ঈদের পরপরই আমার পর্ব ছিল বলে গত মঙ্গলবার লিখতে পারিনি। জীবনে প্রথম এতেকাফে বসেছিলাম। বেশ ভালো লেগেছে। এক নতুন অভিজ্ঞতা। এতেকাফে বসার আগে চিন্তা করেছিলাম মসজিদে কোনো কথা বলব না। প্রয়োজনে লিখে জানাব। কিন্তু মসজিদে গিয়ে দেখলাম তেমনটি হওয়ার নয়। কতজন সালাম দিচ্ছে একবার, দুবার তিনবার। কেউ হয়তো বলছে, 'এই যে স্যার, আপনাকে সালাম দিয়েছিলাম।' আবার কেউ বলছে, 'সালামুআলাইকুম। স্যার, আসসালামুআলাইকুম। সালামালাইকুম।' কতক্ষণ চুপ করে থাকা যায়? মসজিদে গিয়ে একজনকে পেয়েছিলাম। তিনি এক সরকারি কর্মচারী। ২০ রমজান থেকে মসজিদে আছেন। তবে অফিসের কাগজপত্র টেলিফোন সব নিয়ে এসেছেন। আমি যাওয়ার একদিন পর ওসব নিয়ে কথা হওয়ায় তিনি ত্যাগ করেছিলেন। মনে হয় স্বাধীনতার পর এমন দিন খুব কমই গেছে যেদিন খবরের কাগজ দেখিনি। এতেকাফে বসে খবরের কাগজের দিকে তাকাইনি। টেলিফোন বাইরে ফেলে গিয়েছিলাম। দুনিয়ার সঙ্গে সব কানেকশন কেটে আল্লাহর নৈকট্য পেতে চেষ্টা করেছি। রাজনৈতিক কর্মীরা দারুণ সহযোগিতা করেছে। যতক্ষণ এতেকাফে ছিলাম ততক্ষণ মসজিদ তাদের চোখে চোখে ছিল। এতেকাফে বসে নিজেকে বেশ ঝরঝরে লেগেছে। এখন প্রতি মুহূর্তে মনে হয় প্রতিটি মুসলমানের আল্লাহর ধ্যানে এতেকাফে বসা উচিত।
সেই কবে লিখেছিলাম সাবেক মন্ত্রী বড় ভাইকে নিয়ে লিখব। যখনই লিখতে যাই তখনই অন্য কোনো প্রসঙ্গ হিমালয়ের মতো মাথা তুলে দাঁড়ায়। বৃহত্তর ময়মনসিংহের কৃতী সন্তান সৈয়দ আশরাফ ক'দিন আগে মন্ত্রিত্ব হারিয়ে সান্ত্বনা পুরস্কার হিসেবে মন্ত্রণালয় পেয়েছে। সংস্থাপন মন্ত্রণালয়ের এখন ভিন্ন নাম। কানা ছেলের নাম পদ্মলোচনের মতো আর কী? সৈয়দ আশরাফকে যে মন্ত্রণালয়ই দেওয়া হোক সে কাজ করলে অবশ্যই ভালো করতে পারে। কিন্তু সে সুযোগ কোথায়? সেই কবে শুনেছিলাম, 'সকাল বেলার আমির রে ভাই, ফকির সন্ধ্যাবেলা।' আমার বড় ভাই লতিফ সিদ্দিকীর ক্ষেত্রে কথাটি সাজে কিনা ভেবে পাচ্ছি না। ঈদের এই ক'দিন মহামারীর মতো সড়ক দুর্ঘটনা ঘটছে। মানুষ মরে সয়লাব। আগে কলেরায় যেমন গ্রামকে গ্রাম বিরান হতো, তেমনি সড়কে যেন কলেরা লেগেছে। প্রতিদিন ২০-২৫-৫০ জন মৃত্যুবরণ করছে, কোনো প্রতিকার নেই। সেদিন কোনো দুর্ঘটনাস্থলে গিয়ে সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছেন, 'লাশ সামনে নিয়ে ফুল নিতে আসিনি।' সরকারি দলের স্তাবকরা কী পরিমাণ হৃদয়হীন হয়েছে, দুর্ঘটনাস্থলে আহত-নিহতদের মাঝে মন্ত্রীকে দেওয়ার জন্য ফুল হাতে দাঁড়িয়ে থাকে- এটাই তো গজব। রাজন নামের ছোট্ট এক বাচ্চাকে কয়েকজন সীমার মারতে মারতে মেরেই ফেলেছে। আল্লাহ জানেন এর কোনো প্রতিকার হবে কিনা। মানুষের মধ্যে দয়ামায়া মমতার যেন লেশমাত্র নেই। তাহলে এই কি কিয়ামতের আলামত- উত্তর খুঁজে পাই না। সেদিন আবার এক মারাত্মক ঘটনা ঘটেছে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে যেখানে রাজারবাগের পুলিশরা প্রথম প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিল, সেই পুলিশের মুখে চুনকালি দিয়ে একজন ডাকাতি করেছে। মামলা তদন্তের কাগজপত্র নিয়ে ব্যবসায়ীর টাকা লুট করতে গিয়ে ধরা পড়ে এখন চৌদ্দ শিকের ভিতরে। সেই কুলাঙ্গার পুলিশ জাহান্নামে যাক তাতে আমাদের কিছু যায় আসে না। কিন্তু সে যে সারা দেশকে ডুবিয়েছে। স্বাধীনতা যুদ্ধে অবিস্মরণীয় ভূমিকা রাখা সব পুলিশকে ডুবিয়েছে। পুলিশই যদি ডাকাত হয়, ডাকাতের প্রতিকারে মানুষ কার কাছে যাবে? এমন অবস্থায় প্রাক্তন মন্ত্রী বড় ভাইকে নিয়ে লিখতে গিয়ে হোঁচট না খেয়ে পারি না। ওদিকে পরম ভাগ্যবান মোফাজ্জল হোসেন মায়া কোনো ইন্দ্রজালে সাজাপ্রাপ্ত আসামি হয়েও দাপটে মন্ত্রিত্ব করছেন। তার মন্ত্রিত্ব যায় না, সংসদ সদস্য পদও না। কিন্তু কোনো অভিযোগ ছাড়াই জনাব লতিফ সিদ্দিকীকে নিয়ে টানাটানি। প্রবাদ আছে, 'নিজের ধন পরকে দিয়ে দৈবগ্য মরে ক্যাথা বয়ে'; বড় ভাই লতিফ সিদ্দিকীর ব্যাপারটা অনেকটা সেই রকম। তিনি জীবনে বড় ভাই লতিফ সিদ্দিকীর ব্যাপারটা অনেকটা সেই রকম। তিনি জীবনে বহুবার রাজনৈতিক উত্থান-পতন দেখেছেন। রাজনৈতিক উথাল-পাথাল মোকাবিলা তার জন্য কঠিন না হলেও আল্লাহ-রসুলের অবমাননায় পার পাওয়ার কোনো উপায় নেই বলেই আমার বিশ্বাস। তাই তাকে অনেকবার বলেছি আল্লাহর কাছে মাফ চাইতে। চুরির চুরি তার উপর আবার শিনাজুড়ি- সে এক মারাত্মক অপরাধ। আমেরিকায় আল্লাহ রসুল হজ জাকাত নিয়ে যদি কোন নকশা করার থাকে সে ভিন্ন কথা। ওটা আওয়ামী কৌশল হলেও আমাদের বলার নেই। লোকাচার রয়েছে, মহানবী (সা.) ও হজ নিয়ে কথা বলায় তার মন্ত্রিত্ব যায়নি, ভাগ্নে জয়কে নিয়ে বলায় মন্ত্রিত্ব গেছে। আমার তেমন মনে হয় না। তিনি জয়কে অত্যন্ত স্নেহ করতেন, ভালোবাসতেন। জয় সম্পর্কে তার অনেক উচ্চ ধারণা, তাই তাকে নিয়ে কিছু বলার কোনো কারণ খুঁজে পাই না। 'জয় বাবা কে, সে সরকারের কেউ না।' ও ধরনের কথা মোটেই জয়কে ছোট করতে নয়। তাই জয়ের ব্যাপারটা ওভাবে চিন্তা না করাই ভালো। ব্যাপার নিশ্চয়ই অন্যখানে যা আমরা না জানলেও বয়সের কারণে কিছুটা আন্দাজ করতে পারি। বড় ভাই লতিফ সিদ্দিকী যে খুব একটা কাঁচা খেলোয়াড় তেমন নয়। খেলতে গেলে অনেক সময় পা মচকাবে, ভাঙতেও পারে। ভাঙা-মচকা কত গুরুতর সেটাই এখন দেখার বিষয়। যে মানুষ ৭০ হাত মাটির নিচে গেলেও কিছু না বলে থাকতে পারে না, তিনি কী করে এতদিন নিশ্চুপ- এটাও তো তলিয়ে দেখা দরকার। তাই সময় বড় নিয়ামক। সময়ের চেয়ে বড় কোনো শক্তি নেই। একসময় সময়ই বলে দেবে আসল সত্য কী। আমরা এখন তা নিয়ে শুধু আলোচনা করতে পারি।
আমার বাবা-মা মৌলভী মুহাম্মদ আবদুল আলী সিদ্দিকী ও লতিফা সিদ্দিকীর প্রথম সন্তান আবদুল লতিফ সিদ্দিকী। দুই মায়ের গর্ভে আমরা ১৫ ভাইবোন। ষাটের দশকের আগেই কয়েকজন মারা গিয়ে এখন অব্দি ৭ ভাই, ৩ বোন আছি। আমি এখন দুই, কিন্তু আদতে আমার নম্বর চার। আমার আর বড় ভাইর মাঝে এক ভাই, এক বোন অনেক আগেই আমাদের ছেড়ে চলে গেছে। আমাকে হেয় করতে বড় ভাই দুই-একবার পিতা-মাতার তৃতীয় সন্তান হিসেবে চালিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেছেন।
কারণ মোগল সম্রাট শাহজাহানের ৪ পুত্রের তৃতীয়জন ভ্রাতৃঘাতী আওরঙ্গজেব। আমাকে সেরকম একটা কিছু সাজানোর প্রয়াসে তিনি অমন করেছেন। কিন্তু হালে পানি পাননি। সে যাই হোক, ছেলেবেলায় আমরা একেবারে অজপাড়াগাঁয়ে কাটিয়েছি। বড় ভাইয়ের মধ্যে অত শক্তি, সাহস ও প্রতিভা আছে আমার জানা ছিল না। '৬২-র শিক্ষা কমিশন আন্দোলনে প্রতিভাবান বড় ভাইকে প্রথম আবিষ্কার করি। আইয়ুববিরোধী দুর্বার আন্দোলনে টাঙ্গাইলকে যারা মাতিয়ে তুলেছিলেন তাদের মধ্যে ফজলুল করিম মিঠু, আল মুজাহিদী, ফজলুর রহমান ফারুক ও লতিফ সিদ্দিকীর নাম আসে সবার আগে। তখন মোটাগাটা শওকত তালুকদার ছিলেন মূলত শ্রমিক নেতা। এদের ঘিরেই আন্দোলন আবর্তিত হচ্ছিল। নেতা ছিলেন হুজুর মওলানা ভাসানী, শামসুর রহমান খান, বদিউজ্জামান, মীর্জা তোফাজ্জল হোসেন। এদের কারও বয়স ৪০-এর কোঠা পেরোয়নি। তখনো শাজাহান সিরাজের কোনো খবর ছিল না। শাজাহান সিরাজ এসেছেন তারও ৩-৪ বছর পর।
সে এক অভাবনীয় সময়। কেবল আইউবের মার্শাল'ল উঠে গেছে। মুসলিম লীগের দাপটে মাথা তুলে রাস্তায় হাঁটা যায় না, মাথা নিচু করে চলতে হয়। তার মধ্যে ছাত্রদের আন্দোলন। আমি তখনো তেমন কিছু বুঝতাম না। পাকিস্তান জন্মের পর থেকেই পাকিস্তানের জন্য যারা রক্ত পানি করেছে, রাত-দিন সংগ্রাম করেছে তারা বঞ্চিত হচ্ছিল। কোটারী মুসলিম লীগের রাজনীতিতে তাদের কোনো জায়গা ছিল না। যা নিয়ে শুরু থেকেই বিরোধের সূত্রপাত। পাকিস্তানের জন্মের সঙ্গে সঙ্গেই মুসলিম লীগবিরোধী উপদলের সৃষ্টি হয়। মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর মতো একজন বিচক্ষণ নেতা আমাদের মায়ের ভাষা কেড়ে নিতে চায়। যার ফলশ্রুতিতে ভাষা আন্দোলনের জন্ম এবং বাঙালি বুকের রক্ত দিয়ে '৫২-র ২১শে ফেব্রুয়ারি সফলতা লাভ করে। এরপর পূর্ববঙ্গের বঞ্চনার ইতিহাস বড় দ্রুতগতি পায়। এই গতি সবচেয়ে জোরদার করে করটিয়ার স্বনামধন্য জমিদার খুররম খান পন্নীর সঙ্গে এক অজ্ঞাত অখ্যাত কৃষক পরিবারের সন্তান শামসুল হকের দক্ষিণ টাঙ্গাইল উপনির্বাচন। সেই নির্বাচনে খুররম খান পন্নীর জামানত বাজেয়াপ্ত হয়। যদিও শামসুল হক একদিনের জন্যও পূর্ব পাকিস্তান আইনসভায় অংশ নিতে পারেননি, তবু জনতার রায় কাকে বলে সেটা পাকিস্তান সরকার বুঝে গিয়েছিল। তার পরপরই ভাষা আন্দোলনের সফলতা পূর্ববঙ্গবাসীকে আরও অনুপ্রাণিত করে। যার প্রতিফলন ঘটে '৫৪-র যুক্তফ্রন্টের নির্বাচনে। রাষ্ট্রপতি আবু সাঈদ চৌধুরীর পিতা জনাব আবদুল হামিদ চৌধুরী '৫৪-র নির্বাচনে কালিহাতি থেকে মুসলিম লীগের সাইকেল মার্কায় প্রার্থী হয়েছিলেন। 'সাইকেলে পাম নাই, ভোট দিয়ে কাম নাই'- গ্রামেগঞ্জে স্লোগান উঠেছিল। '৪৯-র টাঙ্গাইল দক্ষিণ উপনির্র্বাচনের মতো '৫৪-র যুক্তফ্রন্টের নির্বাচনেও একই ফল ফলেছিল। পাকিস্তান হাসিলকারী মুসলিম লীগ সাত বছরের মধ্যে পূর্ব পাকিস্তানে নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছিল। ৩০০ আসনের মোট ৯টি পেয়েছিল তারা। আর সবকটি হক-ভাসানী-সোহরাওয়ার্দী-শেখ মুজিবের যুক্তফ্রন্ট পেয়েছিল। রুয়াইল-ছাতিহাটির আমির আলী খাঁর বিপরীতে বিপুল বিত্তের অধিকারী আবদুল হামিদ চৌধুরী জামানত খুইয়েছিলেন। সেই নির্বাচনে লতিফ সিদ্দিকী পাদপ্রদীপের সামনে আসেন। আমি তখন বেশ ছোট, দৌড়াদৌড়ি করি। নির্বাচনী প্রচারণায় আউলিয়াবাদ হাটে যুক্তফ্রন্ট এবং মুসলিম লীগের প্রচারকদের মধ্যে ভীষণ মারামারি হয়েছিল। যুক্তফ্রন্ট প্রার্থী ছোটখাটো আমির আলী খাঁকে বড় ভাই লতিফ সিদ্দিকী পাজাকোলা করে আমাদের গ্রামের পুবের পাড়া এক কলাঝোপের মধ্যে বসিয়ে রেখেছিলেন। সেই প্রথম তাকে আমি রাজনীতিতে আবিষ্কার করি। আমরা থাকতাম গ্রামের বাড়ি, বড় ভাই টাঙ্গাইলে থেকে বিন্দুবাসিনীতে পড়ালেখা করতেন। সেই সময় তিনি স্কাউট জাম্বুরিতে চিটাগাং গিয়েছিলেন। সেখানে ভোলা থেকে তোফায়েল আহমেদও গিয়েছিলেন। সেই থেকে তাদের মধ্যে পরিচয়। তাদের তুই তুমি সম্পর্ক ছিল। কত চিঠি দেখতাম। দিনে দিনে বহু বেলা গড়িয়েছে। হঠাৎই একদিন টাঙ্গাইলে এক ছাত্র সম্মেলন হয়। আমরা তখন ময়মনসিংহ জেলার বাসিন্দা। মনে হয় '৬২ কী '৬৩ সাল। পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগের টাঙ্গাইল মহকুমাকে জেলায় উত্তীর্ণ করা হয়। সম্মেলনে আসেন ছাত্রলীগের সভাপতি শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন, সাধারণ সম্পাদক শেখ ফজলুল হক মণিসহ আরও অনেকে। রওশন টকিজে সম্মেলন কেন্দ্রে সারা দিন বক্তৃতা হয়। ওর আগে অমন বলিষ্ঠ বক্তব্য কখনো শুনিনি। টাঙ্গাইল জেলার প্রথম ছাত্রলীগের কমিটি ঘোষণা করা হয়। সভাপতি শওকত আলী তালুকদার, সাধারণ সম্পাদক আবদুল লতিফ সিদ্দিকী। এরপর লতিফ সিদ্দিকী আর লতিফ সিদ্দিকী। টাঙ্গাইলের ছাত্র আন্দোলনে মাত্র কয়েকটি নাম শোনা যেত- ফজলুুল করিম মিঠু, ফজলুর রহমান ফারুক, আল-মুজাহিদী, বুলবুল খান মাহবুব, আতিকুর রহমান ছালু ও লতিফ সিদ্দিকী। ।বাংলাদেশ প্রতিদিন।
লেখক : রাজনীতিক।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন