরি করে, আমি করি রাস্তায়। আমারও বস আছে। আমার বেতন মাসে পাঁচ হাজার। বাকিটা বসের।’
গুলশান এলাকায় দেখা যায় ভিক্ষারত শিশু কবিরকে (ছদ্মনাম)। বয়স ১২-১৩ বছর। তার দুই পা ও দুই হাত অস্বাভাবিকভাবে বাঁকানো। মাটিতে ভর দিয়ে সরীসৃপের মতো এগিয়ে চলে সে। সিগন্যাল পড়লেই দাঁড়ানো গাড়ির জানালার কাছে গিয়ে ভিক্ষা প্রার্থনা করে। মনের খেদে এ প্রতিবেদককে সে বলে, ‘অনেকেই কয় ঢাকার ফকিররা ভিক্ষা করে ফ্ল্যাট-গাড়ি কইরা ফ্যালাইছে। রাস্তায় রাস্তায় মানুষের হাতে-পায়ে ধরে ভিক্ষা নেয়। কিন্তু কপালের পরিবর্তন হয় না। বাড়ি-গাড়ি ঠিকই আছে, তা আমাগো না। আমাগো যারা কন্ট্রোল করে তাদের টাকার শেষ নাই।’ সেই সঙ্গে এ প্রতিবেদককে তার নাম-ঠিকানা না প্রকাশ করার অনুরোধ জানিয়ে বলে, ‘আপনাকে আমি এসব বলছি জানতে পারলে বস মাইরাই ফ্যালাবো আমারে।’
মগবাজার সিগন্যালে কথা হয় রাকিব হোসেনের সঙ্গে (৯)। তার হাত, পা, মেরুদণ্ড ও ঘাড় অস্বাভাবিকভাবে বাঁকানো। কিভাবে এই পঙ্গুত্ব এমন প্রশ্নের জবাবে সে বলে, ‘শুনছি জন্মের পর আমি সুস্থ ও দেখতে ভালা আছিলাম। পরে কিভাবে এমন হইল বলতে পারি না। শুধু আমিই না, আমার মতো আরো অনেকেই আছে যারা জানে না কিভাবে পঙ্গু হইছে।’
সমাজকল্যাণ অধিদফতরের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, শুধু রাজধানী ঢাকাতেই রয়েছে প্রায় এক লাখ স্থায়ী ভিক্ষুক। এর মধ্যে অনেকেই শিশু। শিশু ভিক্ষুকদের মধ্যে সিংহভাগেরই হাত বা পা নেই, অস্বাভাবিক বড় মাথা, কঙ্কালসার দেহ, অস্বাভাবিকভাবে বাঁকানো হাত ও পা। চলাফেরায় একেবারই অক্ষম। সৌজন্যঃ আজকের পত্রিকা