রাজধানীর বাংলামোটর ক্রসিং পার হয়ে ইস্কাটন-মগবাজারের দিকে রিকশা যাওয়া নিষেধ। সেখানে আনসার বা ওই ধরনের কোনো বাহিনীর পোশাক পরা এক বা একাধিক লোক ডাণ্ডা হাতে দাঁড়িয়ে থাকে। রিকশা পার হতে নিলে ডাণ্ডা দিয়ে থামায়। এখানকার ডাণ্ডা রহস্য রিকশাচালকেরা জানেন। তারা মাত্র দু’টি টাকা গুঁজে দেন ওই ডাণ্ডাঅলা লোকটির হাতে। ব্যস, রাস্তা ক্লিয়ার। রিকশা যেতে পারে, কোনো বাধা নেই। আমি এই দুই টাকার কথা বলছি বছরখানেক আগের। এখন তা পাঁচ টাকা বা তারও বেশি হয়েছে কি না, আমার জানা নেই। আর সর্বশেষ একজন রিয়াল এস্টেট ব্যবসায়ী ফজলুল হক রহিম পাঁচ কোটি টাকা দিয়েও পুলিশের হাত থেকে রেহাই পাননি। মানবাধিকার কমিশন থেকে শুরু করে বিভিন্ন স্থানে নালিশ করে তিনি এখন নিখোঁজ রয়েছেন।
ফজলুল হককে পুলিশ প্রথমে অগ্নিসংযোগ মামলায় গ্রেফতার করে ২৮ ফেব্রুয়ারি। তাকে যারা গ্রেফতার করে নিয়ে যায়, তাদের মধ্যে এসআই আবদুল আলিম ও নজরুল ইসলামও ছিলেন। তাকে মুক্ত করে আনতে ফজলুল হকের স্ত্রী তাহমিনা আক্তার দু’টি ফ্ল্যাট ও কোটি টাকার বেশি মুক্তিপণ দেন। তাদের প্রাডো গাড়িটিও নিয়ে যায় পুলিশ, যা এখন পর্যন্ত ফেরত দেয়নি।
প্রথম দফা জামিনে বেরিয়ে এসে ফজলুল হক সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন কর্র্তৃপক্ষের কাছে এ বিষয়ে অভিযোগ করেন। গত ২৯ জুন পুলিশ কমিটির সাথে তার এ বিষয়ে শুনানির দিন ধার্য ছিল। কিন্তু গত ২৫ জুন তাকে আবারো অপহরণ করা হয়। আজ অবধি তার কোনো সন্ধান পায়নি তার পরিবার। পুলিশের সদর দফতর ফজলুল হকের সন্ধান চালিয়ে যাচ্ছে। তবে তার ব্যাপারে কোনো অগ্রগতি নেই বলে কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে। ফলে তার পরিবার এখন আল্লাহ ভরসা বলে অপেক্ষা করছে।
প্রায় একই ঘটনা ঘটেছে সিলেটের শিশু রাজন হত্যা নিয়ে। এ ক্ষেত্রে অভিযোগ আরো মারাত্মক। সৌদি প্রবাসী কামরুলের নেতৃত্বে একদল খুনি ভ্যান চুরির চেষ্টার অভিযোগ এনে গত ৮ জুলাই ভোরে ১৩ বছরের শিশু রাজনকে পিটিয়ে হত্যা করে। সেই হত্যাকাণ্ডের দৃশ্য ২৯ মিনিট ধরে মোবাইল ফোনে ধারণ করে তা এলাকায় ছড়িয়ে দেয়। রাজনের বাবা থানায় এর বিরুদ্ধে মামলা করতে গেলে তাকে পুলিশ গলাধাক্কা দিয়ে থানা থেকে বের করে দেয়। এরপর থানার কর্মকর্তারা খুনিদের সাথে গোপন বৈঠক করেন। অভিযোগ আছে, সেখানে কামরুল থানার সাথে ১২ লাখ টাকায় রফা করে। ছয় লাখ টাকা রাতারাতি দু’টি সিএনজি অটোরিকশা বিক্রিকরে নগদে থানাকে পরিশোধ করা হয়। বাকি ছয় লাখ টাকা পরে দেয়া হবে বলে রফা হয়। সে অনুযায়ী কামরুল এক দিন পর পুলিশের সহায়তায় সৌদি আরব পাড়ি জমায়। সেখানে গিয়ে সে আটক হয় সৌদি প্রবাসীদের হাতে। এখন সে সৌদি আরবে কারাবন্দী আছে।
এই ঘটনায় পুলিশের তদন্ত রিপোর্টেই দেখা গেছে, ওই হত্যার ঘটনায় পুলিশের গাফিলতি ও ঘটনা ধামাচাপা দেয়ার একটি চেষ্টা ছিল। অভিযোগ ছিল সংশ্লিষ্ট থানার ওসি ও দুই এসআইয়ের বিরুদ্ধে। গত শুক্রবার ওসি আলমগীর হোসেনকে ক্লোজড করা হয়েছে এবং এসআই আমিনুল ইসলাম ও জাকির হোসেনকে বরখাস্ত করা হয়েছে। শুক্রবার সকালেই স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেছেন, যেসব পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে গাফিলতির প্রমাণ মিলেছে, তাদের ছাড় দেয়া হবে না। জানা গেছে, এই ঘটনা ধামাচাপা দেয়ার ক্ষেত্রে রাজনৈতিক ব্যক্তিদের সংশ্লিষ্টতারও প্রমাণ পাওয়া গেছে।
এ রকম অভিযোগের সহস্র তীর এখন পুলিশের বিরুদ্ধে। কোথাও কোনো জবাবদিহিতার লেশমাত্র নেই। পুলিশের হাতে কেউ যদি নিহত বা গুম-খুন হয়, তবে তাদের একটা তৈরী ও সহজ জবাব আছে, তা হলো সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির নামে থানায় একাধিক মামলা রয়েছে। থানায় একাধিক মামলা থাকার কী অর্থ বহন করে তা আমাদের কাছে স্পষ্ট নয়। পুলিশের মামলার ধরনে বৈপ্লবিক পরিবর্তন হয়েছে। কোনো ঘটনায় ১০-১৫ জনের নাম লিখে কখনো কখনো হাজার হাজার অজ্ঞাত লোককে এসব মামলার আসামি করা হয়। তারপর নিজেদের উদ্দেশ্য হাসিলের প্রয়োজন হলে যে কাউকে ওই মামলার আসামি হিসেবে ধরে ক্রসফায়ারের ভয় দেখিয়ে মুক্তিপণ আদায় করা যায়। এ ছাড়া কোনো মামলায় আসামি হিসেবে কেউ নাম ঢুকিয়ে দিলেই সে ব্যক্তি অপরাধী হয়ে যান না। আর কেউ অপরাধী হলে তার বিচার করবেন আদালত। মামলা আছে, এই অভিযোগে কাউকে হত্যা করা জায়েজ হতে পারে না।
আবার এসব ঘটনায় পুলিশ দায়িত্ব অস্বীকার করলেও কারো কিছু বলার থাকে না। এ সম্পর্কে এক সহযোগী পত্রিকা সাম্প্রতিক কয়েকটি ঘটনার উল্লেখ করে দেখিয়েছে, কোনো কোনো ক্ষেত্রে প্রকৃত পুলিশ নয়, ভুয়া পুলিশ নাগরিকদের মুক্তিপণের জন্য অপহরণ করছে। গত ১২ জুলাই সকাল সাড়ে ১০টায় এমন একটি ঘটনা ঘটেছে সায়েন্স ল্যাবরেটরি এলাকায়। ব্যস্ত ঈদবাজারে শত শত লোকের সামনে একটি কালো কাচের সাদা রঙের মাইক্রোবাস থেকে ঝটপট নামল পাঁচজন সশস্ত্র লোক। নিজেদের গোয়েন্দা পুলিশের লোক পরিচয় দিয়ে তারা দ্রুত দুই ভাইকে মাইক্রোবাসে তুলে নেয়। মাইক্রোবাসের ভেতর থেকে তারা সাহায্যের জন্য চিৎকার করছিল। কিন্তু কেউ এগিয়ে আসেনি। এই অপহরণকারীদের প্রত্যেকের হাতে ছিল ওয়াকিটকি, কোমরের হোলস্টারে গোঁজা ছিল পিস্তল আর কোমরেই ঝোলানো ছিল হ্যান্ডকাফ। যারা তাদের দেখেছেন, তাদের কাছে এই অপহরণকারীদের প্রকৃতই ডিবির লোক বলে মনে হয়েছিল।
কিন্তু পরদিন প্রকৃত ডিবির লোক ওই অপহরণকারীদের তিনজনকে গ্রেফতার করে এবং তাদের কাছ থেকে ছিনতাইকৃত সাড়ে ২০ লাখ টাকার ৫০ হাজার টাকা উদ্ধার করে। অপহৃতদের একজন ছিলেন মানি এক্সচেঞ্জার। ভাগ্যগুণে ওই দুই ভাই অপহরণকারীদের হাত থেকে জীবিত ফিরে এসেছেন। কিন্তু বেশির ভাগেরই পরে আর কোনো খোঁজ পাওয়া যায় না।
পুলিশের রেকর্ড অনুযায়ী গত বছর দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে ৯২০ জন লোক অপহৃত হয়েছিলেন। এদের কাউকে কাউকে পুলিশ উদ্ধার করেছে। মুক্তিপণ দিয়ে কেউ কেউ ছাড়া পেয়েছেন অপহরণকারীদের কাছ থেকে। বাকিদের কোনো খবর নেই। তাদের ভাগ্যে কী ঘটেছে, কেউ বলতে পারে না। ডিবি বা পুলিশ পরিচয়ে যারা অপহরণ করে তারা প্রকৃতই পুলিশের লোক কি না তা শনাক্ত করার কোনো বুদ্ধি নাগরিকদের কাছে নেই। এ সম্পর্কে পুলিশের বক্তব্যও বেশ দায়সারা। এরা বলেন, পুলিশের পোশাক, হ্যান্ডকাফ, জুতা এগুলো বাজারে কিনতে পাওয়া যায়। তা কী করে সম্ভব? এগুলো যারা বিক্রি করে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা কেন নিতে পারে না পুলিশ? সম্প্রতি পার্বত্য চট্টগ্রামের এক ছবিতে দেখলাম, ফুটপাথে রীতিমতো দোকান সাজিয়ে বিক্রি করা হচ্ছে পুলিশের পোশাক, জুতা, ব্যাজ প্রভৃতি সামগ্রী। এটাও কী করে সম্ভব, বোঝা দায়। আর আগ্নেয়াস্ত্র? টাকা হলে তার কোনো অভাব এখন আর বাংলাদেশে নেই।
তবে এ কথা সত্য নয় যে, সব অপহরণই পেশাদার অপরাধীরা করছে। মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিস কেন্দ্র (আসক) জানিয়েছে, এ বছর গত জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে অপহৃত হয়েছেন কমপক্ষে ২৯ জন নাগরিক। আসকের সাম্প্রতিক রিপোর্টে দেখা যায়, অপহৃতদের চারজনের মৃতদেহ পাওয়া গেছে। একজনকে পরে মুক্তি দেয়া হয়েছে। আরেকজনকে গ্রেফতার দেখানো হয়েছে। বাকি ২৩ জনের কোনো খবর নেই। যেন তাদের কোনো অস্তিত্বই ছিল না। পুলিশ সাধারণত কোনো অপহরণের দায়ই প্রকাশ্যে স্বীকার করে না। তবে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্মকর্তার বরাত দিয়ে সহযোগী জানিয়েছে, তারা দু-একজনকে অপহরণ করে থাকে। তা কখনো কখনো রাজনৈতিক কারণে, কখনো বা টাকার জন্য। এই অপহৃতদের পেশাগত ও রাজনৈতিক পরিচয়ের কারণে কখনো কখনো মিডিয়ায় ব্যাপকভাবে এসব ঘটনা প্রচারিত হয়।
এ ব্যাপারে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের যুগ্ম কমিশনার মনিরুল ইসলাম আরেক ধাপ এগিয়ে বলেছেন, ‘অতীতে আমরা দেখেছি, গোয়েন্দা পরিচয় দিয়ে কিছু সংস্থার লোকজন কোনো কোনো লোককে তুলে নিয়ে গেছে। পরে তাদের গ্রেফতার দেখানো হয়েছে।’ এ কথা তিনি বলেছেন ১৩ জুলাই, যেদিন পুলিশ দুই ভাইকে অপহরণের ঘটনায় তিনজন ভুয়া ডিবির লোককে গ্রেফতার করা হয়। মনিরুল জানান, গত ছয় মাসেই তারা প্রায় ১০০ ভুয়া ডিবি পুলিশকে গ্রেফতার করেছেন।
আসক পরিচালক নূর খান লিটন জানিয়েছেন, এ বছর যতগুলো অপহরণের ঘটনা ঘটেছে, তার ২৫-৩০ শতাংশ ঘটনা তারা তদন্ত করেছেন। তাতে তারা দেখতে পেয়েছেন, অভিযোগের তীর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর দিকেই। সে হিসেবে অন্তত ২৯টি ক্ষেত্রে দেখা যায়, অপহরণের সাথে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীই জড়িত। কখনো দেখা যায়, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীই অপরাধীর বেশে অপহরণ করছে। আবার কখনো দেখা যায়, আসল অপরাধীরা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারীর পরিচয়ে অপহরণ করছে। এই কৌশল উভয় ক্ষেত্রেই বেশ কাজ দেয়। এ বিষয়ে অপরাধ বিজ্ঞানের অধ্যাপক আজিজুর রহমান বলেছেন, অপরাধীদের আইনের আওতায় আনা হয় না বলেই এ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে।
আমরা এ পরিস্থিতি থেকে পরিত্রাণ চাই। লেখক : সাংবাদিক ও সাহিত্যিক
rezwansiddiqui@yahoo.com
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন